অনির্ধারিত

রূপকথা নাকি বাস্তবতা?

রূপকথা নাকি বাস্তবতা?

আমার বুক শেল্ফের একটি তাক বহু আগেই আমার কন্যাদ্বয় দখল করেছে তাঁদের অঢেল বই গুছিয়ে রাখার জন্য। তাঁদের এতো বইয়ের ভিড়ে রূপকথার গল্পের বই খুঁজে পাওয়া বেশ একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার। কারণ আজ অব্ধি আমার সন্তানদের আমি কোন রূপকথার গল্পের বই কিনে দেইনি। এবং এই সিদ্ধান্ত টা নিয়েছিলাম খুব চিন্তা ভাবনা করেই। রূপকথার গল্প বলতে আমি বোঝাচ্ছি, খুব টিপিকাল একটা স্টোরি প্লট, সুন্দরী একটা রাজকন্যা থাকবে, সে একটা বিপদে পড়বে, তারপর একটা রাজপুত্র তাকে উদ্ধার করবে।

শিশুদের হাতে সাধারণত আমারা যেই রূপকথার গল্পের বই গুলো তুলে দেই, তার প্রত্যেকটি যদি আপনি গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলেই বুঝবেন এই গল্পগুলো আমাদের সন্তানদের আসলে কি শিক্ষা দিচ্ছে !!!

যেমন ধরুন সিন্ড্রেলাঃ সৎ মা এবং বোনেরা তাকে হিংসা করে, যার মূল কারণ সিন্ড্রেলা অনেক সুন্দরী। এবং এই হিংসার ফলশ্রুতিতে সিন্ড্রেলার সৎ মা তাকে ঘরের সব কাজ করায়। এই সমস্ত চিন্তা করে আমার মনে হয়েছে, আমি আমার সন্তানদের তাঁদের বয়স অনুযায়ী ঘরের যেই কাজ গুলো করাই, দুই দিন পর আমার সন্তান হয়তো আমাকেই ভাববে সৎ মা!!! কারণ, রূপ, রূপ থেকে হিংসা, হিংসা থেকে ঘরের সব কাজ করানোর এতো গভীর তত্ত্ব, এই ছোট্ট মাথাগুলো হয়তো সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারবে না……

আমি আরও তাজ্জব হয়ে যাই যখন ‘স্নো ওয়াইট’ গল্পটার কথা ভাবি। ‘স্নো ওয়াইট’ নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখানে ‘গায়ের রঙ’ অনেক বড় একটা ফ্যাক্টর। আমার কাছে মনে হয়েছে এই গল্পটার মূল থিম-ই হচ্ছে রূপ সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা। তাই আয়না কে রানী প্রতিদিন জিজ্ঞাস করে, ‘বলতো আয়না কে বেশী সুন্দরী?’। এই রূপের প্রতিযোগিতায় রানী স্নো ওয়াইট কে প্রথমবার হ...য় ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিষ মাখানো আপেল খাওয়ায়!!! রীতিমতো একটা ক্রাইম পেট্রোল জাতিয় কন্টেন্ট!!! আর, গায়ের রং, রূপের প্রতিযোগিতা এই ধরণের গল্প গুলো দিয়ে আমারা আমাদের শিশুদের মনোজগতে আসলে কি ঢুকিয়ে দিচ্ছি???

প্রায় প্রতিটা রূপকথার গল্পের শেষটা হচ্ছে রাজপুত্র নায়িকাকে উদ্ধার করে, অতএব, নায়িকা একজন নারী, তার নিজেকে উদ্ধার করার মতো যোগ্যতা তার নাই, তাই সে চিরজীবন অপেক্ষা করে কবে তাকে উদ্ধার করতে একজন রাজপুত্র আসবে।

হেন্সেল অ্যান্ড গ্রিটলের সৎ মা তাঁদের বাবাকে রাজি করায় তাঁদের বনে ফেলে দিয়ে আসতে…… একজন বাবা কীভাবে রাজি হন তার সন্তানকে বনে ফেলে দিয়ে আসতে। আবার অন্য দিকে রাপানযিলের মায়ের এতই বাঁধাকপি খেতে ইচ্ছা করে যে সেও রাজি হয়ে যায় তার সন্তানটিকে ডাইনির হাতে তুলে দিতে!!!

লিটল মারমেইড বা আলাদীনের জেসমিনের পোশাকটি কি আসলেই শিশুসুলভ? দেহের আঁকার, পোশাক এবং সৌন্দর্যে সবার আগে যার নাম বলা উচিত সে হচ্ছে ‘বারবি’। আমার চোখে দেখা বেশ কিছু শিশু এতো পরিমাণ বারবি obsessed যে, এই ছোট্ট শিশু গুলোও ডিপ্রেশনে ভোগে, কেন তারা বারবির মতো এতো সন্দর না বা প্রতিনিয়ত বারবির মতো হবার চেষ্টা করে। সুন্দরের স্ট্যান্ডার্ড টা আমারা আমাদের শিশুদের মনে কোন লেভেল-এ সেট করে দিচ্ছি, যা কিনা পৃথিবীতেই বিদ্যমান নেই।

একবার, এক বাসায় গিয়ে দেখলাম ওই বাসার শিশুটির জন্য একটা বারবি ড্রেসিং টেবিল কিনে দেওয়া হয়েছে, কর্তব্যরত গৃহকর্মীর কাছে জানতে পারলাম, এই শিশুটি এখন সারাদিন এই ড্রেসিং টেবিলেই বসে থাকে, পড়ার টেবিলে আর বসতে চায় না। শুনে খুব করুণা হলো, কোথায় অভিভাবকেরা সন্তানের হাতে তুলে দিবে বয়স অনুযায়ী রংবেরঙের শিক্ষণীয় খেলনা আর বই। ওদের বিস্ময় জাগে, ওরা গড়তে শিখে, ওরা চিন্তাশীল হয়, ওরা আচরণ শিখে, ওরা সহানুভূতি শিখে এমন সব উপাদান গুলো কি আমরা দিচ্ছি? বেশীর ভাগ অভিভাবকেরা যতটা না শিশুর মনের সৌন্দর্য গড়ার ক্ষেত্রে জোড় দেন তার চেয়ে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি বেশী জোড় দেন বা এমন সব উপাদান দেন যেটা শিশুকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি বেশী আকৃষ্ট করে, যা কি না কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে অধিক চর্চিত।

আমাদের সন্তানেরা যেন দেখতে সুন্দর মানুষ নয় বরং সুন্দর মনের মানুষ হয়ে গড়ে উঠে। ভবিষ্যতে যেন কেউ তাঁদের বলতে না পারে ‘উপর দিয়া ফিটফাট ভীতর দিয়া সদরঘাট’!!!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)