উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

স্বপ্নভঙ্গ ( প্রয়াত সহপাঠী শায়েলা উম্মে রাহির স্মরণে)

স্বপ্নভঙ্গ ( প্রয়াত সহপাঠী শায়েলা উম্মে রাহির স্মরণে)

জানালার গ্রীল ধরে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিতে তাঁকিয়ে আছে শায়েলা। শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশে শুভ্র মেঘের কারুকাজময় খেলা দেখেও মন ভালো হচ্ছে না। অথচ শরতের এই আকাশটা ওর অনেক প্রিয়। হঠাৎ শায়েলার চোখ যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছের ডালে, একটা মা শালিক তার ছানার মুখে পরম যত্নে খাবার তুলে দিচ্ছে। সন্তানের প্রতি মায়ের কতই না ভালোবাসা। ভাবতেই দু'ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে চোখ দিয়ে। আনমনা হয়ে পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে যায়...   

মা ও তাকে এভাবে খাবার তুলে খাইয়ে দিতো। পরিবারের আদরের ছোট মেয়ে শায়েলা। বাবা-মা, ভাইয়া-আপুর অনেক স্বপ্ন ছিলো ওকে নিয়ে। একদিন অনেক বড় হয়ে তাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। শায়েলা ভালো আর্ট জানত। ওর ইচ্ছে ছিলো সমাজসেবার পাশাপাশি আর্ট নিয়ে বড় কিছু করা। কিন্তু ইচ্ছের গুড়েবালি পড়ে যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল দিয়ে সবে চতুর্থ বর্ষের ক্লাশ শুরু করলো। একদিন চাঁদপুর সদর থেকে একটা প্রপোজাল আসে। ছেলে তিন বোনের একভাই, ঢাকায় ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে। শহরে তাদের চারতলা বাড়ি। শায়েলাকে দেখে ছেলের খুব পছন্দ হয়, কিন্তু ছেলেকে তার পরিবারের কারো পছন্দ হয়নি! যার কারণে প্রপোজালটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও ছেলের পক্ষ থেকে বারবার জোর করা হয়। এই দিকে শায়েলার আত্মীয়-স্বজনের বুদ্ধি, পরামর্শ এবং সাথে প্রতিবেশীদের  ইনসাল্ট তো আছেই! -এমন ভালা সম্বন্ধ, শহরে পোলাগো চাইরতলা বাড়ি, একমাত্র পোলা, এতো সব পাইবো কই! চেহারা দিয়া কি ধুইয়া খাইবো নি! ছেলে পক্ষের পীড়াপীড়ি এবং আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শ মোতাবেক রাজি হয় শায়েলার পরিবার। তারপর বেশ তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হয়ে যায়।

মানুষের সাথে বসবাস ও চলাফেরা না করলে তার ভিতরগত অবস্থা কোনভাবেই জানা যায় না। শ্বশুরবাড়ি এসে বিষয়টা হাড়েহাড়ে টের পায় শায়েলা। অথচ বিয়ের আগে এ বাসার মানুষগুলোর ভালো মানুষীর সার্টিফিকেট কতজন-ইনা দিয়েছিলো! বিয়ের কয়েকদিন যেতে না যেতেই শাশুড়ি তাকে বিভিন্নভাবে খোটা দেওয়া শুরু করে। -আমার একমাত্র ছেলে, এতো বড় বাড়ি; আমি কিনা কোথায় কোন ফকিরদের কাছে গিয়ে পড়লাম! একদিন ও সোফায় বসতে গেলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়! এগুলো তোর বাপ দেয়নি! কি দিয়েছে তোর বাপ? তোকেও তো কিছু দেয়নি। ছোটলোক! ফকির! মাঝে মাঝে শায়েলার স্বামী মামুনও সায় দেয় মায়ের সাথে। ও নিরবে সব শুনে যায়। তারপর রুমে এসে মুখে বালিশচাপা দিয়ে কাঁদে। অসুস্থ মা, বৃদ্ধ বাবা এবং ভাইয়া-আপু শ্বশুরবাড়ির কষ্টের কথা শুনলে সহ্য করতে পারবে না। বান্ধুবীদের কাছেও কিছু শেয়ার করতে পারেনা। ফোনে কারো সাথে কথা বলতে গেলে শাশুড়ি পাশে দাঁড়িয়ে থাকে! এর মাঝে শায়েলা একদিন বাবার বাড়ি থেকে কানে দুল আর হাতে বালা পড়ে আসে। ক'দিন পর কুরবানির ঈদ উপলক্ষে বড় একটা ছাগল পাঠানো হয় বাবার বাড়ি থেকে। তখন কিছুটা মুখ বন্ধ হয় শাশুড়ির।

