
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাল বৈশাখের পয়লা রাত। একটু আগে তার তাণ্ডব চালিয়ে গেছে সে। আমি তখন বারান্দায়। দেখতে পাচ্ছিলাম ধুলার বায়ুমণ্ডল যেন মানুশগুলকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলে পরি মরি করে যার যার ঘরে ঢুকছেন। ভাবছি শহুরে প্রাচীর ভেদ করে ঝড় কি করে ঢুকে? যেমনটি করে দেহের পুরু আবরণ ভেদ করে মনের ভিতরে ঝড় বয় ওমন করে কী? ঝড় কতো ধরণের হয়! শহুরে ঝড় , গ্রাম্য ঝড়, আন্দোলনের ঝড়, মনের ও ঝড়। ভাবলাম আমি কখনো গ্রাম্য ঝড় দেখিনি। কল্পনা শক্তি ব্যায় করে আমার একটা গ্রাম বানালাম। লম্বা লম্বা ডাল বিশিষ্ট ঝাঁকড়া পাতার গাছ দিলাম। ঠিক আমাদের বাসার নিম গাছ দুটোর মত লম্বা। ও দুটো যেমন দুলছে আমার গাঁয়ের গাছগুলোও তেমন ওলট পালট দুলছে। আমি গ্রাম্য মেয়ে, আমার গ্রামটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য চিৎকার করে বলছিঃ
ঝড় তুই চলে যা। তুই থাকলে আমার সাজানো গ্রামটা ছন্নছাড়া হয়ে যাবে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! ঝড় আপন গতিতে আমাকে আরও জোরে পেছনে ঠেলে দিয়ে শ্বাশাল । ভাবটা এমন যে বেশি কথা বললে আরও ভয়াবহ অবস্থা করে ছাড়ব! আমি মন ভরা দুঃখ নিয়ে আমার ছনের ঘরে ঢুকলাম । সেখানে আমার কল্পনার একটি ছোট্ট পরিবার। বাবা-মার বন্ধনে তিন ভাইবোন জড়সড় হয়ে আছে। তাদের সবচাইতে ছোট ভাইটির বয়স তিন হবে হয়তো। সবার চোখে আতঙ্ক , ওদের একমাত্র আশ্রয়টা দুলছে। ভয়াবহ দোলাতে দুলছে। ছনের চালা থেকে বেশ কিছু জায়গায় ছন উরে গিয়ে খোলা মেঘযুক্ত বালুকাময় আকাশ দেখা যাচ্ছে। হায় আল্লাহ্! যদি এভাবে পুরো বাড়িটুকু শেষ হয়ে যায়, ওরা তাহলে থাকবে কোথায়? কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগালাম। কিন্তু ঘরটা কিছুতেই রাখতে পারছিনা। এক জায়গার ছন ঠিক করছিত আরেক জায়গার চালা উড়ে যায়। বিকট শব্দে একটা গাছের কাণ্ড দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে যায়। তার সাথে সাথে আর্ত-চিৎকার দিয়ে ওঠে তিনটি প্রাণী। বাবা অভয় দেয়,
ভয় পাইওনা মা। ভয় পাইওনা বাপ। একটু পর ঝড় থাইম্মা যাইব। তখন সব ঠিক কইরা লমুনে।
ছোট এই ভরাট বৃত্তটা আরও সংকুচিত হতে থাকে। এত ছোট চোখে-মুখে আতংক আর হতাশার চাউনি ফেলে আশার বানী শোনানো পিতাকে দেখে মনে মনে খুব অপরাধ বোধ হল। কেন ওদের এই কল্পনায় আনতে গেলাম? এখন কি হবে ওদের? গটগট করে বেরিয়ে এলাম ওদের বাশের বেড়া ছাড়িয়ে। ওমা! এখানে পুকুর এলো কোথাথেকে? পুকুরের পানিতে ঝড় দেখব বলে নারিকেল গাছ দিয়ে বানান সিঁড়িতে খালি পা ফেলেছি। কেমন এক অনুভতি নিজেকে ভয় পাইয়ে দিল। আর দাড়িয়ে থাকতে পারলামনা।