সাহিত্য

নিভে যায় নক্ষত্রের আলো

নিভে যায় নক্ষত্রের আলো
ful   দরজার যন্ত্র পাখিটি ডেকে উঠলো দুবার ৷ রিডিং রুমের কাউচে বসে একটি বইয়ে ডুবেছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মত ৷ ডোরবেল শুনে মুখ তুললাম , থাক , ঘরে তো লোকজন আরো আছে , খুলে দেবে দরজা কেউ না কেউ ৷ আবারও ডুবলাম বইয়ের গহীনে ৷ ' আপা , পাও দুইটা একটু তুইল্লা বসেন , নিচটা ঝাড়ু দিয়া যাই ...' হুকুম মত পা তুলে বসলাম ৷ তাকালাম রাহেলার দিকে , থমথমে মুখে রাজ্যের কালো মেঘ ভর করে আছে ৷ চোখের কোনায় শুকিয়ে থাকা অশ্রুর দাগও কি চোখে পড়ল আমার !  'দাঁড়াও রাহেলা ! কি হয়েছে তোমার ? শামসু বুঝি আবারও ..... আমার কথা শেষ হবার আগেই দৌড়ে এসে আমার নামিয়ে বসা পা দুটোর উপর যেন ভেঙ্গে পড়ল রাহেলা ৷ একটু সহানুভুতির ছোঁয়া যেন ওর বুকের ভেতর জোর করে চেপে রাখা ঝরনার মুখ খুলে দিয়েছে কেউ ৷ জলপ্রপাতের বাঁধভাঙ্গা জলের মত অশ্রুর প্লাবন বয়ে চলেছে ওর চোখে ৷  আস্তে করে শুধালাম , ' কি হয়েছে রাহেলা ? খুলে তো বলবে আমায় , নইলে বুঝব কেমন করে ?' একটু শান্ত হয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল , ' আমার দুইন্যার দিন মনে হয় শ্যাষ গো আপা ! কাইলও জরির বাপে আর ফুফায় ফুফু মিল্যা এমুন মাইর মারলো আমারে ! আর কইছে , আমারে আর আমার ভাইরে জন্মের মতন শিক্ষা দিয়া দিব !'  বুঝলাম এতক্ষণে ! রাহেলার একমাত্র ননদ-নন্দাই ওর ঘরের আশপাশে ঘর ভাড়া নিয়ে এসে উঠেছে ভাই আর মায়ের কাছাকাছি থাকবে বলে ৷ আর এসেই শুরু করেছে ভাইয়ের সংসারের উপর খবরদারি ৷ সুখের সংসার বলতে যা বোঝায় তা রাহেলার না থাকলেও এতদিন অন্তত নিজে উপার্জন করে খেত বলে স্বস্তিটা ছিল , এখন যেন সেটুকুর ওপরেও শকুনের নজর পড়েছে ! এখন শ্বাশুড়িও যোগ দিয়েছেন তার আদরের মেয়ের সঙ্গে ৷ উদ্দেশ্য একটাই , যদি ফাঁকতালে রাহেলার ভাইয়ের কাছ থেকে নগদে কিছু আদায় করা যায় , তবে মন্দ কি ! ওদিকে রাহেলার ভাইয়ের অবস্থা আরো করুণ ৷ নিজে করে লোহা লক্করের কারখানায় শ্রমিকের চাকরি , ওদিকে ঘরে রোগে ভোগা বুড়ো বাপ আর ৩/৪ টা অবুঝ বাচ্চার অনাহারক্লিষ্ট মুখ ৷ সে ই বা বোনের শ্বশুরবাড়ির খামতি মেটায় কেমন করে ! রাহেলার কান্না আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো আমায় ৷ 'ভাইরে কত কইছি , ভাইগো, আমারে এই জাহান্নাম থিকা ছাড়াইয়া লইয়া যাও ৷ আমি তোমার ঘাড়ে বইয়া খামুনা , কাম কইরা নিজের ভাত নিজেই জোটামু ৷ তাও তুমি আমারে এগো হাত থিকা বাচাও , নাইলে এরা আমারে জানেই মাইরা ফালাইবো ৷' অঝোরে কাঁদতে থাকে রাহেলা , আমারও চোখ দুটো বাষ্পাচছন্ন হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে ৷ ************************************************   প্রায় চার পাঁচ দিন হয়ে গেল রাহেলার খবর নেই ৷ ওকে অনেকবার করে বলা আছে , কোনকারনে আসতে না পারলে আমাকে অন্তত একটা খবর যেন পৌঁছায় ৷ কখনো কখনো জরিকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে বটে , কিন্তু এখনকার মত এভাবে না জানিয়ে এতদিন ডুব দিয়ে কখনো তো থাকেনি রাহেলা ! বাজার এসেছে ৷ কর্তা পাঁচমিশালী মাছের চচ্চরি পছন্দ করেন , তাই আজ নিজে বাজারে গিয়ে মনের সুখে কেজিখানেক পাঁচমিশালী গুঁড়া মাছ নিয়ে সহাস্যবদনে হাজির হয়েছেন ৷ রাহেলা আসেনি আজ ৷ কে কুটবে মাছ , কে বাছবে সবজি ! সে চিন্তা তো আর কর্তাকে করতে হয়না ! তিনি তো বাজার করে দিয়েই নিশ্চিন্ত আর সময়মত টেবিলেও হাজির ! গজ গজ করতে করতে ডালায় মাছ নিয়ে সবে কুটতে বসেছি , হঠাত বাইরে চাপা একটা গোলমাল শুনে কান সজাগ করলাম ৷ শুনলাম অনেক নারী পুরুষের সম্মিলিত চাপা আতঙ্কভরা ফিসফাস ! উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি দারোয়ান সিদ্দিক ভাইও ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে ৷ ' কি হয়েছে সিদ্দিক ভাই ? এত মানুষ কেন এখানে ? ' ' আপা ! সর্বনাশ হইছে ! আমাগো রাহেলা .....' আমার হৃদস্পন্দন যেন লহমায় বন্ধ হয়ে এলো ৷ কি হয়েছে রাহেলার ! দৌড়ে নিচে নামলাম ৷ নিচে দাঁড়ানো শোকার্ত নারী পুরুষেরা হাউমাউ করে যা বলল , তাতে আমার ঝলমলে রোদ্দুরঘেরা সকালটাতে যেন মুহুর্তেই অন্ধকার অমাবস্যার রাত নেমে এলো ৷ রাহেলা নেই ! ওর পাষন্ড স্বামী আর লোভী , ঝগড়াটে আর হিংসুটে ননদ মিলে ওর গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ! ওর চিত্কার শুনে আশপাশের মানুষ ছুটে এসে আগুন নিভিয়েছে বটে , কিন্তু ততক্ষণে শরীরের বেশিরভাগই শেষ হয়ে গেছে চিরতরে ৷ হাসপাতালে নিতে নিতেই নিষ্ঠুর এই পৃথিবী ছেড়ে ওপারের দিকে যাত্রা শুরু করেছে রাহেলা ! আমি বজ্রাহত হয়ে বসে পড়লাম ৷ আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো রাহেলার হাসি ভরা মুখের ছবি ৷ কত যে সুখ দুখের কাহিনী উজাড় করে ঢেলেছে আমার কাছে ! কখনো হাসিমুখে শুনতাম , কখনো মৃদু বকে আগে হাতের কাজ শেষ করতে তাড়া দিতাম ৷ তাতে হয়ত তার মুখের প্রদীপ্ত সুর্যের উপর পাতলা সাদা মেঘ জমত ক্ষণকালের জন্য , পরক্ষনেই আবার সেই মেঘ সরে গিয়ে প্রখর রোদ্দুর খেলা করত শ্যামলা মুখখানিতে ৷ আজ সেই রাহেলা নেই ! চিরদিনের জন্য চলে গেছে অভিমানিনীর মত , কিভাবে বিশ্বাস করব আমি !  গলায় স্বর ফুট্ছিলনা আমার , তবুও এক মহিলাকে জিগ্গেস করলাম , ' ওর ভাই কোথায় ? সে জানে তার বোনের খবর ? ' ' হ আফা , অর ভাই আছাড়ি খাইয়া কানতাছে আর পুলিশের হাতে পায় ধরতাছে বইনের লাশের লাইগা , নিয়া মাডিডা য্যান দিতে পারে ৷ ' বোনের লাশ প্রার্থী অসহায় ওই যুবকটির জন্য করুণা হতে লাগলো আমার ৷ তার দরিদ্র ঘরে ভাতের দাবিদার একজন বাড়বে বলে বোনের হাজারও আর্তি উপেক্ষা করেছে সে ৷ বরং মানিয়ে গুনিয়ে স্বামীর সংসারকেই আপন করে নিতে কত বুঝিয়েছে বোনকে ৷ আজ এসেছে বোনের লাশ নিয়ে যেতে ! লাশের ভাতের দরকার হয়না , হাজারো চাহিদা মেটানোরও প্রয়োজন পড়েনা ৷ বরং বোনটি লাশ হয়ে চিরকালের জন্য তার কাঙ্গাল ভাইটিকে দায়মুক্ত করে দিয়ে গেল ! চোখে আঁচলচাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ৷ এক রাহেলার চলে যাওয়ায় পৃথিবী তো থেমে নেই ৷ অনেক কাজ পড়ে আছে ঘরে ৷ ঘড়ি ধরে সেসব তো শেষ করতে হবে আমাকেই ! 

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)