সাহিত্য

বিশ্বাস

বিশ্বাস
১ -ওমা খিদা লাগছে......... নিরুত্তর মায়ের খেয়াল অন্য দিকে প্রচন্ড জোরে ঝড় হচ্ছে, বাঁশে তৈরী দরোজা জানালা শক্ত করে বন্ধ করে দেয়া থাকলেও মাথার উপরে নড়েবড়ে টিনের ছাদটি বড়ই বেপরোয়া ভাবে ঝড়ের তালে তাল মিলিয়ে নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে, না জানি কোন যুদ্ধে যাবার নেশায় মেতেছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছেন ক্ষুধার্ত ছেলেটির মা নিরুপমা দেবী, সিঁথিতে লাল টকটকে সিঁদুর, বিবর্ণ মলিন চেহারায় ফ্যাকাশে ভাবখানা স্পষ্ট। সামনেই পুতুলের মতো ছোট্ট দূর্গা দেবীর আসন, কিছু ফুল, পাতা দিয়ে যত্ন করে সাজানো। নিরুপমা দেবীকে এবার জোরে ঝাকালো নিরুপমা দেবীর ছেলে অতিশ কুমার, -মা খিদা লাগছে, শুননা ক্যান? আশ্চর্যরকম ভাবে চমকে উঠলো নিরুপমা, এতোক্ষন তার ভাবখনা এমন ছিলো যে ছেলের কথা শুনেও না শোনার ভান করে আছে, কিন্তু না তা নয়। ছেলের কথা সে শুনতেই পায়নি, বড়ই বিমর্ষ সে মাথার ছাদ হারানোর আগমূহুর্তে শোকে বিহবল হয়ে পড়েছে। আর চমকে উঠেছে এই ভেবে যে, যাহ! টিনের চাল বুঝি উড়ে গেছে!আসল ব্যাপারটি খেয়াল করে, অতিশের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো, -খালি খাওন আর খাওন, যা বাপের কাছে গিয়া ক, আমি কই থিকা তরে খাওন দিমু। অতিশের কান্নার শব্দ আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে, কিন্তু তা ঘরের সীমার মধ্যেই থেকে গেলো। মেঘের থেকে থেকে গর্জন আর বৃষ্টি, ঝড়ের শব্দে অতিশের কান্না ঠিক আকাশ পর্যন্ত পৌছতে পারছেনা। নিরুপমা দেবীর রাগ মাথায় উঠেছে, -কতবার কইলাম চলো ভারত চইলা যাই ওইহানে গিয়া মন্দিরে তিনবেলা প্রসাদ অইলেও পাওন যাইবো কে শোনে কার কথা, আমি মরি তোগো লাইগ্যা, আর......... জোরে দরোজা ধাক্কানোর শব্দ শুনে থেমে গেলো নিরুপমা দেবী। উঠে দরোজা খুলে যে মানুষটিকে দেখলো, সে মানুষটির পুরো ঠোঁট জুড়ে বিস্তৃত হাসি, কিছু পেয়ে যাবার আনন্দ পুরো মুখমন্ডলে। অতিশ কান্না থামায়, খুশিতে আটখানা সে, -কাকা!! ২ ২. বেশ কিছুদিন পর...... সেদিনের ঝড়ে টিনের ছাদটিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়নি, বরং ঝড় শেষেই শক্ত করে মেরামত করা হয়েছে। অতিশ আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে, গত কয়েকদিন তিন বেলা পেট পুরে খেতে পেয়েছে সে। রাস্তায় বন্ধুদের সাথে ছুটছে আর কথা বলছে, -কাকাই আব্বারে ভারত পাঠাইয়া দিছে, আব্বা ভালো চাকরী করতাছে, দুই তিনমাস পর আমরাও যামু। অবাক হয় বন্ধুরা, মনও খারাপ হয়ে যায়, -আমাগো কথা মনে থাকবো? গ্রামের শ্যামল ছায়ায় ছুটছে বালকগুলো, ছুটন্ত এই বালকগুলো নীড়ে ফেরার রাস্তা ধরেছে, নিষ্পাপ মনে হচ্ছে ওদেরকে। পাশাপাশি ছুটছে, এই কথা শুনে মলিন হয়ে যায় আট বছরের অতিশের মুখটি, থমকে দাঁড়ায় একটি গাছের নিচে, সাথে বাকী দুজনও, -নারে ক্যামনে ভুইলা যামু ক? তরা যাবি আমার সাথে? ওরা আর কিছু বলেনা, বাবা মা ভাই বোন ছেড়ে ওরা কী করে যাবে অতিশের সাথে? অতিশও ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তাই এবার যে যার মতো নিজেদের বাড়ির পথে চলে যায়। অতিশ দরোজা নক করলো, একটাই মাত্র রুম, বারান্দা নেই, নেই কোন আঙ্গিনা। সচরাচর