আল মাহমুদ যে দিনটিকে ঈদ মেনে নিয়েছিলেন, তাঁর অপ্রস্তুত এলোমেলো আলো অন্ধকারের ঘরে, মৃত্যুর ফেরেশতার দেয়া সেই অনিবার্য তাকিদে যেদিন সত্যিই চলে গিয়েছিলেন ওপারে, সেদিন কিছুটা বিমূঢ় হয়েই পড়ছিলাম তাকে। মনে পড়ছিল আমার শৈশবের শীতল পাটি আর দুপুর রোদের ওম।
কোত্থেকে ভেসে এসেছিল ধানক্ষেত পাড়ি দেয়া শস্যের বাতাস আর মোল্লাবাড়ির খামারের গন্ধ। এসেছিল মাহমুদ নামের এক অদ্ভুত কিশোর। তার চোখে আমায় দেখিয়ে দিচ্ছিল আণ্ডা বাইগনের দুটো পাতায় জোড়া দেয়া টুনটুনির বাসার মায়া। কিংবা বেলগাছের শক্ত সন্ধিতে কাত করে পেতে রাখা ফুটো কলসি, দোয়েল যেন নির্বিঘ্নে বাসা বাঁধতে পারে তার সুব্যবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছিল মাহমুদ তাদের মৌড়াইল মহল্লার ভিটের চৌহদ্দিতে। কী এক অস্থিরতায় পেয়ে বসলো আমাকে!
আমার বৈভবের চিন্তামুক্ত কবি পিতা রঙজ্বলা কার্পেটটার ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন শীতল পাটির বুনন। সেখানে ছিল ঢাকনাওয়ালা বেতের ঝুড়ির ওপর কলমদানি কিংবা লেখালেখির অনুষঙ্গ। ছিল জানালার নীচে মহাজনী ক্যাশবাক্স যার ডালা খুললেই দিস্তা দিস্তা শাদা কাগজ। আর তারপর একপাশে আমাদের পুরোনো বুক শেলফ আর দুটো বাঁশের র্যাকে কিছু আর বাকি তিনদিকে কোনরকম আশ্রয় ছাড়াই দাঁড়িয়ে ছিল অগণিত বই। কবিটি তার সারাজীবনের একটু একটু করে সঞ্চিত অসংখ্য বইয়ের মাঝখানে পাটি পেতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেন আর ক্যাশবাক্সকে টেবিল বানিয়ে কেবল লিখতেন আর লিখতেন। ঘরটা ছিল তার যাবতীয় বিলাসীতার কেন্দ্রবিন্দু। আহা! সেখানকার আশ্রয়হীন বইগুলো অথবা কৈশোরের আশ্চর্য বাক্স। সেই দুপুর রোদের জিরিয়ে নেয়া দিনগুলোতে বাক্স খুললেই কত বিচিত্র বিস্ময়!
সে ঘরেই একটা টুনটুনি পাখির টুই টুই ডাক শুনেছিলাম আমি। ক্ষুদে এই পাখির ডাক শুনেই কিন্তু সেই কত বছর আগে ঘুম ভেঙ্গেছিল মাহমুদ নামের ছেলেটার, তাদের মৌড়াইল মহল্লার আটচালা ঢেউটিনের ঘরটায়। আর আমার মাথায় তখন থেকেই গেঁথে আছে গোল লাল নীল আয়না বসানো বাঁশ বেতের সুক্ষ্ম কারুকাজ, মিনে করা রঙ চটে গিয়ে প্রাচীনতার আভাস লাগানো কতগুলো চিত্রকল্প।
বলছিলাম আমার অস্থিরতার কথা। তিনি এপারের আঁধারকে আরও আরও ভাসিয়ে দিয়ে কাঁপতে কাঁপতেই হয়ত চলে গিয়েছিলেন মানুষের অকাট্য গন্তব্যে। মোল্লাবাড়ির শুকানো পাট আর ভেজা শোলার গন্ধে ডুবে যেতে যেতে আবার তৈমুর মোল্লা- জাহানারা দম্পতির বসতভিটার পাখি, প্রজাপতি কিংবা পতঙ্গ ওড়ার শব্দ শুনতে শুনতে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, “যে পারো ভুলিয়ে দাও!”
আমার মুগ্ধতা, আমার ঘোর, ভীষণ প্রথম বিপ্লবের শিহরণ; যে পারো ভুলিয়ে দাও - যে পারো ভুলিয়ে দাও!
আমি কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাইনি কিন্তু “যেভাবে বেড়ে উঠি”র পিয়ারো আমাকে চেনায় সেখানকার প্রাচীন মধ্যযুগীয় এক বাড়ির চৌহদ্দি- তার বাইরের নানারকমের বারান্দা, তিলফুলের ক্ষেতে মৌমাছিদের ঝাঁকের নেমে আসা আর কেয়া বনের গোপনতম রহস্য ভেদ করে যোগাড় করা সুগন্ধি ফুলের উচ্ছ্বাস। সেই সবকিছু যেন চাক্ষুষ দেখেছি আমি; আরও দেখেছি ঘুঘু পাখির চোখের মতন স্বচ্ছ নদী তিতাসের প্রবাহ। যেন নিজ কানে শুনতে পেয়েছি মহরম মাসের শোকগীতি আর জারী গান, এতটাই অভিনব তার চিনিয়ে দেবার ক্ষমতা!
