সাহিত্য

হৃদয়ের গভীরে

হৃদয়ের গভীরে
কাঁচে শিশির বিন্দু জমে আছে। ঝাপসা সামনের সবকিছু। বেলকনির গ্লাস শীতের শুরু থেকেই অমন করে বন্ধ আছে। প্রায় দিনই শিশিরে ভিজে একসা হয়ে থাকে। পাশেই টেবিলে শ খানেক বই আলগা পড়ে আছে। দেখলে বোঝাই যায় বইগুলো এতোটায় ব্যবহৃত যে গুছিয়ে রাখার মতো সুযোগ কেউ পায়না। টেবিলের পাশের কর্ণারে সবুজ সতেজ পাতাবাহারের ঝালর উপর থেকে ক্রমশ নিচের দিকে নেমেছে । গ্লাসের ওপাশে অনতিদূরে একটা লেক খুব ধীর গতিতে বয়ে চলেছে। টেবিলের পাশে রাখা নরম চেয়ার টেনে বসলেন এক মহীয়সী। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমার চারপাশের মুখমন্ডলে বার্ধক্যের প্রবল চাপ। অনেকগুলো দাঁতই হারিয়েছেন। পরনে লম্বা গাউন। সাদা চুলগুলোর ফাঁকে দু একটা কালো চুল দেখা যায়।
 
হোম মেইড মেয়েটি কাজ শেষ করে একটা মোড়া টেনে বসলো………..
 
মহীয়সী নিজের নাম স্পষ্ট অক্ষরে লিখলেন,  মারিয়া ডি কষ্টা। পাশে আরো একটি নাম মারিয়া হোসাইন। হোম মেইডের সামনে ধরে,
-পড়
হোম মেইডের দৃষ্টি জুড়ে বিস্ময়, শিক্ষিতা হোম মেইড দ্রুত কন্ঠে,
-কী করে হয় এটা? ম্যাম আপনি খৃষ্টান ছিলেন?
গাম্ভীর্যপূর্ণ হ্যা সূচক মাথা দোলান বৃদ্ধা। নেমে যাওয়া চশমাটি ঠিক করে পরেন, ভারী গলায় বলেন,
-ছিলাম! বাবা মায়ের কলজার টুকরো একটিমাত্র সন্তান ছিলাম আমি, আশৈশব লন্ডনে লালিত পালিত হয়েছি, পরে বাবার জবের কারণে ইন্ডিয়াতে চলে আসি আমরা। সে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা, বিয়ে করেছিলাম এক ভারতীয় হিন্দুকে, বাবা মা মেনে নেননি,   ধর্ম বিসর্জন দিয়ে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা যে কোন ধর্ম, সমাজ, পরিবারের জন্য ভয়াবহ পাপের! শশুরবাড়ী থেকেও মেনে নেয়নি কেউ।  স্বামীর সাথে গাছতলায় থাকবো বলে প্রতিজ্ঞা করলাম, দুজন মিলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, ক্ষুধা পেলে ঘাস লতা পাতা যা পেয়েছি এই দাঁত দিয়ে চিবিয়েছি। কখনো মন্দিরে ঘুমিয়েছি, কখনো গীর্জায়। কখনো গাছের ডালে বিশ্রাম নিয়েছি কখনো খোলা আকাশের নিচে। তখন ছিলো শীতকাল, শীতের প্রকোপে চেহারা এতটুকু হয়ে গিয়েছিলো, তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি শীতার্তদের যন্ত্রণা, ক্ষুধার্থদের হাহাকার, পিপাসার্তদের  আহাজারী!
 
একদিনের ঘটনা শোন,……. কথা শেষ করে হোম মেইডের দিকে তাকান মারিয়া  হোসাইন,
-লাঞ্চের প্রস্তুতি শেষ করেছো?
-জ্বি ম্যাম! আমি অতি আগ্রহে অপেক্ষা করছি আপনার পরবর্তী ঘটনা শুনবার জন্য!
মারিয়া হোসাইন হাসেন, তার হাস্সোজ্জল মুখটিতে নিরন্তর গল্প, বললেন,
-তোমার নামটা কি যেন? দেখেছো এতো এত স্টোরী, পোয়েট্রি, কোটেশন, হাদীথ মাথায় স্থান গেড়ে আছে যে তোমার নামটা রেখে দেয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিনা। আর নাম বলতে একটা মাত্র নামই মনের পুরোটা জুড়ে…………..যাইহোক……. কষ্ট পেলে?
 
