সাহিত্য

স্বাধীনতা

স্বাধীনতা

আমাদের সামনের ভবনের ৩ তলার একটা বাসায় একটি পাখির খাঁচা আছে। ওতে কয়েকটা মুনিয়া পাখি সারাদিন চিউচিউ করে। খাঁচাটি বেলকনির এক কোণায় বসানো, থাই গ্লাস সরালেই সূর্যালোক মুনিয়াদের গা ছুয়ে যায়, তারা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরের জগতটা দেখে। মাঝে মাঝে দেখি দুএকটা চড়ুই ওই গ্রিলের উপর গিয়ে বসে, খাঁচা বন্দী মুনিয়াদের সাথে কিচির মিচির করে আড্ডা দেয়। আমি ভাবতে থাকি তাদের মধ্যে কি কথা হয়, তারা কি একে অন্যের ভাষা বোঝে? হয়তো বোঝে।

মনে হয় চড়ুই মুনিয়াকে বলছেঃ আসসালামুআলাইকুম, কেমন আছো? খেয়ে দেয়ে তো দেখছি অনেক মোটা হয়ে গেছো! তো আজ কি নাশতা করলে?

মুনিয়া জবাব দেয়ঃ ওয়ালাইকুমআসসালাম, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, অনেক ভালো আছি। মোটা তো হবই! সারাদিন শুধু খাই আর ডাকি, একটু যে উড়বো ডানা মেলে, দৌরাবো পা ছেড়ে তার কি উপায় আছে? আর নাস্তার কথা কি বলবো, প্রতিদিন যা খাই তা ই। বাড়ির কর্তা প্রত্যাহ সকালে গম চালের গুড়ো দেয়। তবে বাড়ির বাচ্চাগুলো মাঝে মাঝে ডিম, রুটি, কলা, ফলের টুকরো, জুস আরও কত কি দেয়, বলে শেষ করা যাবে না। তা তোমরা কি খেলে?

চড়ুইঃ তোমার কথা শুনে তো লোভ লাগছে আমার! দাওয়াত নিলাম একদিন নাস্তার। আমরা আজ খুব ভোরে উঠেছি, বাচ্চারা তখনও ঘুমে। উঠেই দুরের এক শিশিরভেজা মাঠে গেলাম, খানিক রোদ পোহালাম, ফড়িং আর কেঁচো দিয়ে নাস্তা সারলাম। এরপর খাাবার নিয়ে বাসায় এসে পোনাপুনিদের খাইয়ে দাইয়ে এখন একটু ঘুরতে বের হলাম।

মুনিয়াঃ ইশশ! শেষ কবে যে ফড়িং খেয়েছি মনেই নেই। আমাকে একটা এনে দিবে বোন?

চড়ুইঃ নিশ্চই! তুমি ফড়িং পছন্দ করো জানতাম ই তো না, এবার মাঠে গেলে নিয়ে আসবো।

মুনিয়াঃ শুনে খুশি হলাম। আচ্ছা, তোমার বাচ্চাদের কি নাম রেখেছো বললে না তো।

চড়ুইঃ একটার নাম চু, সারাদিন চুচু করে। আরেকটার নাম চি, সারাদিন শুধু চিচি করে। দেখতে যা মিষ্টি, তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম।

মুনিয়াঃ দেখবো দেখবো, যেদিন তারা উড়তে শিখবে, সেদিন প্রথমেই কিন্তু এই খালার ঘরে তাদের নিয়ে আসবে, আমি তাদের এমন মিষ্টি খাওয়াবো যা তারা কোনোদিনও খায় নি।

চড়ুইঃ আনবো না কেনো?। আচ্ছা বোন, তোমার ছেলে-পুলে কবে হবে বলো তো?

মুনিয়াঃ আমার! কি যে বলো, এই খাঁচায় যে বেঁচে আছি এটাই তো বড় ব্যাপার। এই কারাগারে নতুন বাসিন্দা আনতে চাই না।

চড়ুইঃ (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) বুঝি বোন। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। দুঃখ করো না, এই জীবনটাতো অল্প কদিনের।

মুনিয়াঃ ঠিক, এই জন্যই তো সব কষ্ট হাসি মুখে মেনে নি। আচ্ছা চড়ুই, বলো দেখি, কেউ কি আরামদায়ক ঘর, পুষ্টিকর খাবারের লোভে এই খাঁচার জীবন বেছে নিবে?

চড়ুইঃ নাহ! প্রশ্নই উঠে না। স্বাধীনতার সম্মান আর পরাধীনতার দুঃখ যে জানে সে কখনও এমন জীবন বেছে নিতে পারে না।

মুনিয়াঃ ঠিক তাই। কিন্তু দেখো, কত মানুষ এমনটাই করে; তারা অর্থ-বিত্তের বিনিময়ে নিজের স্বাধীনতাকে বিক্রি করে দেয়।

চড়ুইঃ হ্যা, সত্যি, তারা ভাবে নিজ কামনা-বাসনা ইচ্ছামতন পূরন করতে পারাটাই বুঝি স্বাধীনতা। কিন্তু সত্যিকারের স্বাধীনতা হলো নির্ভয়ে সুন্দরের পথে চলতে পারা, সত্যের ডানায় ভর করে নীল আকাশে উড়তে পারা।

মুনিয়াঃ একজন বলেছিলো, “খাঁচায় জন্মানো পাখিরা ডানা মেলে উড়াকে অসুস্থতা মনে করে”। তেমনি আজন্ম পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকা মানুষগুলো মানসিকভাবে দাসত্ব বরন করে নিয়েছে, তাই তাদের কাছে পরাধীনতা অসম্মানের বলে মনে হয় না, বরং স্বাধীনতার ডাক শুনলে তাদের হৃদয় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে।

চড়ুইঃ ঠিক বলেছো। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য প্রয়োজন নিজেদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। সৎ এবং জ্ঞানী মানুষেরাই পারে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে এবং সত্যকে নির্ভয়ে মেনে নিতে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার পথে হাটতে তারাই পারে।

মুনিয়াঃ আশা করি তাই হোক, জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাক প্রতিটি অন্ধকার হৃদয়ে, খুলে যাক বিবেকের বন্ধ দুয়ার।

চড়ুইঃ দুপুর গড়িয়ে এলো। কচিকাঁচারা নিশ্চই ক্ষুধায় চুচুচিচি শুরু করেছে। বিদায় নিচ্ছি আজকের মতন। আশা করি শীঘ্রই আবার দেখা হবে।

মুনিয়াঃ আচ্ছা, যাও। চু চি কে আমার ভালোবাসা দিও।

কথা শেষ হতেই চড়ুইগুলো ডানা মেলে উড়ে গেলো নীল আকাশের পানে, মাঠ-ঘাট-বন-জলাশয় পেরিয়ে, রিযিকের সন্ধানে। মুনিয়া তাদের যাত্রা পথের দিকে চেয়ে থাকে যতদুর চোখ যায়; মনে মনে কল্পনা করে সেও তাদের সাথে ডানা মেলেছে, আলোকের ফোয়ারা ছোটা দিগন্তের দিকে।।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)