সাহিত্য

আত্মজা..থাকুক আত্মার মাঝেই...

আত্মজা..থাকুক আত্মার মাঝেই...
images (6) বাবলি আজ নতুন স্কুলে ভর্তি হলো। ওর বাবার ট্রানসফারের চাকরি। মানে ওর বাবা রহমান চৌধুরী কৃষি কর্মকর্তা। কিছুদিন পরপর উনার বদলী হয় আর সেই সাথে বাবলীরও স্কুল বদল। বাবলী এবার ক্লাস সেভেনে উঠলো। মা খুব ছোটবেলায় মারা গেছে। তারপর থেকে বাবাই দু’জনের দায়িত্ব পালন করছেন। নানা-নানী, দাদা-দাদী সবাই ওকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু রহমান দেয়নি। সুবর্ণাকে হারিয়ে এমনিতেই রহমান বড্ড একা হয়ে গিয়েছিল। সুবর্ণার শেষ স্মৃতি বাবলিকে তাই কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাননি। একজন আদর্শ বাবা বলতে যা বুঝায় রহমান বোধহয় তাই। বা তার চেয়েও বেশি কিছু। সবাইতো তাই বলে। স্কুল থেকে বেড়িয়ে রহমান বাবলিকে জিজ্ঞেস করলো- -কি রে? স্কুল কেমন লাগল? -ভালোইতো। বাবলির সাদামাটা জবাব। রহমান একটা নিশ্বাস ছাড়লেন। দীর্ঘ কিনা বোঝা গেলনা। মেয়েটা একদম মায়ের মত হয়েছে। এমনিতে হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত চাপা আর গভীর যে রহমান তল খুজে পাননা। বারবার স্কুল বদল হওয়ায় মেয়েটার ঘনিষ্ট বন্ধুও তেমন নেই। নাহ এবার একটু থিতু হওয়া বোধহয় দরকার। মেয়েটাতো বড় হচ্ছে। বয়োসন্ধির সময়তো এটাকেই বলে বোধহয়। রহমানের এই ব্যপারগুলো এত জটিল লাগে। মাথায় কিছুই সেট হয়না। সব কেমন জিলাপী টাইপ হয়ে যায়। তবু তিনি খুব সিরিয়াসভাবেই এসব মনস্তাত্তিক ব্যপারগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। কারন তাকেতো মা বাবা দুই ক্যারেকটারই চালিয়ে নিতে হচ্ছে। এবং তিনি এটাও বোঝেন যে যতই তিনি ফ্রেন্ডলি বাবা হন না কেন মেয়ের সবটুকু উজার করা অনুভূতি তিনি বুঝতে সক্ষম নন।তাই সবটা বুঝতে যাওয়া উচিতও না। একটা মেয়ে আর একটা ছেলের মানসিক দুরত্ব যোজন যোজন। সুবর্ণাই তার সবচেয়ে বড় প্রমান। দু’জনের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলেও ভালোবাসার কোন খামতি ছিলনা কোনকালেই। রহমানের যন্ত্রনায় সুবর্নার কোথাও যাওয়ার উপায় ছিলনা। মাসে দু’মাসে বাপের বাড়ি গেলেও রাতে জনাব হাজির। প্রতিবার একই অযুহাত। কড়া গম্ভীর শশুড়ের সামনে কেঁচো হয়ে যেতে যেতে মিনমিন করে বলতো- -এই এদিকে একটু কাজ পড়ে গেল হঠাৎ। ভাবলাম এত কাছে যখন এসেছি আপনাদের দেখেই যাই। ভাবিদের এ নিয়ে কত হাসাহাসি! তবু প্রতিবার একই কান্ড! সুবর্নাকে