দিনের বেলা এই দরোজা বন্ধ থাকেনা। অতিশ প্রায় পাঁচমিনিট ধরে নক করতে করতে বিরক্ত হয়ে জোরে ধাক্কা দেয়, -মা, ওমা দরোজা খুলতাছনা ক্যান? দরোজা খুলে গেলো, সামনে দাড়ানো সেই কাকাটি, রাগ নিমিষেই পড়ে গেলো অতিশের, -কাকা কহন আসছ? বিব্রত কাকার পুরোটা ঘেমে একাকার, -এইতো তুমি কই গেছিলা? -খেলতে, মা কই? নিরুপমা দেবী শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে বেরিয়ে আসে, -কীরে কহন গ্যাছস, সন্ধা পার অইছেনা? কাকার উচ্ছসিত কন্ঠ, মুখে বিশ্রি হাসি, অতিশের কাছে কাকার এই হাসিটা সবসময় খুব বিরক্ত লাগ্‌ তাই ঐ সময় সে কাকার মুখের দিকে তাকায়না। বললো, -নিরু বৌদী অতিশের খেলনা গুলা দিয়া দাও আমি আসতাছি। অতিশ খুশিতে আটখানা, সে মাকে লক্ষ্য করে বললো, -কাকাই খুব ভালা না মা? নিরুপমা দেবী নিরুত্তর, আজ যা হলো তাতে এ পৃথিবীর সবকিছু যেন তার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসছে এরকমতো হওয়ার কথা ছিলোনা, অতিশের বাবা কতোদিন হয়ে গেলো লা-পাত্তা। আর অতিশ যাকে খুব ভালোবেসে কাকা ডাকে সে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, সরকার দলীয়,  যে সরকার রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধী নিধনে নেমেছে। এই চেয়ারম্যান আবুল হোসেন যুদ্ধাপরাধীর দলে পড়ে নাকী রাজাকারের দলে পড়ে নিরুপমা দেবী তা জানেনা, জানতেও চায়না ভাবতেও চায়না। কারণ আবুল হোসেন বিনিময়ে অনেক কিছু দিচ্ছে, তিনবেলা ছেলেকে নিয়ে পেট ভরে খেতে পারছে, এইতো ভালো। ৩. অনেক  পথ হেঁটে আজ অনেকদিন পর ছেলেকে নিয়ে দুর গ্রামের এই মন্দিরে প্রবেশ করেছে নিরুপমা। মন্দিরে দাড়িয়ে মুর্তির দিকে হাতজোড় করে অপলোক তাকিয়ে আছে নিরুপমা দেবী, মনে মনে মনের সকল চাওয়া গুলো আওড়াচ্ছে। অতিশও পাশে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে, ও বিড়বিড় করে বলছে, -ঠাকুর সেদিন গোপাল কাকার পোলা আমারে অর ব্যাটে হাত দিতে দ্যায়নাই, তুমি আমারে একটা ব্যাটের ব্যাবস্থা কইরা দ্যাও, আমার ব্যাট যেন ঐ নিলয় এর থ্যাইকাও সুন্দর হয়। নিরুপমা দেবী অনেক্ষণ পর মন্দিরের ঠাকুরমশাইয়ের ডাকে স্বাভাবিকে ফিরে আসে, ঠাকুর মশাই উদ্বিগ্ন কন্ঠে, -মারে তুই এখনও যাসনাই! সন্ধা হইয়্যা গেলোতো, আকাশটাওতো খুব খারাপ ঝড় আসতে পারে, সবাই চলে গেছে! নিরুপমা অকস্মাৎ চমকে ওঠে, -অমা তাইতো এহন? অতিশ মায়ের নিরুপায় মুখের দিকে তাকিয়ে ভীত হয়ে যায়। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে ঝড় আর বৃষ্টি ঠিক সেদিনের মতো, চারেদিকে রাত্রির মতো অন্ধকার মন্দিরের ঘন্টাগুলো ঝড়ের তোড়ে ঢং ঢং করে বাজছে। নিরুপমা দেবী গুটিশুটি হয়ে ছেলেকে নিয়ে একটা পিলারের আড়ালে বসে পড়ে। এভাবেই বসে থাকলো মা ছেলে, অতিশ বিরাট ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে, এতো চুপচাপ সে থাকতে পারেনা। মধ্যরাত। ঝড় কমলেও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তুমুল জোরে বৃষ্টি পড়ছে। মন্দিরে ভালোমতো একটা ছাদ থাকায় ভিজতে হচ্ছেনা ওদের। নিরুপমা দেবী একটু যেন ঘুমিয়েই পড়লো। হঠাৎ রনসাজে সজ্জিত হয়ে মন্দিরে ঢুকলো চার পাঁচজন যুবক সাথে একজন নির্দেশনা দিচছে, তার মুখ কালো কাপড়ে ডাকা। যুবকগুলোর মুখ ঢাকা