সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস "নিয়ন্ত্রিত পরিণতি"

ধারাবাহিক উপন্যাস "নিয়ন্ত্রিত পরিণতি"
১৩ ও ১৪ এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। স্মৃতি রাজিবের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। রাজিবের কিছু কিছু কর্মকান্ড দেখে বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি। রাজিব একমনে কিছু কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে, একসপ্তাহে সাতজনকে খ্রিষ্টান বানিয়েছে। আজ আনুকে খ্রিষ্টান বানানোর পালা। ভোর ছয়টায় উঠে পড়েছে রাজিব, স্মৃতি আরো আগে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছে, এখন রান্না করছে। রাজিবকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করছে স্মৃতি। রাজিব স্মৃতিকে ওর বাবার বাসায় যেতে দিতে চাইছেনা এমন একটা ধারনা স্মৃতির মনে জন্ম নিয়েছে। রান্না শেষ করে রাজিবের পাশে এসে দাড়ায় স্মৃতি, -কোথাও যাচ্ছেন? -আনু......স্মৃতির দিকে তাকিয়ে, না একটু কাজ আছে। একটা কথা জিজ্ঞেস করব? -হ্যা বলেন। -নাদিমের সাথে তোমার যোগাযোগ আছে? -কেন? আপনার বন্ধু আপনার সাথে যোগাযোগ নেই? -এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো? -আপনি কী আমার প্রশ্নের পুরো জবাব দিয়েছেন? আনুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন সেটাতো বলেননি। রাজিব নিজের ইতস্তত দৃষ্টি আর উঠালোনা, বের হয়ে চলে গেলো। স্মৃতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ড্রয়িং রুমে বসে টিভি ছেড়ে মায়ের নাম্বারে কল করলো, -মা কেমন আছ? সুফিয়া চৌধুরী বিমর্ষ কন্ঠে, -ভালো, তুই ভালো আছিস মা? -এইতো আলহামদুলিল্লাহ! তোমার কন্ঠ এমন কেন শুনাচ্ছে? -তুই আসছিসনা যে স্মৃতি... -মা রাজিবতো খুবই ব্যাস্ত, ওমা তুমি আসো। -আসবো? -হ্যা আসো। রেখে দেয় স্মৃতি, অনেক খুশি হয় স্মৃতি মা আসছে এক সপ্তাহ পর দেখা হবে কম কথা নয়। আর এতো বড় একটা বাসা একদম একা। একজন ছুটা বুয়া এসে পরিচ্ছন্নতার সমস্ত কাজ করে দেয়, কথা বলতে পারেনা বুয়া, একটা কিশোর ছেলেকে দুবার দেখেছে ছোট খাটো কিছু কাজ করে দিয়ে যায়। স্মৃতি কিছূ একটা ভেবে আবারো সুফিয়া চৌধুরীকে কল করে, -মা রেডি হচ্ছো? -হ্যা, কেন মা? -বাবা আসবে? -না। -আচ্ছা মা একটু কষ্ট করে রুবিনা আপু কুরআনের যে দশটি খন্ড দিয়েছিলো নিয়ে এসো। -হ্যা নিয়ে আসবো। ঠিকানাটা...... -ও হ্যা,  দাড়াও একটু আসলে ঠিকানা জানা হয়নি, আমি নিচে গিয়ে দেখছি। অনেক বড় ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢাকলো স্মৃতি, সিড়ি বেয়ে নামে, নেমপ্লেট দেখে কিঞ্চিত শক অনুভব করলো । ও শুনেছে রাজিবদের নিজেদের বিল্ডিং এটি কিন্তু "রোজারিও লজ" লিখা কেন? রাজিব কী বাবাকে মিথ্যা বলেছে? যাইহোক ঠিকানা মাকে বলে, -৬৩,রোজারিও লজ,সেক্টর নং-৬ উত্তরা, ঢাকা। মা গাড়ী নিয়ে আসছতো না? ফিরে আসে স্মৃতি, কিছুদিন ধরে একটা চিন্তা বারবার স্মৃতিকে তাড়া করছে, সেটা হলো, কুরআন