ছাড়া রহমানের যে নিজেকে বড় অপূর্ণ মনে হতো। এখনও হয়। তবুও তাদের মানসিক চিন্তা চেতনায় কিছুতো ফারাক ছিলই। খারাপ কিছু নয়। ন্যাচারাল ইস্যু। ওপরওয়ালার মহিমা। প্রাকৃতিক ব্যালেন্স। সুবর্ণা ভাবতো এক লাইনে আর রহমান ভাবতো আরেক লাইনে। অথচ দু’জনের ভাবনাই একই উদ্দেশ্যে একই বিষয়ে থাকতো। আর বাবলিতো এ যুগের প্রতিনিধি। কত জেনারেশন গ্যাপ! রহমান মেয়েকে দেখলেন। মায়ের আদল পেয়েছে মেয়েটা। যদিও সবাই বলে বাবার সাথে মিল আছে। কিন্তু রহমান মেয়ের দিকে তাকালেই সুবর্ণাকেই কেন দেখতে পান। কি জানি! -বাবলি! -কি বাবা। -বেলুন নিবি? -বাবা! আমি এবার সেভেনে উঠেছি! ওয়ানে নয়! -তাতে কি! সেভেনের মেয়েরা বেলুন কিনে না কোথাও আইন আছে নাকি! আর তুই তো স্কুলে নিয়ে যাবি না। ঘরে রেখে দিবি। রহমানের মাথায়ই থাকেনা যে মেয়েটার খেলনার বয়স শেষ। এখন বন্ধুত্বের বযস। আর মেয়েটাও হয়েছে মার মত। এইটুকু মেয়ে অথচ কথা বলবে এত কনফিডেন্টলি! সন্ধায় টিভি দেখতে বসেছে বাপ-বেটি। ফেলুদা হচ্ছে। বাবলি খুব সেলফ-ডিপেন্ডেন্ট। ঘরের প্রায় সব কাজই ও করে। এই যেমন এখন দু’জনের জন্য নুডলস করে এনে বসেছে। খুব সিরিয়াসভাবে ফেলুদা দেখছে। রহমানও তো এমনই করতো। বয়সটাইতো এমন। নাকি নিজেকেই ফেলুদা ভাবছে? কি জানি! ফজর পড়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই রহমানের। মেয়েকে সাথে নিয়ে হাটতে যান। তারপর এসে রেডি হন স্কুলে যাওয়ার জন্য। বুয়া নাস্তা বানিয়ে দেয়। খেয়েই ছুট। আজ এত গরম পড়েছে! উফ! ভোরবেলাতেই রোদ জালিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই বুয়া এসে পত্রিকা দিয়ে গেল। পত্রিকায় প্রথম পাতার নীচের অর্ধেকটা জুড়ে একটা অ্যাড দিয়েছে। এটাও মেয়েদের ব্যাপারে। আচ্ছা, আজকাল মেযেদের ছাড়া বুঝি কোন অ্যাডই হয়না! পাতা উল্টেও কি মনে করে আবার ফিরে তাকালেন। অ্যাডটা পড়লেন। রহমান সহজ সরল হলেও তিনিতো বিবাহিত পুরুষ তাই এটা কি জিনিসের অ্যড বুঝলেন আর চরম বিরক্ত হলেন। বাবা-মেয়ের একটা অ্যাড। তবে একটা মেয়ে কিভাবে বাবাকে এই চিঠি লিখতে পারে তা তার বোধগম্য হলোনা। ইউনিক আইডিয়া করতে করতে কোথায় যে এরা পৌঁছে যাচ্ছে! আজগুবি যত্তসব! তিনি রেডি হতে উঠলেন। কয়েকদিন পর.. ইদানীং বাবলিকে কেমন দেখায়। একটুতেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে। রহমান মেয়ের পরিবর্তনটা খেয়াল করছেন। কিন্তু আবার ওই এক সমস্যা। তল খুজে পাচ্ছেন না। মেয়েটাকে সাথে