-জ্বিনা ম্যাম বলুন! আমার নাম সামিয়া।
- ও আচ্ছা, ঠিক আছে শোন তাহলে, মন্দিরের এক কলতলায় গোছল সেরে ভেতরে ঢুকছিলাম। ততদিনে ঐ মন্দিরই  আমাদের ঘর, সংসার, সমাজ সবটা। মাঝে মাঝে অনেকেই আসে পুজো দিতে, বিভোর হয়ে দেখি। একদিন দেখলাম আমার স্বামীর মাকে……
একটু শ্বাস নেন মারিয়া হোসাইন, তারপর হেসে বলেন,
-স্বামীর নামটাই তো বলিনি তোমায়, শুনবেনা?
-জ্বি শুনবো, সেটাই জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম।
-হুম, ওর নাম প্রসেনজিৎ সেন। শাশুড়ীমা ছেলেকে দেখতে পেয়ে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরেন, একটা বাক্য শুনতে পেয়েছিলাম  “খোকা তুই এখানে, তোকে কোথায় না খুঁজেছি” অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় ছেলেকে ছাড়েননা তিনি, বুঝতে পেরেছিলাম মা ছেলের জমানো কথাগুলো আজ বের হয়ে আসছে অবিরাম।
আমি কেমন অপাংক্তেয় এক প্রাণী যেন, নিজেকে সে সময় খুব অসহায় মনে হচ্ছিল, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছিল মুহুর্তেই। মনে হলো কতোদিন আমায় কেউ ওমন মমতায় জড়িয়ে রাখেনি। বাবার মুখটা মনে পড়লো, সাথে মায়েরও। শাশুড়ীমা আমার সাথে কোন কথা না বলে পুঁজো সেরে চলে গেলেন।
 
এক সপ্তাহ পর। প্রসেনজিৎ আমাকে খুব বেশী ভালোবাসতে শুরু করলো। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম। ভেতরটায় এমন একটা অনুভূতি তৈরী হলো যা বলে শেষ করার না। ওকে বললাম,
-তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও যে মৃত্যুর মত মনে হবে।
ও তখন মলিন হেসে বলল,
-কিছু মুহুর্তের জন্য তো ছাড়তেই হবে…… একটু থেমে,
-আমাদের অন্তত একটি কামরা থাকবে, যেখানে একসাথে ঘুমাব, ভোরবেলা জেগে দুজন দুজনের ঘুম জড়ানো মুখটা দেখবো, ……
আমি ওকে থামিয়ে দিলাম, রাজপ্রাসাদ সম বাড়িতে মানুষ হওয়া এই আমার তখন একটি কামরা নিয়ে স্বপ্ন দেখাও যেন খুব বেশী কিছু মনে হচ্ছিল।
গত রাতের অবশিষ্ট খাবার দুজনে ভাগ করে খেয়ে নিলাম, এরপর প্রসেনজিত প্রতিদিনের মত বের হয়ে গেল কাজের খোঁজে। কিন্তু সেদিন সে ফিরেনি। আর কোনদিনই ফিরে আসেনি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন মহীয়সী। তাকান সামিয়ার দিকে,
-চলো নামাজ সেরে লাঞ্চ করি।
-জ্বি ম্যাম, তবে পরের ঘটনার জন্য উদগ্রীব থাকবো, বলেই মুচকী হেসে দেয়।
-ওকে……. মলিন কন্ঠ মারিয়া হোসাইনের।
যোহরের নামাজ আদায় করলেন অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্ত নিয়ে। মারিয়া হোসাইন সামিয়াকে সাথে নিয়ে একই টেবিলে একই খাবার  খান সবসময়। সামিয়া প্রথম দিকে সংকোচ করতো, পরে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
 