সামনে মস্ত পুকুরটাকে কে যেন ঝাকাচ্ছে মুখ খোলা পানি ভরা বোতলের মত। গায়ে ঝাপিয়ে পড়া পানির সাথে তুপ করে কোলের উপর এসে পড়লো লাল টুকটুকে পুটি মাছ। নারিকেল গাছের সিঁড়ি খুলে যাচ্ছে। এখনি উঠতে না পারলে নির্ঘাত পানির নিচের পাতালপুরী তে পোঁছে যাব । তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে শাড়ির নিচের এক কোনা ফুটো হয়ে ঢুকে গেল নারিকেল গাছের কাণ্ডের ক্ষতবিক্ষত গর্তের চোখা মাথায়। টান খেয়ে মুখ থুবড়ে পরাকে হাত দিয়ে ঠেকালাম। কাপড় ছাড়াবার সময় নেই। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে দৌড় দিলাম। ছেরা অংশ সমেত পানিতে তলিয়ে গেল সিঁড়ি। বাতাস তার প্রতিভা দেখাতে উঠে পরে লেগেছে যেন! হাতের কাছে একটা গাছ পেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বাতাসের আঘাতে বড় বড় পানির ফোঁটা গুলো পাথরের মত গায়ে আঘাত করছে। মনে হচ্ছে হাওয়ার মাঝে কোন পিলার ধরে ভাসছি। পা এখন আর মাটির সন্ধান পাচ্ছেনা। হয়তো তা পানিতে তলিয়ে গেছে, নয়তো পায়ের অনুভূতি কমে গেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চোখ খোলা দায়। আমি একহাতে গাছ ধরে আরেক হাতে আশে পাশে হাতড়াতে লাগলাম। ঠাণ্ডা কিছুতে হাত লাগতেই একটা মানুষ চিৎকার করে উঠল। আমি খুবই অবাক হয়ে চেঁচিয়ে বল্লামঃ
এখানে ঝড়ের মধ্যে কেউ কি আছেন?
একটু পর এ জবাব এলঃ আমনে কেডা?
আমি শ্রাবণী। আপনি কি করছেন এখানে?
অপরিচিত কণ্ঠ একটু সময় দেরি করে রাগি কণ্ঠে বললঃ
হাডুডু খেলতাছি! বঝেন্না কি করি? ঝড়ের মইদ্ধে মাইন্সে খাম্বা ধইরা কি করে???
আমার ভিশন লজ্জা লাগলো।
আপনি কি আমার মত হটাত করে ঝড়ের মধ্যে বিপদে পরে গেছেন?
লোকটা মনে হল এবার চরম খেপল। বিফদে না পরলে কি এই হানে লতা ধইরা খারায় খারায় মজা লইতাছি???
আমি চুপ করে গেলাম। আনমনে গাছ ছেড়ে আন্দাজে লোকটির দিতে দু কদম বাড়লাম। লোকটা আমার মত কাক ভিজে প্রান পনে গাছ জড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে অবাক হল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমি বল্লামঃ ঝড় থামিয়ে দিয়েছি। আর লতা ধরে থাকতে হবেনা।
সত্যি ই ঝড় থেমে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হল। এবার আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার কল্পনার উপর আমার নিয়ন্ত্রন ফিরে এসেছে। সামনে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকা লোকটার চেহারা কেমন করে জানি আমার বড় ভাইয়ের মত হয়ে গেল। নাহ, এ আমার বড় ভাই ই। বারান্দায় ঝড়ের সময় আমাকে একাকি দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
কীরে?
আমি হাসি দিয়েঃ না এমনি। বাতাস উপভোগ করছিলাম।
ভাইয়া ধমক দিয়ে বললঃ আর কাজ নাই না? যা ভিতরে যা। বাতাস উপভোগ!! ঘরটা বালুতে ভরে গেছে। এখনি তুই সব সাফ করবি।
এখন প্রচণ্ড বৃষ্টি বাইরে। ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম কি হল সেই ছোট ঘরের মানুষদের? তাদের ছোট তিন শিশুর মুখে এখন নিশ্চয়ই আর ভয়ের ছাপ নাই। আর ঐ লোকটা কি বাড়ি যেতে পেরেছে? আমার গ্রামটা না জানি কেমন ভেঙ্গেচুরে আগোছালো হয়ে আছে!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)