রেখে বোধহয় ভুলই করলেন তিনি। দাদা দাদীর সাথে থাকলেই ভালো হতো। মানুষজন বেশি থাকতো, মিশতো। কিন্তু তিনি তো কোন ত্রুটি রাখেননি চেষ্টায়। কি জানি! => -রহমান! কি খবর! -চলে যাচ্ছে। রহমান হাসার চেষ্টা করলো। সজীব ভাই। রহমানের সিনিয়র। প্রথমদিন থেকেই রহমানের দিকে একটু বেশি নজর দিচ্ছে। সারাক্ষণ ফোড়ন কাটার সুযোগ খুজছে। নাছোড়বান্দা টাইপ। ও আর ওর বন্ধু কাম কলিগ জামিল এসেছে শহরের একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। জামিল ভাইয়ের মায়ের কিছু রিপোর্ট নিতে। ওয়েট করছে। সজীব ভাই এখানেও! -সমাজ তাহলে ভালোই এগোচ্ছে! জামিলের কথায় মুখ তুলে তাকালো রহমান। টিভিতে অ্যাড হচ্ছে। দেখলো পত্রিকায় যে অ্যাডটা দেখেছিল সেই একই কোম্পানীর। -কি ব্যপার? স্বজীবের স্বভাবগত কৌতুহলের প্রশ্ন। -আর বলবেন না! দেখেন না কি সব অ্যাড বানায় আজকাল! বাবা হয়েও সংকোচ করিনি! কোন সাবজেক্ট হইলো! জঘন্য! -যুগের সাথে তাল তো মেলাতেই হবে। আর এখনতো সমঅধিকারের যুগ। -যাই বলেন সজীব ভাই। এটা নোংরামী! -তোমাগো মত আঁতেল নিয়াই সমস্যা! মিয়া, কলেজে য্যুলজিতে তো মেয়েলী কোন বিষয় পাইলে ওই চ্যাপটার একবারের জায়গায় চারবার পড়তা! আর টিভি তে একটা সচেতনতামূলক অ্যাড দিলেই ওইটা হইয়া যায় অশ্লীলতা! অপসংস্কৃতি! হুহ! -আমার কাছে মনে হয়েছে দুটো মিলিয়ে একটাই মেসেজ দিতে চেয়েছে। সচেতনতা। উদ্দেশ্যটা ভালো তবে চিন্তায়, পদ্ধতিটায় সমস্যা। বাবাকে না টানলেই হতো। বাবা যত বন্ধুই হোক না কেন এটুকু শালীনতাবোধতো থাকতেই হবে। ইসলামেও ছেলেমেয়ে বড় হলে বাবা মায়ের ঘরে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে বলা হয়েছে। -আরে বাহ! তুমি আবার হুজুর হইলা কবে থেকে! চিল্লায় টিল্লায় যাওয়া শুরু করলা নাকি! রহমানের মুখে কঠিন একটা কথা এসছিল। নিজেকে সামলে নিল। বললো- -আমি মানছি আমি অত ধার্মিক না, কিন্তু তাই বলে বাঙালী সংস্কারের পরিবারেতো বড় হয়েছি। প্রতিদিন না পড়ি জুমার নামায তো কোনদিন বাদ দেইনা! আর অনান্য সব ধর্মেও যত আধুনিক হোকনা কেন কিছুটা শালীনতাবোধের ব্যবহার রয়েছে। সুতরাং শালীনতাবোধটুকুর প্রয়োজন অবশ্যই আছে। বিসর্জন দেয়া মোটেও ঠিক হবেনা। কোন মেয়ে শিশুকে রান্নাবাটি খেলা শিখিয়ে দিতে হয়না! আপনি হাড়ি পাতিল না কিনে দিলে দেখবেন সে পাউডার কেস কে হাড়ি বানিয়ে রান্না করছে! কিন্তু ছেলে শিশুকে দোকানে নিয়ে যান। যত যাই থাকুক, সে ধরবে বল! এটা প্রকৃতির সিস্টেম। কোন