আড়াল
আনমনে ভাবটা কাটিয়ে উঠে ধুলো মাখা ডায়েরীটির দিকে তাকায় উজ্জয়িনী। এক সময় ছোট্ট একটা ঘটনাও ডায়েরীর পাতায় স্থান পেতো। অসংখ্য অভিমান, অশ্রু, অথবা আনন্দগুলো আজও ধরে রেখেছে ডায়েরিটি। খানিক ধুলো জমে যাওয়ায় পরিষ্কার রংটি আর বুঝা যাচ্ছেনা, লেখাগুলোও কলমের কালির বিছিয়ে যাওয়া অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছে। ভেতরের একটা পাতায় দৃষ্টি আটকে যায়, লেখা আছে “আজ বাবা চলে গেলেন আমাদের সবাইকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে”।
উজ্জয়িনীর দুচোখ ঝাপসা হয়ে যায়, জানালা দিয়ে এক চিলতে আকাশ যেন ছোট্ট হয়ে ওর কাছে ধরা দিতে চাইছে, সেদিকেই তাকিয়ে থাকে অপলক। নিরন্তর প্রচেষ্টা গুলো, কষ্টের অর্জনগুলো একে একে ওর মনটাকে পরিতৃপ্ত করে। ওর ঝাপসা দৃষ্টি ধীরে ধীরে উজ্জল হয়ে ওঠে। সান্ধ্য আয়োজন সম্পন্ন হয়। শবনম মোস্তারী মেয়ের মাথায় হাত রাখেন,
-ছুটির দিনটা তোর খুব আনমনে কাটে, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিলেও তো পারিস।
মাকে জড়িয়ে ধরে উজ্জয়িনী,
-না মা তা নয়। আসলে ব্যাস্ততার জন্য জীবনের আসল অর্থ খোঁজা হয়না কারোরই, ব্যাস্ততার বাইরেও যে অনেএএএক বিশাল একটা ভাবনার জগত আছে, নিজেকে চেনার একটা উপায় আছে, দায়িত্ব সচেতন হওয়ার একটা পন্থা আছে এই কথাগুলো আমরা ভূলতে বসেছি। শবনম মোস্তারী মেয়ের এমন ভারী কথা শুনে মনে মনে খুশিই হন, সে ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে,
-থাক এতো ভারী ভারী কথা বলতে হবেনা, মাগরিবের আজান হয়েছে সে খেয়াল আছে?
-হ্যা মা খেয়াল আছে, চলো নামাজ পড়ে কফি বানাবো।
নামাজ শেষ করে কফি বানিয়ে মায়ের সামনে এনে রাখে উজ্জয়নী,বড় এক বাদুড় দেখে বেলকনির গ্রীল দিয়ে সূদূর আকাশের দিকে আবারও চোখ মেলে তাকায় উজ্জয়িনী। তখনও অন্ধকার গাঢ়ো হয়ে ওঠেনি। শবনম মোস্তারী খুব আয়েশ করে নির্বিঘ্নে কফি পান করছেন, মাঝে মাঝে মেয়ের মুখটাও দেখছেন আর ভাবছেন পৃথিবীতে মায়ের কাছে সন্তানের মুখের এক চিলতে হাসির চেয়ে দামী বোধহয় আর কিছু নয়।
পরদিন সকালে,
উজ্জয়িনী মায়ের সাথে বসে নাস্তা করছিলো, দ্রুত খাবার মুখে দিচ্ছে সে। ব্যাপারটা খেয়াল করে শবনম মোস্তারী বললেন,
- উজ্জয়িনী, এত তাড়াহুড়া করলে গলায় ভাত ঠেকে যাবে।
উজ্জয়নী মুখের খাবার শেষ করে,
-ও মা তোমাকেতো বলায় হয়নি, ঐযে যে পিচ্চিটার কথা বলি, আয়ান, ওর বাবা মা আজ ওকে নিতে আসবে।
শবনম মোস্তারী খুশি হন,
-ও তাই! খুব ভালো কথা। প্রতিটা বাচ্চাই যদি এভাবে বাবা মাকে ফিরে পেতো!
উজ্জয়িনী মায়ের মুখের দিকে তাকায়, নির্বাক সে দৃষ্টি! একটু চুপ থেকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, কলিং বেল বাজছে। উজ্জয়িনী উঠে দাড়ায়,
-মা তুমি বসো আমি দেখছি।
দ্রুত বেসিনে হাত ধুয়ে তোয়ালে নিয়ে মুছতে মুছতে দরজা খুলে, পাশের ফ্লাটের মহিলাকে দেখতে পায়,
-আসুন ভাবী ভেতরে……
-না উজ্জয়িনী, ভেতরে আসবোনা, আজ একটু মালিহাকে খালাম্মার কাছে রাখতে চাচ্ছিলাম, আমার বোন খুব অসুস্থ, হাসপাতালে আছে সারাদিন ওখানেই থাকতে হবে আমাকে।
উজ্জয়িনী হাসি মুখে, পাঁচ বছরের ছোট্ট মালিহাকে কাছে টেনে নিয়ে,
-অবশ্যই মালিহা মনি থাকলে তো মা খুব আনন্দে থাকে, আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।
উজ্জয়িনী ভেতরে ঢুকে মাকে লক্ষ্য করে,
-নাও তোমার সারাদিনের সঙ্গী জুটলো। শবনম মোস্তারীর মুখমন্ডল জুড়ে খুশির আভা উপচে পড়ছে যেন, ব্যাপারটা উজ্জয়িনীর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে পারেনা। উজ্জয়িনী ভাবে নিজের নাতী নাতনী পেলে আরও কতো আনন্দে থাকতো তা না ভেবেই বুঝা যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্কার্ফটা ঠিক করে বের হয় অরফানেজ হোমের উদ্দেশ্যে।
কিছুক্ষণ আগেই আয়ানকে ওর বাবা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় দিয়েছে হোমের সকল শিক্ষক শিক্ষিকা, চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য বাচ্চারা । সবার দৃষ্টিই খানিকটা ঝাপসা হয়েছে, আয়ান যাবার আগে উজ্জয়িনীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো খুব করে, উজ্জয়িনী ঠিক সে জন্যই নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় নিয়েছিলো। “আয়ান এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো থাকবে” এটা ভেবেই নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে পেরেছে। এইতো জীবন, কারো অনুপস্থিতি খানিকটা ব্যাথার সৃষ্টি করলেও অনায়াসে সে ব্যাথা হজম করতে পারে মানুষ পরবর্তী একটা কিছুকে অবলম্বন করে। তাইতো মানুষ আবারো নতুন করে স্বপ্ন দেখে, অন্যকেও স্বপ্ন দেখার প্রয়াস জাগায়।
এখন সবাই যে যার মতো নিজের কাজের দিকে যাচ্ছে উজ্জয়িনী তানিয়ার পাশেই দাঁড়িয়েছিলো, তানিয়া একটু মলিন হেসে,
-আসিফ ওর বাবা মা কে নিয়ে তোর বাড়ি যেতে চায়, আন্টিকে নাকী ফোনে পায়নি তাই …..
-এখন আমার ওর ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা, তুই মার সাথে কথা বলতে বলিস, মা যা বলবে তাই। উজ্জয়িনী অফিস রুমের দিকে পা বাড়ায়, ওর ফোন বাজে রিসিভ করে কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যায়, ওপার থেকে গম্ভীর কন্ঠে,
-এটা কি উজ্জল নামের কারো নাম্বার?
-জ্বি বলছি! উজ্জয়িনীর উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
-আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন? উজ্জল কি মেয়েদের নাম হয়?
উজ্জয়িনী হতচিত হয়ে যায়, লোকটির কর্কশ কন্ঠ শুনে, কিছুক্ষণ থেমে,
-আমার নাম উজ্জয়িনী, বাবা আমাকে উজ্জল বলে ডাকতেন , আপনি কে বলছেন?
-আমি গেন্ডারিয়া থানা থেকে ওসি বলছি, একটা অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেছে, লাস্ট ডায়াল কলে এই নাম্বারটা ছিলো…….
উজ্জয়িনীর মাথা পুরো চক্কর দিয়ে ওঠে অফিস রুমের সামনেই আলুথালু হয়ে বসে পড়ে। ওর ভেতরটা অস্থির ভাবে একটায় প্রশ্ণ করে যাচ্ছে, “কে হতে পারে?” অফিস থেকে ছুটি নেয় সে তানিয়াকে ব্যাপারটা জানিয়ে বললো,
-তুই মায়ের কাছে থাকিস, আগেই কিছু বলবিনা… আমি দেখি…. পরে জানাচ্ছি……
-সাবধানে যাস, তানিয়ার উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
লাশটিকে চিহ্নিত করতে দু মিনিটও লাগলোনা, সেই চেহারা সেই মুখ। কতো বছর পেরিয়ে আজও তেমনই!
-বড় ভাইয়া! এতোদিন পরে এভাবে তোমার সাথে দেখা হবে ভাবিনি! উজ্জয়িনী আর্তনাদ করে ওঠে নিজেকে সামলাতে পারছেনা কেনমতেই।
ওসি অর্ধনমিত মাথা তুলে,
-বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট, কিন্তু কি করবেন? এমনই হয় কখনো কখনো। আপনার আর কে আছে, তাদের নাম্বার দিন। লাশ পোষ্টমর্টেম করতে হবে।
উজ্জয়িনী ওর মেঝ ভাইয়া উজায়েরের নাম্বারটা দিয়ে, কান্নাজড়িত কন্ঠে,
-কিভাবে এমন হয়েছে জেনেছেন?
-না তেমন কিছুই জানা যায়নি, তবে বরফের ছুরি দিয়ে খু... করা হয়েছে। আর এই এলাকার কেউ তাকে এর আগে দেখেনি।
উজ্জয়িনী থমকে যায়। কে করলো এমন? আর ভাইয়া থাকতোই বা কোথায় ? ভাবী কোথায়? বাচ্চাগুলো? মাকে জানাবো কি করে?
থানায় ডায়েরী করে বাদী হয়ে।
এতোগুলো প্রশ্ণ সামনে রেখেই অশ্রু মুছে ফেলে উজ্জয়িনী।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)