নেই। অর্থসহ কুরআন না থাক আরবী তো থাকার কথা। মুসলমানের ঘরে......... রাজিবকে কখনো নামাজ পড়তেও দেখেনি এমনকী জুমার নামাজও না। সেন্ট পল গীর্জা। রাজিব আনুকে নিয়ে সেই গীর্জায় প্রবেশ করেছে। আনুকে ঢাকা মেডিকেল থেকে নিয়ে এসেছে, রাজিব ওকে কিছু নিয়ম পড়ে শুনাচ্ছে, গলায় চেনের সাথে পরার মতো ক্রুশের একটা লকেট ওর হাতে দিলো, বললো, -পরে নাও। ওর হাতে ওটা দিয়ে এগিয়ে যায় যিশু খৃষ্টের মূর্তির দিকে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে অষ্পষ্ট স্বরে, -আর দুজন ব্যাক্তির টার্গেট পূরণে কৃপা করো প্রভু। আনুর দিকে একবার তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি ফিরালো মূর্তির দিকে, -মিথ্যা কথা বলবো প্লিজ কিছু মনে করোনা। আনু বিস্মত কন্ঠে, -কী বলছো ফিসফিস করে? আর আমরা এখন বিয়ে করবোতো তাইনা? তারপর তোমার বাসায় নিয়ে যাবে আমায়? রাজিব তাকালো আনুর দিকে, -আনু তুমি যে খৃষ্টান হয়ে গেলে, তাতেই আমাদের বিয়ে হয়ে গেলা। আর আমার বাসায় এখনই তোমাকে নিতে পারবোনা। তবে হ্যা ৪ নং সেক্টরে তোার জন্য একটা ফ্লাট কিনেছি তুমি সেখানে থাকবে, আমি তোমার কাছে আসতে পারবোনা। কারণ বাবা মা এখনও জানেনা।...... -আমি একা কী করে থাকবো রাজিব? আর তুমি আসবেনা মানে, আমাদের বিয়ে হয়ে গেলোনা? -আনু প্লিজ এটুকু তো করতেই হবে, তুমি ফ্লাট পাচ্ছ পাঁচলাখ টাকার চেক পাচ্ছ, এখন কিন্তু তোমার উপরে একটা দায়িত্ব পড়ে যায় জানোতো? শংকিত কন্ঠ আনুর, -কী সেটা? -তোমার বাবা মাকেও যিশৃর কৃপার ছায়াতলে নিয়ে আসা, সেটা করলে তোমাকে আর একা থাকতে হবেনা। -শর্ত দিচ্ছ রাজিব? হাসে রাজিব, -আরে নানা তা নয়, তুমিতো আমাকে ভালোবাসো তাইনা? -হ্যা, কিন্তু......... -তাহলে আমার জন্য এটুকু অপেক্ষাতো করতেই পারো। মলিন হয় আনুর কন্ঠ, -হ্যা কিন্তু এতো দুর থেকে মেডিকেলে যাবো কী করে? - আরে দরকার নেই, তোমাকে আমি প্রাইভেটে ভর্তি করে দেব। আনুর কেন জানি কান্না চলে আসে, তবুও আড়াল করে, -তোমার জন্য আমি সব ছাড়তে পারি রাজিব, শুনেছি স্মৃতিও নাকী এই উত্তরাতেই থাকে, ওর হাজব্যান্ড ওর জন্য গাড়ী কিনে দিয়েছে মেডিকেলে যাতায়াতের জন্য, তুমি কী জানো কোথায় থাকে ও? এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায়, -না না আমি কি করে জানবো। চলো তোমাকে ফ্লাটে পৌঁছে দিয়ে আসি। ১৪ সুফিয়া চৌধুরী মেয়ের পাশে বসে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছেন, স্মৃতি মাকে চিন্তামুক্ত রাখার জন্য রাজিবের ভালোটুকু বলেছে, ডাক্তার সুফিয়া চৌধুরীকে চিন্তা মুক্ত থাকতে বলেছেন তা না হলে আবার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। সুফিয়া চৌধুরী তারপরও মৃদু কন্ঠে, -কিছু লুকোচ্ছিস মা? স্মৃতি হেসে বললো, - মা, তুমি না অযথা টেনশন করছো, ও একজন দায়িত্বশীল হাজব্যান্ড। কলিং বেল বাজলে উঠে দাড়ায় স্মৃতি, -মা রাজিব এসেছে মনে হয় খুলে আসছি। দরোজা খুলে সাইডে দাড়ালো, রাজিব ঢুকেই স্মৃতির হাত চেপে ধরে, স্মিত হেসেম আবেগভরা