সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস "নিয়ন্ত্রিত পরিণতি"

ধারাবাহিক উপন্যাস "নিয়ন্ত্রিত পরিণতি"
১ বিকালের তাপহীন সুর্যের আলো চারেদিকে মুগ্ধতা ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অপূর্ব স্নিগ্ধতার আমেজে মন ভরে যায়। এই সৌন্দর্যকে প্রাণ ভরে উপলব্ধি করা মানবাত্মার প্রকৃতিগত স্বভাব। আর এই উপলব্ধিটা কোন ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। হঠাৎ আনমনে ভাবটা কেটে যায় স্মৃতির, মনে পড়ে প্রতিদিনের কড়া রুটিনের কোন একটি কাজ যেন বাদ পড়ে গেছে। কী সেটা? মনে করতে কিছু সময় পেরিয়ে যায়। দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকায়, ৫ টা বাজে। নামাজ, আছরের নামাজ পড়া হয়নি। শুক্রবারের রিলাক্স মুডটা নামাজের ক্ষেত্রেও সমান্তরাল ভুমিকা পালন করছে। বাহ! নিজে নিজে অবাক হয় স্মৃতি, একটা প্রশ্ন জাগে ওর মনে, আমি নামাজকে অবধারিত মনে করি নাকী অন্যান্য কাজকে......... উত্তর পেয়ে যায়। প্রতিদিন আছরের আযানের পাঁচমিনিট আগেই নামাজ পড়ে নিতে হয়, কারন পাঁচটা থেকে মেডিকেলে ভর্তি কোচিং। আজ কোচিং নাই তাই নামাজও......... নিজেই নিজেকে উপহাস করে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান স্মৃতি। বড় ভাই ছিলো ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেছে, চিকিৎসার অভাবে, আর ছোট একটা বোন সে আত্মহ... করেছে, স্কুলের বই কিনতে না পারায়, স্যার আবার পরপর তিনদিন স্কুল মাঠে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। স্মৃতির বাবা সাইমন চৌধুরীর অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো, দু বেলাও পেট ভরে খাওয়া হতোনা। গ্রামের হাইস্কুল থেকে এস এস সি পাশ করার পর আচানক ওর বাবা বিশাল সম্পদের মালিক হয়ে গেলেন, সাথে সাথে ঢাকায় ফ্লাট কেনা, গাড়ী কেনা। স্মৃতির এর পর থেকে কোন কিছুই চাইতে হয়নি, না চাইতেই সমস্ত প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। স্মৃতি জানেনা কিভাবে বাবা এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন, জানতেও চায়না, সে শুধু জানে ওর বাবা মার খুব কষ্ট। স্মৃতি এখন তিনজনের স্নেহ একা উপভোগ করে। স্মৃতি নামাজ শেষ করে বাবার পাশে এসে বসে, আজ অনেকদিন পর সাইমন চৌধুরী বাসায়, কফিতে চুমুক দিয়ে মেয়ের দিকে তাকান, দৃষ্টি তাঁর ঝাপসা। অবাক হয়না স্মৃতি মলিন কন্ঠে বলে, -বাবা কতদিন পর বিকেলে তেমাকে বাসায় পেয়েছি বলোতো, আর তোমার মন খারাপ, আমি কিন্তু কথা বন্ধ করে দেব। মলিন হাসলেন সাইমন চৌধুরী, -নিরিবিলি বিশ্রামেই আজ মনটা ভেঙ্গে যাচ্ছে মা......... আচ্ছা বলো তুমি কী খাবে? স্মৃতির মা সুফিয়া চৌধুরী রান্নাঘর থেকে নাস্তা নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে রেখে, - ওর কাছে জানতে চাইছো, বলবে কিছুই খাবনা, ম্যাকারণী রান্না করেছি, আর সাথে আনারসের জুস , তুমি আজ ওকে খাইয়ে দাও। সাইমন চৌধুরী আঙ্গুল দিয়ে মেয়ের চুল এলোমেলো করে দিয়ে, - কী শুনছি এসব, খেতে হবেতো মা, না খেলে শরীরও ঠিক থাকবেনা, পড়াশুনাও