পড়ন্ত বিকেল, শীতার্ত রুক্ষ এই  আবহাওয়া সবসময় মারিয়া হোসাইনকে শূন্যতার শিক্ষা দিয়ে জানান দিয়েছে, এই পৃথিবীতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য থেকে যে বিচ্যুত হবে সে কখনই পূর্নতার দেখা পাবেনা বরং ধীরে ধীরে শূন্যতার শেষ অবধী পৌঁছে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে অথচ টেরই পাবেনা কতোটা মূল্যবান অবস্থান সে হারিয়েছে যা কখনোয় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।  শূন্য দিগন্তে দৃষ্টি মেলেন মারিয়া হোসাইন, সেখানেও কেবল শূন্যতার সৌন্দর্য দেখতে পান। অনুধাবন করেন শূন্যতার সৌন্দর্য! দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে শূ্ন্যতার মালিকের কাছে মনে প্রাণে কামনা করেন অনন্ত জীবনের পূর্নতা প্রাপ্তির জন্য।
 
এর মধ্যে সামিয়া কফি নিয়ে ছাদে আসে। আনমনে হয়ে গিয়েছিলেন মারিয়া হোসাইন, টের পাননি ওর আগমন । সামিয়া সামনে ছোট্ট একটা টেবিলে রেখে দেয় কফির বড় একটা মগ। ওর হাতেও আছে একটা। দরদভরা কন্ঠে ডাকে,
-ম্যাম……!
-ওর মুখের দিকে তাকান মারিয়া হোসাইন। চশমা খুলে চোখ মোছেন, হাসার চেষ্টা করে,
-এসেছো? টেরই পাইনি, আছরের নামাজ পড়েছ?
-জ্বি ম্যাম আপনাকে এখানে রেখে গিয়ে আগে নামাজ পড়ে নিয়েছি তারপর কফি বানিয়েছি। পাশে বসে সামিয়া,
-ম্যাম এখন কি বলবেন পরবর্তী ঘটনা?
কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন,
-হুম বলবো তো বটেই। একটু চুপ থাকেন আরো কয়েকবার চুমুক দেন কফির কাপে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুরু করেন মলিন কন্ঠে,
-ফিরে গিয়েছিলাম বাবা মার কাছে। বাবা মা মেনে নিতে চাইলেও খ্রিষ্টীয় সমাজ মেনে নেয়নি, তাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই তাড়ানোর দৃশ্য দেখে ফেলে হোসাইন, আমার আত্মার স্পন্দন, প্রতিটি মুহুর্ত যাকে আমি অনুভব করি। সে ছিলো  মুসলিম, এভাবে বিপর্যস্ত একজন নারীকে ফেলে সে চলে যেতে পারেনি, আমাকে বলেছিলো,
-“আপনি চাইলে আমি আপনার সহযোগীতা করতে পারি”।
 
বাইরের কারো এরুপ কথা শুনে আমি আরো বেশী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি, কিন্তু কি কারণে যেন ওর কথায় আস্থা খুঁজে পেয়েছিলাম, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
অকস্মাত ওর আচরণে কান্না থেমে যায় আমার, স্তম্ভিত  হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে ও খুব দ্রুত আমার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে কয়েক ধাপ সরে গিয়ে বললো,
-“আমি মুসলিম”!
আমার স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগে। এই ভেবে যে, কোন যুবক অসম্ভব সুন্দরী একজন নারীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে কিসের টানে, আর তাছাড়া আমাদের সমাজে এভাবে ছেলে মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরা কোন ব্যাপারই না।। স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
-আপনার সাহায্য প্রয়োজন আমার।
ও আমাকে একটা মহিলা হোস্টেলে নিয়ে যায়, সেখানে থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যাবস্থা করে, দশটা বই আমাকে দিয়ে বলেছিলো,
-“আমি প্রসেনজিতকে চিনি। ওদের পাড়াতেই থাকি, প্রতিবেশী হিসেবে ওর সব ব্যাপারে জানি।  ও গতকাল বিয়ে করেছে.........
আমি আবারও কেঁদে ফেলি, ও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“আপনাকে যে বই গুলো দিয়েছি ওগুলো পড়বেন, দেখবেন দৃষ্টিভংগী বদলে যাবে, আপনি নিজেকে জানবেন নিজের করনীয় বুঝতে পারবেন, কষ্ট গুলোও হালকা হয়ে যাবে”।
আমি হঠাৎই ওকে প্রশ্ন করেছিলাম,
-আপনি কি আসবেন মাঝে মাঝে?
-না তা সম্ভব হবেনা, বরং বইগুলো পড়া শেষ হলে হোষ্টেল প্রধানকে জানাবেন আরো বই পাঠিয়ে দেব, আর মান্থলি যাবতীয় খরচ পাঠিয়ে দেব, যতদিন আপনার আয়ের কোন ব্যাবস্থা না হয়।
ও চলে যায়।
আমি বইগুলো নেড়ে দেখি একটা বইয়ে দৃষ্টি আটকে যায়, বইটির নাম “বাইবেল ও কুরআন’!
 