কন্ঠে, -আই লাভ ইউ স্মৃতি...... এক ঝটকায় হাত ছেড়ে নিয়ে, -আপনি আনুর সাথে ঘুরে এসে আমাকে...... যাইহোক মা এসেছে, সিনক্রিয়েট করবেননা প্লিজ। -তাই নাকী! খুব ভালো কথা তোমার পাশে ইচ্ছেমতো বসে থাকতে পারবো, শাশুড়ী মা দেখবেননা মেয়ে জামাইকে দেখতে কেমন লাগে, আর সিনক্রিয়েট? সেটাতো তুমিই করো আমি না, তোমার মা তুমি ঠিক করো কী করবে, গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্মৃতির দিকে, তারপর দ্রুত গিয়ে সুফিয়া চৌধুরীর সামনে বসে, -মা কেমন আছেন? স্মৃতি চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো। সুফিয়া চৌধুরী হাস্সোজ্জ্বল কন্ঠে, -এইতো বাবা আছি আর কী কোন রকম। -বাবা ভালো আছেনতো না? উনি আসলেন না কেন? -জানোইতো ওর ব্যাস্ততা। তুমি ভালো আছ রাজিব? -হ্যা এইতো যিশুর......সুফিয়া চৌধুরীর মুখমন্ডলে সামান্য কৌতুহল খেয়াল করে, -ভালো আছি, আপনি বসুন আমি চেন্জ করে আসছি। -হ্যা বাবা তাই যাও। রাজিব চলে যাওয়ার একটু পরেই স্মৃতি বড়ো একটা ট্রে হাতে ভেতরে ঢোকে ট্রের উপরে ফ্লাক্স, তিনটা খালি চা কাপ, পাঁচ আইটেমের নাস্তা। রাজিব ফিরে এসে, স্মৃতির একদম পাশে বসে পড়ে, সুফিয়া চৌধুরী মনে মনে খুব খুশি হলেন, তার মনে হলো জামাই মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, রাজিবের কথা শুনে সেদিকে মনোযোগী হলেন, -মা বুক সেলফে কুরআন দেখলাম আপনি এনেছেন? হেসে কথা বলছে রাজিব, কিন্তু মনে মনে ফুঁসছে। -হ্যা আমিই এনেছি, স্মৃতি চেয়েছিলো। রাজিব একদম নিচু স্বরে, স্মৃতিকে লক্ষ করে, -আমাকে কী তোমার এতই গরীব মনে হয় যে সামান্য কুরআন কিনে দিতে পারবোনা, ভ্রু কুঁচকে যায় স্মৃতির, -সামান্য? কুরআনের আগে এই শব্দ কেন বসালেন, সব কিছুকে টাকা দিয়ে বিচার করবেননা......... রাজিব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য, -মা কষ্ট করে আপনি আনতে গেলেন কেন? আমি কিনে দিতাম, যাই হোক নিন নাস্তা করুন আমার পেটটা চো চো করছে, -নাও তোমরাও নাও, -রাজিবের দৃষ্টি স্মৃতির মুখমন্ডলে আটকে আছে, কিন্তু ওর চোখে এখন গভীরতা নেই বরং রাগে লাল হয়ে আছে। সুফিয়া চৌধুরী কাপে শেষ চুমুক দিয়ে, -আমারতো শেষ বাবা আমি এখন উঠবো, তোমরা ভালো আছো দেখে শান্তি পেলাম এখন নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। স্মৃতির মন খারাপ হয়ে গেলো, মলিন কন্ঠে, -ও মা আজ যেওনা প্লিজ, আমি তোমার সাথে কালকে যাবো, আমার একা একা...... রাজিব কথা কেড়ে নেয়, -আমাকে একা রেখে যেতে চাচ্ছ? কিভাবে পারলে কথাটা বলতে? সুফিয়া চৌধুরী মনে মনে জামাইকে নির্লজ্জ বলতে দেরী করলেননা, কিন্তু খুশি যে হননি তা নয়। মুচকী হেসে, -না স্মৃতি যাবেনা, তুমি বরং দুই চারদিনের মধ্যে স্মৃতিকে নিয়ে এসো বাসায়, তুমি বাইরে গেলে ওতো একা হয়ে যায়। -হ্যা ঠিকই বলেছেন, তবে ওর একাকিত্ব আমি ঘুচিয়ে দিব, আপনার একটা নাতী নাতনী... স্মৃতি শেষ করতে দেয়না, -যেওনা মা। - না মা যেতে হবে, তোর বাবাকে তো তুই জানিস। -ঠিক আছে, কিন্তু এখান থেকে মেডিকেলে