ঠিকমতো হবেনা, কতো পড়া এখন তোমার। -আচ্ছা বাবা ঠিক আছে খাচ্ছি, খুশি? বাবা মা দুজনের দিকে তাকায় স্মৃতি, দুজনের মুখমন্ডলে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট, ওর মনটাও ভালো হয়ে যায়। বাধ্য শিশুর মতো খেয়ে নেয় আজকের ওরজন্য বরাদ্দকৃত দুটি মেন্যু। খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন সুফিয়া চৌধুরী, রাতে তার ঘুম হয়না বললেই চলে। মৃত ছেলেমেয়ের স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে। তার মনে পড়ে শান্তার (ছোট মেয়ে) কথাগুলো, সে কাঁদছিলো, -মা বই কবে কিনে দেবে? স্যার আজ দুদিন হয় দাঁড় করিয়ে রাখে আর যা নয় তাই বলে অপমান করে, মা আমি বই না নিয়ে স্কুল যাবোনা। সুফিয়া চৌধুরী সেদিন মেয়েটাকে খুব বকেছিলেন, -যার বাবার টাকা থাকেনা তাকে জেদ করা মানায়না, কোন কথা নয়, চুপচাপ স্কুল যাও......... শান্তা আর কিছু বলেনি, তৃতীয়দিন বাবার দিকে ছলোছলে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে স্কুল গিয়েছিলো, ফিরে এসে সবার সাথে দেখা করেছিলো, চাচা,চাচী বন্ধু সবার সাথে। ফিরে এসে ইদুর মারা ঔষধ খেয়ে ছটফট করতে থাকে...... অস্থিরভাবে পায়চারী করেন সুফিয়া চৌধুরী, মনে পড়ে সবুজের(বড় ছেলে) অসহ্য যন্ত্রণার কথা, সেও কাঁদছিলো, -মা ওমা আমি বাঁচতে চাই, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাগো, বাবাকে বলো আমার চিকিৎসা করায় যেন, ওমা আমায় বাচাও.........মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছিলো তার পরপরই। রান্না ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান সুফিয়া চৌধুরী, প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় বুকের ভেতরটায়, আজ গ্রামের শ্যামল ছায়ায় ছেলেমেয়ে দুটি মাটির নিচে ঘুমাচ্ছে, কবরগুলোও বছরে একবারের বেশী দেখা হয়না। ঢাকায় এসেছেন স্মৃতির জন্য, ওর যেন কোনকিছুই অপূর্ণ না থাকে। সুফিয়া চৌধুরীর ভেতরটা গুমরে গুমরে কাঁদে, অষ্পষ্ট স্বরে, -স্মৃতি মা আমার। ছুটে যান মেয়ের ঘরে। স্মৃতি নিজের মতো করে ওর এই শোবার রুমটি সাজিয়েছে, বেডশীট, পর্দা, ফুল সবকিছু নিজের পছন্দমতো কালার দিয়ে সাজিয়েছে, ওর পছন্দের প্রশংসা করে সবাই। সুফিয়া চৌধুরী থমকে দাড়িয়ে যান, মেয়ে তার ঘুমাচ্ছে। অনেক রাত অব্দি পড়াশুনা করেছে, ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে, ডাকা যাবেনা। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে মেয়ের কপালে চলে আসা এলোমেলো চুল গুলোকে সযতনে সরিয়ে দেন, প্রাণ ভরে দেখে নেন মেয়ের মুখটি, মেয়েটা অনেক সুন্দর, তিনি মনে করেন স্মৃতির মতো এতো সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কেউ নাই। আবার তিনি রান্নাঘরে ঢোকেন,নাস্তা বানানোর জন্য। স্মৃতির বাবা খুব ভোরে বেরিয়ে গেছেন তাকে ঢাকার বাইরে যেতে হবে, সুফিয়া চৌধুরী ওসব নিয়ে ভাবেননা, পুরুষ মানুষ বাইরের কাজেই ব্যস্ত থাকবে, ঘরে থাকা তাদের জন্য নয়।  চলবে......

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)