ধর্ম ও গবেষনা

যে কারনে পর্দার সুফল থেকে বঞ্চিত নারী সমাজ -১

যে কারনে পর্দার সুফল থেকে বঞ্চিত নারী সমাজ -১

  একজন শিক্ষক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিচ্ছেন। সিলিন্ডারে ক্ষেত্রফল বোঝাতে যেয়ে ললনাদের হাতের চুড়ির প্রসঙ্গ আসলো। এরপর হটাত তিনি বলে উঠলেন- মেয়েরা যে হাতে চুড়ি পড়ে পহেলা বৈশাখের দিন সেজেগুজে আসে, সেটা তার খুবই ভালো লাগে। হটাত এক ছাত্র জিজ্ঞেস করলো- স্যার কথা কী ম্যাডাম জানে? স্যার একটু থতমত খেয়ে গেলেন। নাহ! কথা জানলে কী আমার রক্ষা আছে? মিথ্যা হলেও মন রাখার জন্য হলেও বউকে বলতেই হয় সেই দুনিয়ার সেরা সুন্দরী।

যাক! তারপরেও এই ভদ্রলোকের মধ্যে কিছুটা মিথ্যা হলেও মানবিকতা বোধ আছে। কিন্তু যাদের মধ্যে নেই? যারা হরহামেশাই রাস্তার চকচকে ঝকঝকে পালিশ করা মুখ নারীদের দেখে ঘরে ফিরেই সরাসরি স্ত্রীকে তুলনা করছেন বাহিরের মেয়েদের সাথে? কিংবা কোন একটা দুর্বল মুহূর্তে শারীরিক সৌন্দর্যের মাপকাঠিকে কেন্দ্র করে খোঁটা দিয়ে নারীর যৌক্তিক প্রতি উত্তরের যায়গা কেড়ে নিচ্ছেন! তাদের অবস্থা ক্ষেত্রে আরও করুন।

বড় আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। প্রশ্ন আসতে পারে- নারীকে বিধাতা সুন্দর করে বানিয়েছেন, সেই সৌন্দর্য ঢেকে রাখা কী বিধাতার সৃষ্টিকে অপমান করারই নামান্তর নয়?

যেই বিধাতা নারীকে সুন্দর করে বানিয়েছেন তিনি সেই সৌন্দর্যকে সংরক্ষণ করে দিতে চান, পরিবারের সদস্য এবং নিজের জীবন সঙ্গীর জন্য। আর এই সৌন্দর্য সংরক্ষণ করা খুবই জরুরী বিষয়, মানবতার জন্যই। একজন নারীকে গ্রহণ করা মানে তার সাথে জড়িত সমস্ত দ্বায় দায়িত্ব গ্রহণ করা। বিশেষত , সন্তান জন্মদানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীর বিশাল অবদান রয়েছে। সুতরাং, নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরোপুরি স্বনির্ভর হতে পারেনা, অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও সে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার জন্য তার জীবন সঙ্গীর যত্ন, মনোযোগ এবং ভালোবাসা তার জন্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু পুরুষ আবার নির্ভরশীল নয়। সৃষ্টিগতভাবেই সে বহুগামি। আর এই বহুগামিতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সব ধর্মই নৈতিক বিধি নিষেধ  দেবার চেষ্টা করেছে। প্রাচীন যুগে পুরুষরা বহু বিবাহ করতো, এবং সেই নারীদের প্রতি বহু অবিচারের নিদর্শন দেখা যায়। পরবর্তীতে ইসলাম এই অগণিত বিয়েকে রোধ করে কঠিন শর্তের পাল্লা দিয়ে দিলো।

পুরুষের বহুগামিতাকে রোধ করার জন্য সেই সাথে পরকীয়া, বিবাহবিচ্ছেদ, ব্যভিচার, নারীর যথেচ্ছা ব্যবহার, ধ... ব্যভিচার রোধ করার জন্য পর্দা প্রথা আসলো।

একটা কথা বলে নেই, পর্দাকে শুধু একটি ধর্মের আলোকেই দেখা যায় , তা নয়। সব ধর্মেই নারীর শালীনতাকে কম বেশি প্রাধান্য দেওয়া হলে ও পরিপূর্ণ গাইডলাইনের অভাব ছিল। যেমন খৃস্টান ধর্মে ক্যাথলিক খৃষ্টান যাজক মহিলাগন শত শত বছর ধরে পর্দা বিধান মেনে চলছেন।

 

"কোন পুরুষ ইবাদত বন্দেগী করা অবস্থায় তার মাথায় কিছু থাকলে তার মাথাকে অপদস্থ করা হবে। পক্ষান্তরে,কোন মহিলা খালি মাথায় ইবাদত বন্দেগী করলে তার মাথাকে অপদস্থ করা হবে। মাথাকে অপদস্থ করা মানে মাথার চুল কামিয়ে দেয়া। অতএব,কোন মহিলা মাথা ঢেকে না রাখলে তার মাথার চুল কামিয়ে দিতে হবে। যদি কোন মহিলার জন্য তার মাথার চুল কামিয়ে ফেলা অপমানজনক মনে হয়; তাহলে সে যেন তার মাথা ঢেকে রাখে। আর পুরুষের মাথা স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি হওয়ার কারণে মাথা ঢেকে রাখা উচিত নয়। মহিলারা স্বামীর সন্মানের প্রতিচ্ছবি। কারণ,পুরুষ মহিলা থেকে নয় বরং মহিলা পুরুষ থেকে। পুরুষ মহিলার জন্য সৃজিত হয় নাই বরং মহিলা পুরুষের জন্য সৃজিত হয়েছে। তাই, ফেরেশতার খাতিরেই তার মাথার উপরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।" [ করিন্থিয়ান্স ১১:-১০] 