মা কে শিখিয়ে দিতে হয়না বাচ্চাকে কতটুকু পরিমান খাওয়াতে হবে! মা নিজেই বুঝে যায় তার বাচ্চার পেটে কতটুকু খাবার ধরবে! জীবনে কোনদিন শুনেছেন কোন মা খাওয়াতে খাওয়াতে বাচ্চা পেট ফেটে মরেছে! এটা তাদের গড গিফটেড অভিজ্ঞতা। আপনার আমার অতটা আঁতেল নাহলেও চলে! তারা নিজেরাই সক্ষম! হিন্দু ধর্মে “খোদার উপর খোদকারী” একটা কথা প্রচলিত আছে জানেন তো? এটা হলো তেমন! প্রকৃতি তার নিজস্ব একটা সিস্টেমে চলে। শালীনতাবোধ তারই একটা অঙ্গ। এটুকু শালীনতাবোধও যদি সমাজ থেকে উঠে যায় ভালো হবেনা কারো জন্য। কারন এটা যে প্রাকৃতিক বিধানের বিরোধিতা। এর বিরুদ্ধে গিয়ে কারো কল্যাণ হয়না। রহমান উঠে দাড়ালো। কাউন্টারে ডাক পড়েছে। জামিলকে নিয়ে এগোলো। => বাবলিদের ষষ্ঠ পিরিয়ড হোম ইকোনমিক্স। আলেয়া ম্যাডামের। কিন্তু এলেন সুপ্তি ম্যাডাম। হেড মিস্ট্রেসও এসেছেন। কেন! আলেয়া ম্যাডামের কি অসুখ! -মেয়েরা, আজ তোমাদের একটা প্র্র্যাকটিক্যাল বিষয়ে ক্লাস হবে। কেউ ব্যপারটিকে হালকা করে নেবেনা। লজ্জা করবেনা। এবং মনোযোগ দিয়ে ক্লাসটা করবে। আর কারো কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই করবে দ্বিধা না করে। তোমরা বড় হয়েছ। আরো হবে। এ সময়টাকে বলে বয়সন্ধির সময়। প্রতিটি মেযের জন্যই এটা দরকারী বিষয়। এরপর ৪৫মিনিট ধরে যা হলো তা একটা নতুন দিনের স্বপ্ন। প্রতিটি মেয়ে যেন ক্লাসে সুপ্তি ম্যাডাম নয় তাদের মা অথবা বড়বোনকে দেখলো। বাবলির আজ খুব হালকা লাগছে নিজেকে। => স্কুল থেকে বেড়িয়েই বাবলি বাবার হাতটা ধরলো। আইসক্রিম খেতে চাইলো। ৫টাকার লেমন ললি। খেলে মুখ জিভ সব সবুজ হয়ে যায়। রহমানও একটা নিল। মেয়েটা আইসক্রিম খাচ্ছে। হাতে একটা লম্বা লেজওয়ালা নীল বেলুন। রহমানের আইসক্রিমটা পড়ে গেছে রাস্তায়। কাঠিটা হাতে রয়ে গেল। বাবলি কপট রাগ দেখালো। -বাবা তুমি না! আইসক্রিমটাও ঠিক করে খেতে পারো না! রহমান সাহেব বালকের মত হাসলেন। -নাও, হা করো। বাবলি দু’বার নিজে খাচ্ছে। আরেকবার ওর মুখে একটু দিচ্ছে। রহমান মেয়ের দিকে তাকালো। হঠাৎ যেন রহমান তার মার আদল দেখলো মেয়ের মুখে। চোখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা সত্যিই বুঝি এবার বড় হয়ে গেল! রোদটা তাতিয়ে উঠেছে। মেয়েটার মাথায় একটা হাত রাখলেন। সূর্য়ের তাপ না কমলেও বাবলির জীবনের সকল তাপ দুর হয়ে যাবে। কোন অসভ্য পন্থায় নয় সভ্য পন্থায়।

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)