সেই একই ক্ষমতায় কিন্তু আমির মাহমুদ আবার “যে পারো ভুলিয়ে দাও”তে এসে তিতাস নদীর বাসুকী সাপিনীর মত প্যাঁচ দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ে শহরটাকে আগলে রাখার গল্পে ভোলায় পাঠককে। ধান-চাল আর মশলা মরিচের নাও সাথে নিয়ে আশেপাশের কাউতলা কিংবা ভাদুগড়ের কত অচেনা লোকের আনাগোনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়!
সামন্ত স্বভাবের প্রাচীন মুসলিম জোতদারদের বংশধর এবং “যে পারো ভুলিয়ে দাও” এর প্রেক্ষাপটকালীন মোল্লাবাড়ির প্রধান বাদশা মোল্লা। জমিদার এবং চতুর ব্যবসায়ী বাদশা মোল্লার লোবানের ঘ্রাণের নীচে চাপা দিয়ে রাখা হলদেটে মৃত্যু দৃশ্যের মাধ্যমে তার নাতি পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মাহমুদ আমার মত লক্ষ লক্ষ পাঠককে প্রভাবশালী ব্যক্তির মরণোত্তর বাস্তবতা এবং বড়বাড়ির সম্পর্কের টানাপড়েনের ভেতর বিলীন হয়ে যাবার পথটাও সেভাবে তার মত করেই চিনিয়ে দেয়।
পাঠক অথবা পথিক হেঁটে যেতে যেতে আবিষ্কার করে সে সময়ের বাঙালি মুসলিম বনেদী পরিবারের হালচাল, প্র্রোটেস্ট্যান্ট মিশনারিতে বড় হতে থাকা অনাথ ক্যাথলিকের যিশুর সেবিকা হবার স্বপ্নালু চোখ, ঘোষপাড়ার মেয়ে কৃষ্ণার গোমড়ামুখো অভিমানের যথার্থ কারণ। পাঠক আরও দেখতে পায় ধনীলোকদের সম্পর্কের দেয়াল তোলা, সমূহ ষড়যন্ত্র, মুখোশের আড়াল আরও কত কুটতর্ক! আবার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাওয়া মানুষের অবিরাম সংগ্রাম শিখে নেয়া যায় এখান থেকে। শিখে নেয়া যায় শতেক ভুল বোঝাবুঝির পরেও ভারী যতন করে আগলে রাখার উপায় উপকরণ।
তালেবেএলেম আব্দুল আলিমের আযানের ডাকে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছি কখনো, কখনো মারিয়া কুকারের পাতে রুই মাছের বাসী তরকারি জুটলো কিনা সে ভাবনায় মগ্ন হয়েছি, উৎকণ্ঠায় ডুবে গিয়েছি ফাদার জোন্সের হাতে থাকা প্রোগ্রেস রিপোর্টের ফাইলের খবর পেয়ে। আমির মাহমুদের পানিতে ঝাপসা চোখে নিজের ছায়া খুঁজে বেরিয়েছি কখনো।
“যে পারো ভুলিয়ে দাও” এর ঘোর থেকে তখনো বের হতে পারিনি। এক দুপুরে আমার কবি পিতার নিমন্ত্রণে আমাদের শেখেরটেক আট এর বাড়িতে এলেন সে যাদুকর। আমি দূর থেকে এবং আড়াল থেকে দেখেছি তাঁকে। তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার নিমিত্তে বার কয়েক ডাক শুনেছি, এড়িয়ে গিয়েছি এবং পালিয়েছি পাশের পাড়ায়। এরপরে আরও বহুবার সেই শব্দের যাদুকরের বক্তব্য আমি শুনেছি, দেখেছি তাঁকে সাহিত্য আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকতে, জরায় বিধ্বস্ত মানুষটাকে কেঁদে উঠতে দেখেছি আমার স্বপ্নচারী বটবৃক্ষের প্রস্থানজনিত শোকসভায়। তবে আগের মতই বহুদূর থেকে, কাছে গিয়ে আলাপ করিনি কখনো।
পিয়ারো অথবা আমির মাহমুদ নামের সেই কিশোর ছেলেটাকে যেভাবে চিনেছিলাম শৈশবে, মনে হয়েছে সেই অস্তিত্বগুলো হয়ত ফিকে হয়ে আসবে পরিণত মাহমুদের সাথে সরাসরি কথোপকথনে। তোলা রইলো সেই পথ চিনে নেয়া, তোলা রইলো শীতের ধানক্ষেতের সমস্ত পাকা ধানের ঢেউ আর দোয়েলপাখির শিস।
আজকাল আমি ভীষণ মগ্ন হয়ে তাঁর নির্ঝর সমুদ্র পাখি পর্বত প্রকৃতির কাছে প্রতিবার যাওয়া দেখি। সেখানে অর্থহীনতার এক সুন্দর আওয়াজ থেকে কারো নির্ভার হাত সরানো অনুভব করতে উদ্বুদ্ধ হই তাঁর মত। তাঁর একান্ত “সত্যের আঙুল” এ তিনি তো চাইলেনই নিস্তরঙ্গ এবং নিঃসীম ভাবনায় ফেলে দিতে! কোন দ্বিধা না রেখে জানালেন,
চিহ্নহীন চকিতে মিলায়
আলোকিত করাঙ্গুল কার?
ধাবমান ধ্বনির ধৈবতে
নিঃসঙ্গ খুঁজতে থাকি বাহু তাঁর— অঙ্গুলি তাঁহার।’
আমার আর কীইবা করার ছিল!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)