ব্যাপারটা কিন্তু শুধু মা দিবস না। দিবস মনে রাখা অথবা জন্মদিন, এই ক্ষেত্রে আমার মেমোরি পাওয়ার একেবারে শূন্য। সে যাকগে…… মা দিবস কেন, কি, অথবা কি করণীয় তারও এত ইতিহাস জানিনা। আমি শুধু দেখি, প্রতিনিয়ত নিজের ইচ্ছা, ভালো লাগা, অবসর, কত কত আনন্দের মুহূর্তগুলোকে সেই কবে শিকেয় তুলে রাখা মানুষটাকে। সবটা না হলেও কিছুটা কি মিলাতে পারছেন, আমাদের প্রতিদিনকার জীবনকে এত সুন্দর করে গড়ে তোলার, নেপথ্যের মানুষটাকে?
রাত জেগে কাজ করা আমার অনেক দিনের স্বভাব, রাত দুইটার সময় যখন মা কাছে বসে বলেন, 'আমি না আরও আগে ঘুমাতে যেতাম, তোর জন্য বসে আছি।’
ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলি, ‘আচ্ছা, তুমি কেন বসে আছ, আমার কাজ আছে তাই জেগে আছি, তুমি এখনও কেন ঘুমাও নাই।’
মা বলেন, ‘তুই একা একা জাগবি, তাই………’
সেই ‘তাই’ টা আর শোনা হয়না, কিন্তু বুঝি, সেই ‘তাই’ টা হচ্ছে, অনেক আদরে ভরা একটা ভালোবাসা, যেটা একজনের কাছ থেকেই পাওয়া যায়।
এই প্রজন্মের অনেক মায়েদের কাছে বাচ্চাদের এলোমেলো ভাবে অক্ষর জ্ঞান দেওয়া যেমন নতুন বিষয়, আমার কাছে এটা খুবই পুরানো বিষয়, কারণ মা আমাকে অক্ষর জ্ঞান দিয়েছেন এই নিয়মে। প্রতিটা অক্ষরের পিছনে ছিলো একেকটা গল্প।
আমি যখন আমার বাচ্চাদের একই গল্প শুনিয়ে পড়াই, অনেকেই জিজ্ঞাস করেন, ‘বাহ, এভাবে তো খুব ভাল কাজ হয়, কীভাবে শিখলেন?’
উত্তর একটাই, ‘আম্মু ছোটবেলায় এভাবে পড়াতো।’
তাছাড়া, ‘চকোলেট চিবিয়ে খাবে না, তালুতে লাগিয়ে চুষে খাবে’, ‘শাড়ীতে যেই রংটা সবচেয় কম, সেই রঙের টিপ পরতে হয়’, ‘ ভাত নষ্ট করলে, ভাতরা আল্লাহ্র কাছে যেয়ে নালিশ দিবে’, ‘ জুতা খুলে এখানে গুছিয়ে রাখতে হয়’, ‘ঘুমানোর আগে ব্রাশ করে, হাত মুখ ধুয়ে, চুল আচড়ে তার পর ঘুমাতে হয়’......... আরও অসংখ্য।
তৎকালীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বসনিয়ান শিশুদের গল্প শুনতাম মায়ের মুখ থেকেই, যেমনটা আমি বাচ্চাদের সিরিয়ান শিশুদের গল্প শোনাই।
মাছ কুটা, দা দিয়ে নারিকেল ছিলা, মাটির চুলায় রান্না করা, কোন কিছু শিখতে কখন বাঁধা দেয়নি, বরং হাতে ধরে ধরে সব শিখিয়েছে। শেখানোর কারন কিন্তু ‘আমি মেয়ে মানুষ’ তাই আমাকে ঘরের কাজে পটু হতে হবে তা নয়, আমি মানুষ তাই আমাকে সব শিখতে হবে, যেন কোথাও না ঠেকি।
আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, কিন্তু স্বপ্নেও কখনো ভাবতে শিখিনি ‘আমি অনেক পেম্পারড’ কারণ একটাই, সকলের মত সংগ্রাম করে বাঁচতে শিখতে হবে।
ব্যক্তি স্বাধীনতার অর্থ শিখেছি মায়ের কাছ থেকে, তাই সিদ্ধান্ত কখন চাপিয়ে দেননি, বরং সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছেন। এই অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই, কখনো চিন্তা করিনি, সুযোগের অপব্যবহার করব।
আমার বেড়ে ওঠা ছিলোও এমন একটা জায়গায় যেখানে মানুষ শুদ্ধ করে কথা বলতে জানতোনা, কিন্তু আমি শিখেছিলাম সঠিক উচ্চারণে শুদ্ধ কথা, সেটাও এই মানুষটাই শিখিয়েছিলেন।
এখনও একসাথে কোথাও গেলে, ফিস ফিস গল্পে দুজনেই হেসে কুটি কুটি হই, দূর থেকে দেখে অনেকেই বলেন, ‘মা মেয়ে, নাকি বান্ধবী?’
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)