নয়, তাদের হাতে মোটা মোটা লাঠি, ওরা আগে ঠাকুর মশাইয়ের মাথায় জোরে আঘাত করলো, অতিশ চিৎকার করতে চাইলে ওর মুখ চেপে ধরে নিরুপমা দেবী। লোকগুলো দুর্গা দেবী সাথে থাকা সমস্ত গহণা নিয়ে নিলো, আর মূর্তিগুলো ভেঙ্গে দিয়ে চলে গেলো, অতিশ মুখ ঢাকা লোকটির বিশ্রি হাসির শব্দ শুনতে পেলো, অতিশের মনে হলো এই মানুষের হাসিমুখ যতটা অসুন্দর হাসির শব্দটা তার চেয়ে বেশী অসুন্দর। শেষ সকালে অতিশকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে নিরুপমা। চারেদিকে গাছের ভাঙ্গা ডাল, গাছের পাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কোথাও কোথাও আস্ত গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে। কোথাও কারো ঘরের টিনের ছাদ উড়িয়ে গেছে। এযেন ধ্বংসযজ্ঞ, এতোসব পেরিয়ে ঘরে আসতে অনেকটা সময় লেগে গেলো। নিরুপমা ঘরে ঢুকেই পাতিলে চাল নিয়ে ধুয়ে সরাসরি চুলায় বসিয়ে দিলো। চালের সাথেই কয়েকটা আলু আর কাঁচামরিচও সিদ্ধ দিলো। সন্ধার আগে সামান্য প্রসাদ ছাড়া সারা রাত আর কিছুই খাওয়া হয়নি। আর যা ঘটেছে তাতে মা ছেলে খুব ভীত, নিরুপমা অবশ্য কাউকেই চিনতে পারেনি, রাস্তায় কিছু লোক বলাবলি করছিলো, - এইগুলা সব ঐ রাজাকারদের কাজ, রায় দেয়ার পরই এই কামডা করলো। তোরা কুরআন এতোই মানস তাইলে এইডা ক্যান মানসনা যে অন্য ধর্মের উপর যুলুম করা ঠিকনা...... নিরুপমাও মনে মনে সায় দিয়েছিলো ওদের কথায়। নিরুপমা চুলা জ্বালিয়ে ছেলের দিকে তাকায়, -কতা কসনা ক্যান? অতিশের মুখটা ভার। মলিন কন্ঠে, -কিছু অয়নাই, খিদা লাগছে। -এইতো আর একটু পরই অইয়্যা যাইবো......... কথা শেষ না হতেই চেয়ারম্যান আবুল হোসেনর আগমন ঘটে। অতিশ সবদিনের মতো তার প্রিয় কাকাকে দেখে খুশি হতে পারলোনা। আবুল হোসেন অতিশের সামনে আস্‌ অতিশ তাকায়না তার দিকে আবুল হোসেন, -অতিশ কী হইলো খুশি হওনাই? এই দ্যাখো কী আনছি ব্যাট, তোমার লাইগ্যা। অতিশ ব্যাটটা হাতে নেয়, কিছুই বলেনা। আবুল হোসেন একটা মোড়া নিয়ে নিরুপমা দেবীর খুব কাছে বসে, অতিশ দেখলো কাকা ওর মায়ের একদম কাছে বসে মায়ের মুখমন্ডল, গলা ছুঁয়ে দিচ্ছে, যেমনটি অতিশের বাবা করতো । অনেক সুন্দর ব্যাটটিকে নেড়ে চেড়ে দেখে নিলো অতিশ, অনেক সুন্দর ব্যাট। ওর চাওয়া পূরণ হয়েছে। লাল হয়ে আসে অতিশের দুচোখ, চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে আবুল হোসেনের মাথায় ব্যাট দিয়ে আঘাত করলো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে, মাথা ফেটে ফিনকী দিয়ে রক্ত বের হলো, আবুল হোসেন কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো, অতিশ চিৎকার করে বলছে, -কাল রাইতে এই কুত্তার বাচ্চা মা দুগ্গার গায়ে হাত দিয়া তারে ধ্বংস কইরা দিছে, আর আজ আমার মায়ের গায়ে হাত দিছে, চাইনা এই ব্যাট চাইনা। দুরে ছুড়ে দেয় ব্যাটটি। ঘটনার আকস্মিকতায় নিরুপমা দেবী থ মেরে ছিলো, স্বাভাবিক হয়ে ছেলের মুখ চেপে ধরে, এবার শক্ত করে ছেলের হাত ধরে, ছুটতে শুরু করে দেয় প্রচন্ড জোরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কেউ দেখার আগেই এই গ্রাম ছাড়তে হবে, এই দৌড় ঠিক কোথায় গিয়ে থামবে তা জানেনা নিরুপমা দেবী......(সমাপ্ত)  

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)