পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

গল্প হলেও সত্যি (পর্ব-৩)

গল্প হলেও সত্যি (পর্ব-৩)

বিজ্ঞানী নিউটনের জীবনে আপেল যেমন একটা স্মরণীয় ফল। আমার জীবনেও আপেল একটা স্মরণীয় ফল, তবে সেটা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির গুণে নয়, ওই মধ্য বয়সী মহিলাটির ব্যবহারের গুণে। ভদ্রলোক সেইদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আপেল নিয়ে আসলেন। সবসময়ের মতো মায়ের হাতেই ফলের প্যাকেটটি দিলেন। সোফার উপর প্যাকেটটি রেখে, মা পাশের রুমে গেলেন মোবাইলের ডাকে সারা দিতে। আপেলের প্যাকেট মহাশয় সোফার ঢালটি-কে স্লিপার ভেবে মনের আনন্দে স্লিপ কেটে নিচে পড়ে গেলেন। সাতদিন পর, বুয়াকে দিয়ে সোফার নিচ পরিষ্কার করতে গিয়ে উদ্ধার করলাম, শুঁকনো চামড়া কুঁচকানো বৃদ্ধ-বেশী আপেল। গলা নিচু করে মুখ বাঁকিয়ে বলেই ফেললাম, ‘নিজেও খায় না, কাউকে দেয়ও না, খামোখাই আপেল গুলো নষ্ট করলো’।

ছেলেকে ডেকে গম্ভীর স্বরে মা যখন বললেন, ‘অখন থাইকা হাতে কইরা কিসু আনলে বউয়ের হাতে দিবি, আমার হাতে না’। শুনে হাত পা হিম হয়ে গেলো, বুঝতে আর বাকি থাকল না, আমার কথা শাশুড়ি মা শুনে ফেলেছেন। কেমন একটা থমথমে অবস্থা!!! মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে, বাবা ফোন দিয়ে জানালেন তিনি কাল আমাদের বাসায় আসবেন। ভয়ে, আমার হিম শরীর আরও হিম হয়ে গেলো। বাবা যদি কোন ভাবে জেনে যান আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে আমার আচরণের কথা...... তাইলে আমি শেষ!!!

বাবা আসলেন, শাশুড়ি মা রীতিমতো আমার স্বামীর ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছেন। ‘ওই, বিয়াই রে শরবত দে’, ‘বিয়াইরে সব বাইরা খাওয়াইসস তো?’, ‘রুমের এ সি-ডা সাইরা দে না, বিয়াই একটু জিরাক’, ‘শ্বশুরের পা টিপা দে’.........


বাবা চলে যাবার সাথে সাথে, চোখ ফেটে কান্না আসলো। দৌড়ে গিয়ে শাশুড়ি মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লাম। মা অস্থির হয়ে বললেন, ‘কি হইসে বউমা, বাবা চইলা গেসে দেইখা খারাপ লাগতাসে?’
হাউ মাউ করে কেঁদে একটা কথাই বার বার বললাম, ‘মা আমাকে মাফ করে দেন।‘বাবা চলে যাবার জন্য এক বিন্দু কষ্টও আমি পাইনি, নিজেকে ছোট থেকে ছোট মনে হচ্ছিলো। আমার প্রতি এক বিন্দু রাগ ঝাল না খাঁটিয়ে, এই ভদ্রমহিলা নিজের ছেলেকে খাটিয়ে মেরেছেন আমার বাবার সেবায়। মায়ের সাথে সেই আচরণের জন্য আমি আজও নিজেকে মাফ করতে পারিনি।

সময় গড়ালো, নতুন বউ থেকে ধীরে ধীরে হয়ে গেলাম পুরনো বউ। সময় আমাকে পুরনো করে দিলেও, শাশুড়ি মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা, আদর নতুনের মতোই চকচকে রয়ে গেলো। ওই যে বলেছিলাম, ঝক্কিটাও তাকে কম পোহাতে হয়নি। ননদের সাথে দেবররাও যুক্ত হলো। ওরা যখন দফায় দফায় দায়িত্বের বুলি কপচিয়ে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিত, আমার শাশুড়ি মা পক্ষী-মাতার মতো আমাকে আড়াল করতেন। আমার ননদ একদিন মন্তব্য করেই বসলো, ‘আমার চাইতে তুমি ভাবীকে বেশী ভালোবাসো’। এই সব কিছু ছাপিয়ে মা শক্ত ভাবে বলতেন, ‘ও এই বাড়ির বড় বউ, তোরা সবসময় তারে সম্মান করবি, তারে কতডা কি কইতে হইব সেইডা আমি কমু, তরা না’। শাসন কি তিনি করেননি? করেছেন, ঘর ভর্তি মানুষের সামনে অপমান অপদস্থ করে নয়, ভ্রূ মুখ এক করে টিপ্পুনি কেটে নয়, ঘরে ডেকে, হাতে হাত রেখে বুঝিয়ে বলে।

বেসাইজ করে কাঁটা সবজী, বেসাইজ রুটি, পোড়া তরকারি, আমার সব প্রকারের অকাজগুলোকে সহ্য করেছেন হাসিমুখে। মাকে দেখতাম, আর দোয়া করতাম, আল্লাহ্ যেন আমাকে ছেলের মা না করেন, পরের মেয়েকে এত আদর দিয়ে আপন করে নেওয়ার মতো ধৈর্য কি আমার হবে? ভালো শাশুড়ি হওয়াও কিন্তু কম কষ্টের নয়।

 

চলবে.........

প্রথম পর্বঃ https://bit.ly/30g6I90

দ্বিতীয় পর্বঃ https://bit.ly/2L0Souy


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

১৩ ডিসেম্বার ২০২৩