৩...
রাতের খাওয়া শেষ করেন মারিয়া হোসাইন সামিয়াকে সাথে নিয়ে।
আমি ঐ হোষ্টেলে দুই বছর থেকেছি। দুই বছরে প্রায় ছয়শত বই পড়েছি। সব হোসাইন পাঠিয়ে দিয়েছে , কিন্তু একদিনও আমার সাথে দেখা করেনি। আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করেছি, কিন্তু ও আসেনি। আমি একদিন খবর পাঠালাম দেখা করব বলে, কিন্তু ও বলে পাঠিয়েছিলো,
-“দেখা করার মতো কোন প্রয়োজন আমাদের থাকতে পারেনা”।
তার পরপরই আমি মুসলমান হই। ওদের বাড়ি থেকে ডেকে পাঠায় ওর বাবা মা। আমি যাবার পরে বললেন আমার জন্য বিয়ের ব্যাবস্থা করতে চান তারা। একটা ছেলেও দেখেছেন, ইঞ্জিনিয়ার সে। সেদিনও হোসাইন সামনে আসেনি, খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। অনেক কথা বলার ছিলো, কিন্তু কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিলো বলে ফিরে এসেছিলাম কিছু না বলেই। এরপর একটা জব পেয়ে যাই সোশাল মিডিয়া নামে এক গবেষনাগারে।  এভাবেই চলছিলো। হোসাইনের বাবা মার দেয়া বিয়ের সে প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিয়ে একটা ছোট্ট চিঠি লিখেছিলাম, চিঠিটা লিখেছিলাম ইংলিশে,
 
“আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি বিয়ে করবনা। আপনাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, আমার নতুন জীবনের জন্য। একজন মুসলিম হিসেবে পরিচিত হতে পেরে আমি গর্বিত, হোসাইনের দেয়া বইগুলো আমাকে সব ভ্রান্তি থেকে সরিয়ে সরল সোজা পথের দেখা দিয়েছে। সশ্রদ্ধ সালাম আপনাদেরকে”।
                                                                                                মারিয়া
 
এভাবেই চলছিলো, হঠাৎ একদিন শুনলাম হোসাইন হাসপাতালে, পাগলের মতো ছুটে ওর কাছে গিয়েছিলাম, মনে পড়ে সেদিন একটা অটোর সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যাই। ভাগ্য ভালো ছিলো ফুটপাতে পড়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে শুনলাম ওর ব্রেইনে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বাক্যটা শোনার সাথে সাথে আমার পুরো পৃথিবী যেন উলট পালট হয়ে যায়, একটু নির্জন স্থান খুঁজে নিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। শুধুই মনে হচ্ছিলো, হোসাইনের সাথে আমার থাকা না হোক, কিন্তু এই পৃথিবীতে কোথাও সে থাকবেনা এটা কি করে আমি মেনে নেব! সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে বিয়ে করার।
ওর বাবা মাকে নিজেই নিজের ইচ্ছেটা জানালাম, ওর এই কষ্টকর সময়গুলোতে পাশে থাকার আকুতি জানালাম। ওনারা আপত্তি জানিয়ে বলেন,
-নাহ! এ কি করে সম্ভব! এ সময় বিয়ের কথা…. আর তাছাড়া তোমার সামনে হয়তো অনেকটা পথ, না না আমরা তোমার জীবন নষ্ট করে পারিনা…….
কিন্তু আমার অবস্থা দেখে ওনারা সম্মতি দিতে বাধ্য হন। এরপর সমস্যা ছিলো হোসাইন ও কোনভাবেই রাজি হওয়ার পাত্র ছিলোনা। পাঁচদিন পর সে সম্মতি দেয়। হাসপাতালেই বিয়ে হয় আমাদের,  সেদিন অসংখ্য  রোগী, ডাক্তার নার্স আমাদের বিয়েতে জমায়েত হয়েছিলো। সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন আমার শশুর বাড়ীর লোকজন।
 