আবার অনেকেই হয়তো শুনে অবাক হবেন যে হিন্দু ধর্মেও নারীদের পর্দার কথা বলা হয়েছে যেমন-

 

যেহেতু ব্রহ্মা তোমাদের নারী করেছেন তাই দৃষ্টিকে অবনত রাখবে, উপরে নয় নিজেদের পা সামলে রাখো এমন পোষাক পড়ো যাতে কেউ তোমার দেহ দেখতে না পায় (ঋকবেদ ৮।৩৩।১৯)

 

সুতরাং বোঝা গেলো সব ধর্মেই নারীর শালিনতার বিধান করা হয়েছে।

 এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ইদানিং খুব গণহারে হিজাব পড়ার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সমাজের সব ধর্ম বর্ণের নারীরা পর্দার সুফল পাচ্ছেনা। পর্দা প্রথার সুফলের স্বরূপ দেখতে হলে আপনাকে সবার আগে যেতে হবে ১৪০০ বছর আগের সেই সমাজে। যেখানে মেয়ে সন্তান জন্ম নেওয়ার সাথে সাথে কবর দিয়ে দেওয়া হতো, মেয়েরা ছিল দাসী, ভোগ্যপণ্য, ব্যবসায় লাভবান হওয়ার মাধ্যম। নারীহ..., যথেচ্ছা বিয়ে, দাসানুদাস স্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করে ধর্ষিতা হওয়া, পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য হওয়া সহ হেন কোন অন্যায় নেই যা নারীকে কেন্দ্র করে হতো না।

অথচ, যেই পর্দা প্রথার আবির্ভাব হল, নারীর জন্য নারীর ঘর ভাঙা বন্ধ হয়ে গেলো, ১০-১৫ টা বিয়ে করে শুধু ভোগ লালসা চরিতার্থ করার খেলা বন্ধ হয়ে গেলো, বিয়ে একজন নারীর প্রতি দায়িত্ব শুধুই ভোগ নয়, এই ধারণা প্রসার লাভ করলো। সমাজ থেকে ধ..., নারীর পন্যায়ন, যৌনদাসীবৃত্তি , ব্যভিচার দূর হল। মেয়েরা পেলো মা, বোন , স্ত্রীর মর্যাদা। এক পর্দা প্রথাই হাজার সমস্যার ওষুধ হয়ে এলো।

এখনকার সময়ের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই, অনেক নারীই পর্দা করছেন, কিন্তু তারপরেও সমাজ থেকে পরকীয়া, তালাক , ব্যভিচার, নারীর পন্যায়ন যেন হিজাবের সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে বাড়ছেই। এর কিছু গভীর ক্ষত রয়েই যাচ্ছে-

- একদল নারী হিজাব পড়ছে, আরেকদল ঠিক তার বিপরীতে সমস্ত অবয়ব শুধু খোলাই না লোভনীয় করে তোলার চেষ্টা করছে। মিডিয়া, পত্রিকা , মুদির দোকানের বিল বোর্ডে কিংবা যত্রতত্র রাস্তাঘাটে। এই নারীদের দেখেই পর্দা করে এমন মেয়েদের স্বামী বা ভবিষ্যৎ স্বামীদের একটি মনোসামাজিক চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তো চাহিদা মাফিক বানিয়ে নেওয়া যায়না। সুতরাং, চাহিদার ঘাটতি থেকেই সংসারে টানা পোড়েন অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে।

- যারা হিজাব পড়ছেন, তাদের একটা বিরাট অংশই আবার সঠিকভাবে নিজেকে সংরক্ষণ করছেন না। তাদেরকে স্টেজে উঠে নাচতে গাইতে যেমন দেখা যাচ্ছে, আবার ছেলে মেয়ে অবাধ মেলামেশায় তাদের জুরি নেই। হিজাব পড়ার পরেও মুখে চওড়া মেকআপ, ঠোঁটে বাহারি রঙ। হিজাবের যে মূল উদ্দেশ্য দৃষ্টি সংরক্ষণ, বা নারীপুরুষের মধ্যে একটা দেওয়াল তুলে দেওয়া মানসিক এবং সামাজিক, তা কিছুতেই পূরণ হচ্ছেনা।

হিজাব পড়াই হিজাবের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। হিজাব একটি লক্ষ্য পূরণের অনুসঙ্গ মাত্র। এখানে লক্ষ্য হল- চ্যাস্টিটি বা বিবাহ পূর্ব বর্তি সতীত্ব সংরক্ষণ, এবং বিবাহ পরবর্তী সংযত এবং পরিমিত আচরণ।

কিন্তু এই উদ্দেশ্য আধুনিক ফ্যাশন ট্রেন্ড হিজাব রক্ষা করতে পারছেনা। কারন, এটা শুধু পোশাকেই পরিবর্তন এনেছে, মানসিকতা বা মেলামেশাইয় কোন বাঁধা তৈরি করেনি, যা পর্দার মূল লক্ষ্য। সুতরাং, পর্দার সুফল এই হিজাব দিয়ে পাওয়া যাবে না এটাই তো স্বাভাবিক

 ( চলবে )


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)