ধর্ম ও গবেষনা

মিথ্যা বলার নানান কায়দা ও পরিণতিঃ ২য় ও শেষ পর্ব

মিথ্যা বলার নানান কায়দা ও পরিণতিঃ ২য় ও শেষ পর্ব
গত পর্বের পরঃ  :-) চ) রসিকতা করে মিথ্যা বলাঃ রসিকতা করা জায়েজ কিন্তু সেটা মিথ্যা বলে নয়, কেননা মিথ্যা সর্বদাই পরিতাজ্য। যেমন একবার রাসূল (সাঃ) জনৈকা মুসলিম বৃদ্ধা মহিলাকে বলেছিলেন যে, ‘আপনিতো বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেন না!’ অথচ মহিলাটির খুব আত্মবিশ্বাস ছিলো যে, তাঁর আখিরাতের প্রস্তুতি তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেই, তাই তিনি এই কথায় খুবই চিন্তিত হয়ে পরলেন এবং আহতও হলেন যথেষ্ট। অবস্থা তথৈবচ দেখে তাকে রাসূল (সাঃ) এবার বুঝিয়ে বললেন, ‘বেহেশতে প্রবেশ কালে সকলেই যুবক/যুবতী হয়েই প্রবেশ করবে!’ এইবার মহিলাটি বুঝতে পারলেন যে, কথাটা আসলে ছিলো নবীজীর (সাঃ) এর রসিকতা, যার মধ্যে ছিলো নিগুঢ় বাস্তবতা। অথচ রসিকতা করার নামে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছি আমরা অনবরত। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাস্‌উদ (রাঃ) বলেছেন, ‘রসিকতা করে মিথ্যা বলা এবং অহংকার প্রদর্শন করা কোন অবস্থাতেই ঠিক নয়।’ জ) ভয়, ভীতি ও চাপের মুখে পড়ে মিথ্যা বলাঃ অনেক সময় এরূপ ঘটতে দেখা যায় যে, কোন স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করে অধীনস্ত কোন ব্যাক্তিকে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে তাঁর জীবনের প্রতি হুমকি তথা ভয় ভীতি প্রদর্শন করে তাঁর থেকে প্রার্থিত স্বার্থ আদায় করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে, ফলে ব্যাক্তি আত্মরক্ষার্থে বা চাকরী রক্ষা করতে গিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। মিথ্যা বলা বা বলানোর জন্য এ ধরণের নজীর এ সমাজে একেবারে অপ্রতুল নয়। ঝ) পেটে ক্ষুধা থাকা সত্বেও ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে মিথ্যা বলাঃ আমাদের সমাজে সংস্কৃতির এ যেন এক নতুন সংযোজন। আবার অনেকে একটা একটা ফ্যাশন হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে যে, বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনদের সাথে আপ্যায়নের জন্য অনুরোধ্য হয়ে ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে বলতে হবে যে এখন খাবারের প্রয়োজন নেই কিংবা খেতে ইচ্ছা করছে না, এমনকি পেটে ক্ষুধা থাকলেও! অথচ এরূপ মিথ্যা কথা বলতে রাসূল (সাঃ) এর স্পষ্ট নিষেধ আছে। হযরত আসমা বিনতে উমার (রাঃ) থেকে বর্নিত এ হাদীসে রাসূল (সাঃ) তাঁর এক নব বধূ খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানালে রাসূল (সাঃ) বললেন, “ক্ষুধা ও মিথ্যাকে একত্রিত করোনা।” সুপ্রিয় পাঠক-পাঠিকা মনে রাখবেন, মিথ্যা কথা বলার যতো ধরণই থাকুক না কেন আর তা বাস্তব বা অবাস্তবই হোক প্রকৃত সত্য গোপন করার অর্থই হচ্ছে মিথ্যা। যার পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতে অত্যন্ত ভয়াবহ ও ক্ষতিকর। এবার নিম্নে মিথ্যার ভয়াবহ পরিণতির কয়েকটি দিক উল্লেখ করা হলোঃ- (১) মিথ্যা সমূহ পাপের জননীঃ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘মিথ্যা সকল পাপ কাজের জননী।’ মানুষ অপরাধ করে সেই অপরাধের পরিণতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মিথ্যাই হয়ে উঠে সকল পাপ কাজের সাময়িক আশ্রয় ও প্রশ্রয় দাতা। (২) মিথ্যা জুলুমের শামিলঃ মিথ্যা বলা বা সাক্ষ্য দেয়া মানেই সত্য ও সঠিক বস্তু বা ব্যক্তির উপরে জুলুম করা। এটা জঘন্য অপরাধ। এভাবে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (সাঃ) এর উপরে কিংবা ইসলামের উপরেও মিথ্যা অভিযোগ করাও এবং ইসলামের সত্য বিধানের বিপরীতে অবস্থান নেয়াও কিন্তু জুলুম বা জঘন্য অপরাধ। সূরা সফে আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, “যে ব্যাক্তি ইসলামের দাওয়াত পাওয়ার পরেও আল্লাহ্‌ সম্পর্কে মিথ্যা বলে তাঁর চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে?” (৩) মিথ্যা কবীরা গুনাহঃ জানা থাকা আবশ্যক যে মিথ্যা বলা বা সাক্ষ্য দেয়া কবীরা গুনাহ। আল্লাহ্‌ তায়ালা সূরা হজ্জ্বে স্পষ্টই বলেন যে, ‘তোমরা মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকো।’ (৪) মিথ্যার পরিণতি হলো ধ্বংসঃ মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করেনা এবং কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। ফলে তাঁর জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। মিথ্যুক সেই রাখাল বালকের পরিণতি সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা। মহানবী (সাঃ) তাই বলেছেন, ‘মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।’ (৫) জাহান্নামের মিথ্যাবাদীর স্থানঃ মুনাফেকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মিথ্যা বলা। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হলো তিনটি, যার প্রথমটি হলো মিথ্যা বলা।’ সুতরাং যার মধ্যে এই মুনাফেকী আছে তাঁদের পরিণতি সম্পর্কে সূরা নিসা’য় আল্লাহ্‌র সুস্পষ্ট হুঁশিয়ারি “মুনাফেকীদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে!’ (৬) মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার পরিণতিঃ মিথ্যা সাক্ষ্য দানকারী কয়েকটি বড় বড় গুনাহের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েঃ কঃ সে মিথ্যা ও মন গড়া কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে খঃ সে যার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাঁর উপরেও জুলুম করে। কারন এতে সাক্ষ্যকৃত ব্যাক্তির মান ও সম্মানের ক্ষতি হয়। গঃ যার পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তাঁর উপরেও জুলুম করে কেননা সে তাঁর জন্য হারাম সম্পাদনের ব্যবস্থা করে। (৭) মিথ্যাবাদী সকলের ঘৃণার পাত্রঃ মিথ্যাবাদীকে কেউ ভালোবাসেনা। বরং সবাই ঘৃণা করে। এমনকি ফেরেশতারাও তাকে ঘৃণা করে দূরে সরে যায়। এ সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘কেউ যখন মিথ্যা বলে তখন তাঁর দুর্গন্ধের কারণে আল্লাহ্‌র ফেরেশতারা পর্যন্ত (ঘৃণায়) তাঁর থেকে এক মাইল দূরে সরে যায়।’ (8) সর্বোপরি আল্লাহ্‌য় খাতায় মিথ্যাবাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়াঃ একবার দুইবার এভাবে বহুবার যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন সে মিথ্যাবাদীর খাতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, ‘আর কোন ব্যক্তি যখন সর্বদা মিথ্যা কথা বলতে থাকে, তখন সে মহান আল্লাহ্‌র খাতায় চরম মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হয়ে যায়।’ পরিশিষ্ট/শিক্ষাঃ মিথ্যা যাবতীয় অশান্তির কারন। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণও বটে। সকলের কাছে সত্যবাদীর যেমন সম্মান, মর্যাদা ও পুরস্কার রয়েছে, তেমনি ঠিক বিপরীতেও মিথ্যাবাদীর জন্য রয়েছে ঘৃণা, নিন্দা ও তিরস্কার। সত্যবাদিতা জান্নাতের কারন। আর মিথ্যাবাদিতা জাহান্নামের কারন। মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল ইযযাত আমাদের সবাইকেই মিথ্যার ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষা করুন এবং নেক আমল করতে পারার মাধ্যমে তাঁর দ্বীনের পথেই কবুল করুন। আমীন।  :-)

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)