সাহিত্য

বেড়াল ও সিন্ডারেলা

বেড়াল ও সিন্ডারেলা

আমার আধামরা নানী আর কোন উদিশ না পাইয়া সব দোষ দিছিলো সিলিঙটার।

বলছিলো ঐ সিলিঙ মাংসাশী।

মায়ের রুপালী নূপুর পরা পা দুইটার কোন দোষ ছিল না। ধইরা নেয়া ভাল ঐগুলা পা না, পেন্ডুলাম। তারা বাতাসে দুইলা যায়।  

মায়ের নির্দোষ পা দুইটার নাগাল পাওয়ার জন্য আমি হাত তুইলা দিছিলাম আসমান বরাবর। সিমেন্টের মেঝের উপর দাঁড়াইয়া আমি আসলে আমার জান্নাত খুঁইজা নিতে চাইছিলাম।

কারা জানি তখন আমারে ধইরা নিয়া গিয়া কোন পরমাত্মীয়ের বাসায় পাঠায়া দিছিলো। কারা জানি আমারে তখন জানাইছিলো যে রক্তের সম্পর্ক কথা কয়। আমি তাগোরে জানাইতে পারিনাই কত বেশী কথা কয়? নাকি খালি কথাই কয়।   

আমিও নানীর মত সিলিঙের ঘাড়ে দোষ চাপায়া দিলাম। তারপর কইলজার ভেতর আমার মমতাময়ী- স্বার্থপরতামুক্ত মায়ের দেয়া উপহার সিন্ডারেলার পাতলা বইটা চাইপা ধইরা রক্তের সম্পর্কের কইতে থাকা কথা শুইনা যাইতে লাগলাম।

রক্ত সম্পর্কের বাসন মাজতে মাজতে, তাগোর ঘরে বসত করা মাকড়শার জাল ছাড়াইতে ছাড়াইতে, ছাদের কার্নিশে লেপ কাঁথা শুকাইতে শুকাইতে, দুই দিনের ভ্যাঁপসা গরমে ফুইলা ওঠা ভাত খাইতে খাইতেও শুইনা যাইতে লাগলাম। কথা।

শুনতে শুনতে আমার মনের ভেতর সাধাসিধা ফুলের নকশা কাটা গ্রিলের ছোট্ট একটা বারান্দা ভাইসা উঠতে লাগলো। সেই বারান্দায় চেয়ার পাইতা যে রাজারকুমার বইসা আছে তার ছায়াটাই খালি আমি মনে মনে দেখতাম। সেই ছায়া আবার কথা দিয়া দুঃখ ভুলায়া দিতে পারতো। আমার তেল কাইষ্টা সানসিল্ক মিনিপ্যাকের অপেক্ষায় থাকা মাথায় হাত দিয়া আশ্বাস দিত। আমারে সিন্ডারেলা ডাইকা কইতো চিন্তা না নিতে। সে বারান্দায় বইসা আছে। সে অবশ্যই একদিন আমারে মাকড়সার জাল ছিঁড়া বাইর করবে। তারপর আমার হাতের রেখায় বইসা যাওয়া কচুর লতির কষ আস্তে আস্তে হারায়া যাবে।

আমি সময় কইরা আমার পায়ের রূপসা কোম্পানির স্যান্ডেলের দিকে তাকাইতে ভুলতাম না। হাল্কা রঙ জ্বইলা গেলেও ওগুলারে ব্যালেরিনা ভাইবা নিতে আমার কোন অসুবিধা হইতো না।   

তারপর বুড়িগঙ্গার পানি গড়াইতে গড়াইতে আমার মহিলা কলেজের পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ঘনায়া আসলো। রক্ত সম্পর্ক তাও ভাল লতি কুটা থুইয়া সোজা পরীক্ষার কাঠের বেঞ্চে বইসা যাওনের অনুমতি তখনও উঠায়ে নেয় নাই দড়ি ফালায়া।

আমি কাঠের বেঞ্চে বইসা হাইসা দিতাম। সিন্ডারেলা নামের পাতলা ছবিওয়ালা বইয়ের মাইয়াটারে মহিলা কলেজে ভর্তি করার দরকার। পরীক্ষার আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সহ সারা বছর আঁটি আঁটি কষওয়ালা তরিতরকারী, মাছ- মুরগীর সাগরে গলা পর্যন্ত ডুইবা থাইকাও সে অবশ্যই প্রথম স্থান অধিকার করত। আমার মত টাইনা টুইনাও ফেল খাইতো না।

তারপর রক্ত সম্পর্কের সেই তারা দড়িটা ফালায়া দিল। সস্তার লিপিস্টিক আর স্নো পাউডারে আমার আবেদনহীন খোমা ঢাইকা ফেলা হইল। আমি সিন্ডারেলার পাতলা ছবির বই আর আমার নূপুর পরা মায়ের পেন্ডুলামের স্মৃতি রেক্সিনের ব্যাগে ভরলাম। তারপর ফুলের নকশা কাটা বারান্দার দৃশ্য চোখে ভইরা হাতের তালুর চিনচিনা ব্যাথা সহ্য করতে থাকলাম। পাশের বাসার খালাম্মারে মনে হইতেছিল মোটাগাটা পরী।

গলির শেষ কিনারায় সিগারেটের ধোঁয়া ভাইসা আসে। ভাইসা আসে মেয়েছেলে মেয়েছেলে আলাপ। কে অথবা কারা জানি হাইসা মইরা যাইতাছে আসমান জমিন এক কইরা। কই জানি একটা বদখত এতিম বিলাই বইসা আছে পাউডার মাইখা। তারে একটু পরে বাসর রাইতে মাইরা ফেলার আলাপ শোনা যায়। নাইলে বিলাই লাই পায়, চাঙ্গে উঠে- বশে আসেনা। 

বদখত এতিম বিলাইটার দুঃখে সমব্যথী হইয়া আমার আসমান জমিন এক কইরা কাইন্দা মইরা যাওনের কথা মনে উঠার আগে নজর কইরা দেখলাম ঐখানে আর ফুলের নকশা কাটা কোন বারান্দা নাই! নাই তো নাই। এত বছরের দুঃখ বেদনার সাথী ঐ বারান্দা আর তার বিষয় আশয় আমারে ছাইড়া সিলিঙ নিছে। ইহজাগতীক স্বার্থপরতামুক্ত পেন্ডুলামের মত দুইলা যাইতাছে। 

ছায়ার মানুষ আগায়া আসতেছে, খু...ের টানে। সিগারেটের ধোঁয়ায় কি আশ্চর্য আশ্বাস টাশ্বাস সব বাতাসে হারায়া গেছে।

কিচ্ছু শোনা যায়না, কিচ্ছু না।

খালি একটা সিন্ডারেলা হওনের আশায় থাকা জনমদুঃখী বিলাই মারার আলাপ শোনা যায়।    


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)