এরপরের কিছুদিনের ঘটনা শুধুই ভালোবাসার। হোসাইনের জন্ম ছিলো বাংলাদেশে। কিন্তু বেড়ে ওঠা ভারতে। হোসাইনের ইচ্ছেতেই আবার বাংলাদেশে ফেরে ওর পরিবার, সাথে আমি। ও আমাকে বাংলাভাষায় কথাবলতে শিখিয়েছিল।  ওর দাদু লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্টের এই বাংলোটা চাকুরী সূত্রে পেয়েছিলেন, পরে স্থায়ীভাবেই তাকে দিয়ে দেয়া হয়। সবাই মিলে এই বাংলোতেই উঠি। হোসাইনের ব্যাপারে শুধু একটাই অনুভূতি, আমার ভেতরটাকে প্রশান্ত রাখতো সবসময় ওর প্রসংগ উঠলে, ওকে দেখলে মনে মনে একটা কথায় উচ্চারিত হতো, “এই মানুষটাকে আমি খুবই ভালোবাসী…….
ও শেষ কটা মাস আমাকে এতো সুন্দর সুন্দর মুহুর্ত উপহার দিয়েছে যে মুহূর্তগুলোকে আঁকড়েই আমার এই পুরো সময় কাটিয়ে এসেছি। এখানে (লাউয়াছড়া) আসার দু তিন দিন  পর হঠাৎ শুনি সবাই যশোর চলে যাবে, ওখানে ওদের গ্রামের বাড়ি। সবার মতো গোছগাছ শুরু করেছি আমিও। সবাই রেডি, আমিও রেডি হচ্ছি, আমাদের শোবার ঘরে, হোসাইন এসে আমার মাথায় আটকানো ওড়না এক টানে খুলে ফেলে পেছন থেকে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আমাকে এখানে একাকী ফেলে চলে যাচ্ছ”?
আমি ওর কাছে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলাম, অবাক হলাম, বললাম
-বুঝিনি তোমার কথা।
-আমি যশোর যাচ্ছিনা………
-কেন?
-বাবা মা আপু সবাই তোমাকে আর আমাকে কিছুদিন একাকী সময় দিতে চেয়েছেন তাই…..
ওর বাক্য শেষ হয়না, আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি………… ও আমাকে খুশি করতে পেরে খুশি হয়।
 
সবাই চলে যান, শুধু আমরা দুজন। অনেকটা হানিমুনের মতো। সময়গুলো খুব দ্রুতই চলে যাচ্ছিল……
 
থেমে যান মারিয়া হোসাইন, এরপরের আর কিছুই বলবনা আমি তোমায়, খুব যন্ত্রণার কথাগুলো বর্ণনা করিনা, করা যায়না। শুধু একটা কথা বলি সামিয়া আমি যখন থেকে হোসাইনের সততা দেখেছি, চোখ বন্ধ করে ওকে ভালোবেসেছি, ওর মতো মানুষকে কখনো ভালো না বেসে থাকা যায়না। ওর প্রতিটি ইবাদাত খুব যত্নে পালিত হতে দেখতাম, ওকে দেখে শিখেছি মানুষের সৌন্দর্য তার কাজে, তার দৃষ্টির পলকে, তার মুখের কথায়…… এগুলো সুন্দর হলে আপনাতেই তার দৈহিক অবয়বকে পছন্দ করা যায়, যদিও সে সুন্দর না হয় তবুও।  

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন