
অফিসের লিফটে বিশাল লাইন, তাই বাধ্য হয়ে খুব দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে নাসির। প্রায় দিনই দেরী হয়ে যায় অফিসে আসতে। অফিসে ঢুকতেই নাসিরের কলিগ নিচু কন্ঠে,
-স্যার দেখা করতে বলেছে।
-আচ্ছা করবো।
নাসির অফিসে ঢোকা মাত্র অন্যদের ভেতরে এক চাপা গুঞ্জন শোনা যায়, সেদিকে কান দেয়না সে। জীবনের অন্তর্নিহিত সময়গুলোর মধ্যে খুব কম সময়ই সে অবসর পেয়েছে। কাজ শুরু করার আগে বসের সাথে দেখা করে আসে, যথারীতি তিক্ত কিছু বাক্য কর্ণে ঢুকিয়ে ফের ফিরে নিজের ডেস্কে। নিরবে কাজ করে যায় একসময় অন্যদের গুঞ্জন থেমে গিয়ে কাজের চাপে গলার আর কোনরূপ স্বর যেন শুনতে পাওয়া যায়না।
সন্ধায় বাসায় ফিরে যায় হেঁটে হেঁটে। কি এক গভীর টান ওকে পাগলের মতো তাড়া করে, চারপাশের কোন সৌন্দয্ ওকে থামাতে পারে, ওর দৃষ্টিকে ছুঁতে পারেনা। ও কেবল এগিয়ে যায় সামনে তাকিয়ে।
বাসায় ফিরে ঘরগুলোতে আলো জ্বালায়। মূল রুমের সুইচে হাত দেয়ার আগেই ক্ষীণ একটা কন্ঠ ভেসে আসে.
-জিরো লাইটটা জ্বালিও!
নাসির মুচকী হাসে, জিরো লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে যায় খাটে শুয়ে থাকা এক নিথর শরীরের পাশে,
-চাঁদমুখটা না দেখলে ক্লান্তি মিটবেনা যে!
-তাই! চারপাশে কতওওওও চাঁদমুখ দ্যাখোনি বুঝি!
কপালের এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিয়ে,
-আমার আকাশে একটাই চাঁদ আছে থাকবে!
-আচ্ছা ঠিক আছে হেরে গেলাম, এবারতো ফ্রেশ হয়ে নাও।
-হুম, যাচ্ছি। কি খাবে বলো, একবারে বানিয়ে আসবো তোমার পাশে।
-কি জানি বুঝতে পারছিনা, বুয়াতো স্যুপ খাওয়াতে চেয়েছিলো আমি খাইনি, তোমার হাতে খাব, ওটাই খাইয়ে দিও। আর টেবিলে তোমার জন্য সান্ডউইচ বানিয়ে রেখে গেছে।
নাসির ওয়াশরুমে ঢোকে, নিজে ফ্রেশ হয়ে গরম জলে স্যাভলন, আর ফেইসওয়াশ মিশিয়ে আসে খাটের পাশে যত্ন করে পুরো শরীর মুছে দেয়, দ্বিতীয়বার শুধু গরম পানি দিয়ে মুছিয়ে শুকনো গামছা দিয়ে আরও একবার। অসুস্থ নিথর মানুষটির কন্ঠে ইতস্তত ভাব,
-থাকনা এতো কষ্ট তুমি কিভাবে করতে পারো? কথা বলেনা নাসির, মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মনোযোগ দেয়।
ডিনার সারে দুজনই। নাসির মলিন কন্ঠে,
-সাবা!
-হুম!
-তুমি এখন কেমন বোধ করছো?
-ভালো। তোমাকে একটা কথা বলি?
-বলো।
_আজকেও অফিসে তোমাকে বকেছে আমি জানি। রোজ রোজ এই এক ঘেয়েমি তোমার ভালো লাগে? তোমার কী ইচ্ছে করেনা সকালবেলা তোমার স্ত্রী তোমায় রান্না করে নাস্তা করিয়ে অফিসে পাঠাবে, দুপুরের খাবারটাও প্যাক করে পাঠিয়ে দেবে। আর সন্ধায় যখন ফিরবে তখন তোমার সামনে চেইঞ্জের পোশাকগুলো এগিয়ে দেবে দুজন একসাথে বসে চা পান করবে…….. একটু থামে সাবা ওর কন্ঠ রুদ্ধ, আমি নিজেকে কি করে ক্ষমা করবো ……..
সাবার ঠোঁটে হাত রাখে নাসির,
-আর বলোনা। দ্যাখো জীবনের সবগুলো ধাপ সবার সাথে মিলতে হবে তারতো কোন মানে হয়না সাবা। আমি তোমাকে ভালোবাসী, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় কথা। তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনা, বিশ্বাস করো যে কারণে অফিসের বসের বকা, কলিগদের নিন্দা সবটায় আমি হজম করতে পারি। আমি যখন রাস্তায় হাঁটি তখনও আর কিছুতেই আমার মন বসেনা বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডার কথাও মাথায় আসেনা, মনে হয় আমি ফিরছি আমার প্রিয়ার কাছে, আর বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা যাবতীয় প্রশান্তি আমি তোমার কাছেই পাই, আলহামদুলিল্লাহ্। আমি ছুটি শুধুই তোমার দিকে। তুমি কখনো নিজেকে ছোট মনে করোনা আমার কোনদিনই মনে হয়নি যদি এমন হতো। তবে তুমি সুস্থ হও এটা মনে প্রাণে চাই।
সাবা কাঁদে, ঝরঝর করে ওর চক্ষুযুগল থেকে অশ্রু নামে,
-তুমি এতো ভালো কেন?
নাসির ওর খুব কাছে চলে যায়, অশ্রু মুছে দেয়,
-কেঁদনা প্লিজ!
তোমার জন্য একটা কবিতা লিখেছিলাম শুনবে সাবা?
-হ্যা অবশ্যই শুনাও, লাইট জ্বালাও……
নাসির বলে,
-“অতলান্তের পরিশ্রান্তিতে তুমি এক কাংখিত বিশ্রাম
সহস্র দুঃখবোধে তোমার দৃষ্টিতেই সুখকর অনুভব!
সমস্ত মলিনতায় অগনিত উজ্জলতা তুমি
আমি ফিরে আসি বারবার তোমার কাছেই!
তুমি থাকবে অমলিণ এই হৃদয়ের মণিকোঠায়
একমাত্র সত্য হয়ে তুমিই শুধু তুমি…………
আবারো কাঁদে সাবা,
-তোমাকে ছেড়ে মরতেও ইচ্ছে করেনা নাসির!
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)