সাহিত্য

সুবাসিত সময়েরা

সুবাসিত সময়েরা
  কাজ যেন আজ শেষ ই হচ্ছেনা ! মেজাজ খারাপ ভাবটা চরমে পৌঁছলো আমার। কোন কুক্ষণে যে রুমটা সাফ সুতরো করার ধান্দা এসেছিল মাথায় ! দুনিয়ার বই পুস্তক , কাঁথা কাপড় , এসাইনমেন্টের রাজ্যের কাগজপত্রে ভর্তি ঘর , আর কোথাও তেমন সুবিধামত জায়গা না পেয়ে ওগুলো এখন বিছানাতেও ঠাঁই নেয়ার পায়তারায় আছে। ইচ্ছে করছে এখনি ঝেঁটিয়ে বিদায় করি সব , কিন্তু না , এ ব্যাপারে প্রবল নিষেধ শাহজাদার , ' আমাকে জিজ্ঞেস না করে একটি কাগজ ও তুমি সরাবেনা মামনি , কথা দাও ! ' কি আর করা , দিলাম কথা ! যার জের টানছি এখন আমি নিজেই , বস্তা বস্তা কাগজ সামলে রাখো আর রাশি রাশি ধুলা গেলো ! ওহ ... আর না , যথেষ্ট করেছি আজকের মত। এখন এক কাপ কড়া কফি না হলে আর চলছেনা মগজ। কিচেনে গিয়ে এক কাপ কফি বানালাম মনের মত করে। কাবার্ড খুলে একটি টোস্ট নিয়ে কামড় দিতেই মনে হলো যেন ডোর বেলের শব্দ শুনলাম। মুখ বন্ধ করে কান পাতলাম , আবার ও বেল বাজলো। এবারে বেল দাতাকে বেশ অসহিষ্ণুই মনে হলো। কে হতে পারে এই অবেলায় ! দরজা খুললাম। শিরিন ভাবি দাঁড়িয়ে অস্থির ভঙ্গীতে। আমার বাড়ির দু তিনটে বাড়ির পরেই তার ছোট্ট গৃহকোণ। তার একমাত্র মেয়ে এসেছে প্রসবকালীন সময়টা মায়ের সাহচর্যে কাটাতে। এ সপ্তাহেই তো তার ডেট ডিউ। তবে কি .... যা ভাবছিলাম , তাই। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাবি তার অস্থির ভাব গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই বললেন , - রুনু , তুমি কি খুব ব্যস্ত এখন ? - না না , তেমন না। কি ব্যাপার ভাবি ? - সুজানার পেইন উঠেছে। হসপিটালের সাথে যোগাযোগ করেছি , ওরা বার্থ ইউনিটে নিয়ে যেতে বলেছে ইমিডিয়েটলি। কিন্তু দেখো , এই সময়েই তোমার ভাই বাসায় নেই , কাজে বেরিয়েছে সকালেই। আমি যে কি করব এখন , কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা ! তুমি কি একটু আমাদেরকে পৌঁছে দেবে হসপিটালে ? - এভাবে কেন বলছেন ভাবি ? কেন দেবনা ? আপনারা সবকিছু গুছিয়ে নিন , আমি গাড়ি নিয়ে আসছি এখু...ি ! আয়েশ করে কফি খাওয়া মাথায় উঠলো আমার ! চটপট রেডি হয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে মেইন গেট লক করে গ্যারেজ দিয়ে বের হলাম। হসপিটালে পৌঁছাতে প্রায় ২০/২৫ মিনিট লেগে গেল। সুজানা এই হসপিটালের সাথেই এটাচড ছিল বলে কোনো ফর্মালিটিজ ছাড়াই ওকে লেবার রুমে নিয়ে গেল সরাসরি। আমি আর ভাবি সুজানার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বিভিন্নভাবে সাহস যোগাতে লাগলাম। প্রথম বাবু সুজানার , তাই বেশ ঘাবড়েও আছে বেচারী। ওর হাসবেন্ডের কাছেও খবর পৌঁছেছে এতক্ষণে , সেও এসে যাবে শিগগির ই। পেইন যত বাড়ছে , অস্থিরতাও তত বাড়ছে সুজানার। আর প্রবল সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একটু পর পর অনুরোধ করছে সিজার করে ফেলতে। কিন্তু ওর নার্স ধৈর্যের সাথে হাসিমুখে ওকে সাহস যোগাচ্ছে , এই বলে বোঝাচ্ছেও যে সব কিছু ই নরমাল এবং সুন্দর ভাবেই এগোচ্ছে সমস্ত প্রক্রিয়া , শুধু শুধু কেন প্রথম বাবুতেই সিজারের ভার বইতে যাবে মেয়েটা ! নার্সের কথাগুলো শুনতে শুনতে আনমনেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক জুড়ে। মনে পড়ল আমার বান্ধবী সুপ্তির কথা। ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালে বেচারী লেবার রুমে যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতেও ডাক্তারকে অনুরোধ করেছিল বাবুটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর এল বাতাসে আনার জন্য। কিন্তু আজকাল কিছু ডাক্তারই আছেন যারা এই পেশায় আসেন তাদের মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থের মূল্যে বিক্রি করতে। মায়া , মমতা , মানবিকতাকে বহুদূরে নির্বাসনে রেখে তারা রোগীর কাছে আসেন। সেরকমই একজনের হাতে পড়েছিল সুপ্তি। ওর আসন্ন মাতৃত্বের কষ্ট , ব্যাকুল অনুরোধকে ছাপিয়ে লাভের অংকগুলো বড় লোভনীয় হাতে হাতছানি দিয়েছিল ডাক্তারটিকে। তাই তিনি অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করেননি মোটেও। প্রায় স্বাভাবিক ভাবে হতে যাওয়া বাচ্চাটিকে ছুরি , কাঁচির তত্বাবধানেই বের করে আনেন শেষমেষ। সুপ্তির হাহাকারগুলো ভুলতে পারিনি আমি অনেকদিন ! আমার ঘোর ভাঙ্গলো নব প্রানের সরব উপস্থিতির ঘোষনায়। খুশির একপশলা দখিনা হাওয়া যেন খেলে বেড়াতে লাগলো পুরো কামরা জুড়ে ! নব অতিথির বাবা মা , নানা নানী সবার কোলে কোলে যেন খেলে বেড়াতে লাগলো এক টুকরো চাঁদ ! খুশির চাঁদোয়া দিয়ে ঘেরা ঘরখানি থেকে বের হলাম প্রজাপতির ডানায় ভর করে। ধুলো মেখে শুরু হওয়া একটি দিন এমন ভাবেই রঙিন হয়ে শেষ হবে গোধুলি বেলায় , কে জানত !

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)