বিয়ের একমাস পর শায়েলার এক ননদ আসে জার্মান থেকে। সে তার পরিবারের সাথে পরামর্শ করে  সিদ্ধান্ত নেয়, ভাই মামুনকে জার্মান নিয়ে ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিবে। । খরচসহ দশ লাখ টাকা শায়েলার বাবার বাড়ি থেকে এনে দিতে বলা হয়।! কিন্তু এতোগুলো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য ওর পরিবারের নেই। তাই  চুপ থাকে। এ বাড়িতে তার প্রিয় সঙ্গী জানালা দিয়ে দেখা ছোট্ট আকাশটার দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলে আর নিজের পরিনতির কথা ভাবে। এদিকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য ওর প্রতি চাপ বাড়তে থাকে। প্রতিদিনই তাড়া দেওয়া হয়। টাকা হাতে আসলে পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা, আরো অনেক কাজ শায়েলা সিদ্ধান্ত নেয়, সে বলবে তার অপারগতার কথা। এরপরও না বুঝতে চাইলে প্রতিবাদ করবে।

হঠাৎ একদিন রাত নয়টার সময় রাস্তার উপর ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পায় রাস্তার পাশের দোকানে বসে থাকা লোকজন। লোকগুলো আওয়াজের উৎস খুঁজতে এসে মামুনদের বাড়ির সামনে রাস্তার উপর একটা নিথর নারী দেহ পড়ে থাকতে দেখে। সেই নারী দেহ আর অন্য কারো নয়; নববধূ শায়েলার। যার বিয়ের বয়স হয়েছিলো মাত্র একমাস তেরো দিন! একমাস তেরো দিনের মাথায় তাকে লাশ হতে হয় যৌতুকের জন্য। শায়েলার গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো কিন্তু তা হয়নি। জীবনপ্রদীপ নিভে গেলেও গল্পটা এখনো চলমান রয়ে গেছে! আদৌ শেষ হবে কিনা কে জানে!

সেদিন রাতেই দোষীরা সব পালিয়ে যায়। শায়েলার বাবা শ্বশুরবাড়ির সবার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পুলিশ মামুনদের ঘর তল্লাশি করতে এসে রক্তমাখা  টিস্যু, রক্তমাখা কাপড়ের টুকরো, রক্তমাখা তোষক, ওয়ালে রক্ত, সিঁড়িতে, ছাদে রক্তের লম্বা দাগ আলামত হিসেবে পায়। খু...িরা কয়েকজন ধরা পড়ে। ননদ ও তার স্বামী জার্মান পালিয়ে যায়। আরো ভয়াবহ তথ্য জানা যায়, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এর (পিবিঅাই) তদন্ত রিপোর্টে। পিবিআই এর তদন্তের চার্জ শীট অনুযায়ী মামুন,তার বাবা-মা এবং বোন মিলে শায়েলাকে নিমর্ম ভাবে হ... করে। ওর তলপেটে ভারি বস্তু দিয়ে অাঘাত করে, যার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণে ওর মৃত্যু হয়কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এতো কিছু প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও দোষীদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং একদিন করে রিমান্ডের জন্য শায়েলার পরিবারকে মোটা অংকের টাকা গুণতে হয়! তারপরও মামলার প্রধান আসামী ও মূল হোতা মামুনকে ছাড়া বাকীদের জামিন দেওয়া হয়। তিনমাসপর তাকেও এক অদৃশ্য শক্তির বলে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়! টাকার কাছে হেরে যায় একটা তাজা প্রাণ! জানা যায়, মামুন আসলে কোন চাকরি করতো না। সে ছিলো পরকীয়া এবং মাদকে আসক্ত। শোকাহত পরিবার এখনও ন্যায়বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছে। অপরাধীরা তাদের প্রাপ্ত সাজা পাক এই তাদের কামনা।

শায়েলার বান্ধবীদের পঞ্চকন্যার ঝুটি ভেঙে গেছে। বাকী চারজনের আড্ডায় এখন আর প্রাণ থাকেনা। কেননা আড্ডার প্রাণ ছিলো হাসিখুশি এই মেয়েটি। শায়েলার স্মৃতি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে তার পরিচিতজনদের কাছ থেকে। বান্ধবীদের কাছেও ওর স্মৃতি ধূসর হয়ে গেছে। পরিবার ছাড়া একসময় সবাই-ই শায়েলা নামের মেয়েটিকে ভুলে যাবে। এভাবে আর কত ফুলের মত জীবন অকালে ঝরে যাবে? সম্ভাবনাময় প্রতিভার অধিকারী শায়েলারা তো এমন পৃথিবী চায়নি। ওরা চেয়েছিলো পৃথিবীকে কিছু দিতে। কিন্তু যৌতুক নামের এক রাক্ষসী এভাবেই শত শায়েলার জীবনকে খুবলে খাচ্ছে অহরহ।  শায়েলা তো স্বপ্ন দেখতো এই সমাজকে বদলে দেওয়ার। কলুষিত সমাজকে নতুন করে বিনির্মাণ করার। তার স্বপ্ন কি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো? নাকি আমরাও হেরে যাবো?

বিঃদ্রঃ ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