যাতায়াত একটু কষ্ট হয়, মানে জ্যামের কারণে অনেক সময় ব্যায় হয়...... রাজিব কন্ঠে বিরক্ত নিয়ে, -সে কথা তুমি মাকে কেন বলছো, আমরা পরে এটা নিয়ে কথা বলবো চলুন মা আপনাকে গাড়ী পর্যন্ত দিয়ে আসছি। -চলো। স্মৃতি ওর মাকে জড়িয়ে ধরে সিড়ি দিয়ে নামছে, কাঁদছে নিরবে সুফিয়া চৌধুরীও কাঁদলেন, তারপর গাড়ীতে উঠলে গাড়ী চলে গেলো, মুখ ফিরিয়ে রাজিবের চোখের সাথে চোখ রেখে, -এই বিল্ডিং আপনাদের নিজেদের? -হ্যা কোন সন্দেহ আছে? -জায়গা কিনে তৈরী করা, নাকী কেনা? রাজিব স্মৃতির হাত ধরে টানতে টানতে, উপরে যেতে যেতে, -এতো রাগ করে কথা বলছো কেন, দারোয়ান তাকিয়ে আছে না? ভেতরে চলো বলছি। স্মৃতি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাজিবের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকে রাজিবের মুখোমুখি সোফায় বসে, -বলুন। রাজিবের দু চোখেই আগুন, -আমি কী উত্তর দিতে বাধ্য, উত্তর পেয়ে যেতে যদি বিয়ের দিন মোবাইলে কথা না বলে আমার সাথে যেতে, আর কুরআন আনিয়েছো না, ওটাতে কী আছে মানো? মুসলিম রীতি অনুযায়ী স্বামীর অধিকার সম্পর্কে জানা আছে তোমার,আরে হাত পর্যন্ত ধরতে দাওনা, আমার জীবনে তুমি এমন একটা সত্য হয়ে এসেছো যাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা, তোমাকেই শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবাসী নতুন এক মুক্তির পথ দেখাতে বিয়ে করেছি তোমায়......... রাজিবের কথাগুলো চিৎকারের মতো শুনাচ্ছে, স্মৃতি হতভম্ব হয়ে গেছে, মলিন কন্ঠে, - আমি আর কিছু জানতে চাইনা। -কেন চাওনা, আমি আনুর সাথে দেখা করতে গেলাম জানতে চাওনা কেন যাওয়ার কারণ? - আপনি যে কারণে আনুর সাথে দেখা করতেন সেই কারণেই আজও গেছে আমি জানি আপনাদের নির্লজ্জতার কথা, সেটা নতুন করে জানতে চাওয়ার কিছু নেইতো...... -আজ আমি আনুর হাত পর্যন্ত ছুইনি বিশ্বাস করো তুমি? না করবেনা আমাকে সবসময় খারাপই মনে হয় তোমার। একটু থামলো রাজিব, নিজের চিৎকারের মতো কন্ঠটাকে স্বাভাবিক করে, -আচ্ছা যাইহোক কুরআন আনিয়েছো না? ওগুলো ফেরত পাঠাবে, ওই জিনিস তুমি পড়বেনা। ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে স্মৃতি, -কী বলছেন এসব? সম্মান দিয়ে কথা বলুন। উঠে চলে যায় স্মৃতি। রাজিব ওখানেই বসে ভাবতে থাকে আমি কেন এই মেয়েকে বলতে পারছিনা বাইবেল পড়তে, কেন বলতে পারছিনা সত্যিই আমি রোজারিও, আমি কী ওকে হারানোর ভয় করছি? কেন? আরে অনেক মেয়ের সাথেতো সময় ব্যায় করেছি, সাথে সাথে আমার পরিচয়ও বলে দিয়েছি, আমি কী ওকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি? ওর প্রতি এতো টান কেন আমার? আমার অন্তর শুধু ওকে নিয়েই ভাবে। চিন্তা থামাতে গিয়ে ওর মনে পড়লো নাদিমের কথা। ওকেও খ্রিষ্টান বানানো যায়নি, কোথায় যেন লুকিয়ে আছে, খুব দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে... হে ঈশ্বর স্মৃতির মায়াবী জালে আমাকে জড়িওনা প্লিজ। চলবে......

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)