সাহিত্য

উজ্জয়িনী সিরিজ -৪

উজ্জয়িনী সিরিজ -৪
সম্পর্কে বিভ্রান্তি HSP-11  অনেক রাত অব্দি পড়াশুনা করে, কিছুক্ষণ আগেই বালিশে মাথা রেখেছে উজ্জয়িনী। ওর মা শবনম মোস্তারীও জেগেই ছিলেন। উজ্জয়িনী জোর করে শুইয়ে দিয়েছে। শরীর খারাপ করবে এই ভেবে। ডীম লাইটের নীলাচ্ছন্ন আলোয় দৃষ্টি রাখতে গিয়ে হঠাৎই ঘড়ির দিকে চোখ যায়। বিশালকার সৌন্দর্যখচিত ঘড়িটি দুটা বাজার সংকেত শুনালো। টাইম স্পষ্ট না দেখতে পেলেও বুঝতে পারে। হঠাৎই ওর মনের কোণে এক চিলতে আক্ষেপ ভেসে ওঠে, মন বলে ওঠে, বেশতো পড়ালেখা করলে, একটু তাহাজ্জুদ পড়লে কি ঘুমের খুব ক্ষতি হবে? চেয়ে নাওনা প্রভুর দরবারে যা কিছু চাওয়ার! শোয়া থেকে তড়িত বেগে উঠে পড়ে। দু রাকাত নামাজ আদায় করে আবারও বালিশে মাথা রাখে, কি এক প্রশান্তি এসে ভর করে ওর পুরো স্বত্তা জুড়ে। নিমিষেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় উজ্জয়িনী। একটা খুব রহস্য জনক স্বপ্ন দেখে, এরপরই ঘুম ভেঙ্গে যায় উজ্জয়িনীর। উঠে বসে, মায়ের পুরো শরীরে একবার অকারণ চোখ বুলিয়ে নেয়, নাকের সামনে হাত রেখে নিঃশ্বাস পরীক্ষা করে, সব ঠিক দেখে স্বস্তি পায়। ফজরের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে ঢোকে। আজ অফ ডে, মনের মতো নাস্তা তৈরী করে মাকে খাওয়াবে, কতদিন রান্না করেনা উজ্জয়িনী! মায়ের জন্য স্পেশাল কিছু করবে সে, রান্নাঘরের বক্সগুলো একবার করে সবগুলো দেখে নেয়। একটু ভাবে কি করবে......... হঠাৎই মোবাইলটা বিকট আওয়াজ তুলে বেজে ওঠে, দ্রুত রিসিভ করে। ওপাশ থেকে তানিয়ার ব্যাস্ত কন্ঠ, -আমার বর এক্সিডেন্ট করেছে, এম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছি, প্লিজ তুই আয়। হাসপাতালটির নাম জেনে নেয় উজ্জয়িনী। শবনম মোস্তারী উঠেছেন, খুব স্বাভাবিক কন্ঠেই, -তানিয়া? -হ্যা মা ওর বর এক্সিডেন্ট করেছে। -সাবধানে যাস, একটু কিছু খেয়ে যা, হাসপাতালে গেলে এমনিতেই মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। আর আমাকে আপডেট জানাস। -আচ্ছা মা ঠিক আছে। তানিয়ার সাথে দেখা হলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে, তানিয়া অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করছে, ঢাকায় ওর আর কোন আত্মীয় স্বজন থাকেনা। ওর বরের বাবা মা অনেক আগেই মারা গেছে, ভাইবোন নেই। মোটকথা আত্মীয় বলতে ওর বরের কেউ নেই। নার্স এসে একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে যায়। উজ্জয়িনী হাতে নেয়, কিন্তু তানিয়া নিজেই নিয়ে নেয়, - তুই এখানে থাক আমি আনছি, আর তাছাড়া আমার ভাইয়া আসার কথা নিয়ে আসছি। -না তানিয়া তুই থাক, আর ভাইয়াকেতো আমি চিনি...... -না প্লিজ.... চলে যায় তানিয়া। ডাক্তার বের হয়, সাথে নার্স সিহাবের বাড়ির লোক কোথায়? -ঔষধ নিতে গেছে। -রক্ত লাগবে O+ ব্যাবস্থা করুন। খুব দ্রুত। উজ্জয়িনী ব্লাড ব্যাংকের দিকে দ্রুত হাঁটা দেয়, হঠাৎই কি মনে করে পেছন ফিরে একবার তাকায়, ওর পথপানে তাকিয়ে আছে ডাক্তারটি উজ্জয়িনীর সাথে চোখাচোখি হয়, মনের ভেতরটায় একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়, সামনে ফিরে এগিয়ে যেতে থাকে উজ্জয়িনী, ওর মনে পড়ে এই সেই ডাক্তার, আসিফ আরমান! আর কিছু ভাবেনা উজ্জয়িনী, ভাবনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দুরে সরিয়ে দেয়। রক্ত নেবার জন্যই ছোটে............ একটু পরেই প্রা্য় দৌড়ে ওর সামনে আসে তানিয়ার ভাইয়া, -উজ্জয়িনী তুমি তানিয়ার কাছে যাও বোন, ওকে সামলাও আমি রক্তের ব্যবস্থা করছি। -ওকে তামিম ভাইয়া। ফিরে যায় উজ্জয়িনী, কিন্তু ডাক্তার উজ্জয়িনী আসার একটু আগেই মৃত ঘোষণা করে গেছেন, আশেপাশের লোকজন বলাবলি করছে। তানিয়াতো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, ইমারেন্সিতে ভর্তি করায় উজ্জয়িনী। পুলিশ এসেছে, উজ্জয়িনী শুনতে পায় পাকস্থলিতে বিষ পাওয়া গেছে। আৎকে ওঠে, আসিফ এসে সংক্ষেপে বিষয়টা বিবরণ দেয়, উজ্জয়িনীর কাছে, আর পুলিশও কিছু জেরা করে ফিরে যায়, তানিয়া সুস্থ হলে পরে ওর সাথে কথা বলবে। বেশ কিছুদিন পর। উজ্জয়িনী বসে বসে সন্ধার পরে মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে আর গল্পের পশরা সাজিয়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে। শবনম মোস্তারী গম্ভীর কন্ঠে বললেন, -উজায়েরের শ্যালকের সাথে কথা বলেছিস? -হুম বলেছি, উনি জানেননা যে মল্লিকা ভাবী ওনার জ্ন্যই ভাইয়ার সাথে কথা কাটাকাটি করে চলে গেছিল। আমি ব্যাপারটা বলার পর লজ্জিত হয়েছেন, বলেছেন আমি সত্যিই খুব সরি। আপু সবসময় একটু উগ্র, আমি জাস্ট আপনাকে ভালো লাগে সে কথা জানিয়েছিলাম আপুকে, তার মানে তো এই না আপনার ইচ্ছে না থাকলেও.......   আমি ওনাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি মা, যে আমার  এতে কোন সম্মতি নেই। -ভালো করেছিস, এখন যা বলছি মন দিয়ে শোন, আসিফ আরমান নামে কাউকে মনে পড়ে? চমকে উঠে উজ্জয়িনী, কোন নাম শুনে ভেতরটা এতো আন্দোলিত হয় তা আজই প্রথম বুঝলো সে, কাঁপা গলায় বললো, -কেক কেন মা!? - এসেছিলো কাল বাসায়। তানিয়ার কাছে ঠিকানা জেনে নিয়ে! -কেন এসেছিলো? -আসিফ এখনও বিয়ে করেনি,তোর সম্মতি থাকলে তোকেই বিয়ে করতে চায়। উজ্জয়িনী লজ্জায় লাল হয়ে যায়, মাথা নিচু করে মুচকী হাসে -আমার আবার সম্মতি কি? তুমি যা বলবে তাই করবো! শবনম মোস্তারী হাস্সোজ্জল কন্ঠে, -আহা আমার বাধ্য মেয়েটি! -তবে মা আমি একদিন কিছু কথা বলতে চাই, আমার প্রয়োজনীয় কিছু কথা আছে। -বলবি, যা বলার............. কলিং বেল বেজে ওঠে, ভ্রু কুঁচকিয়ে শবনম মোস্তারী, -এ সময় কে আবার! -তুমি বসো মা আমি দেখছি, উজ্জয়িনী দ্রুত গিয়ে, -কে? -আমি তানিয়া। খুলে দেয় উজ্জয়িনী, তানিয়া সামনে দাঁড়িয়ে, ওর হাজব্যান্ড মারা গেছে দশদিনও হয়নি। ও চলে এসেছে, অবাক হয় উজ্জয়িনী। উজ্জয়িনী দুদিন পরপর গিয়ে ওর বাসায় ওকে দেখে এসেছে। গতকাল যেতে পারেনি, তানিয়ার পুরো অবয়বে এক শোকাতুর ছায়া, বিদ্ধস্ত, পরাজিত এক মানবী, ওর চেহারার সমস্ত উজ্জলতা নাই হয়ে গেছে। তানিয়া উজ্জয়িনীকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে দেয়,  উজ্জয়িনীর দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসে, -তানিয়া! তানিয়া! চল্ ভেতরে চল্ না! নিজেকে সামলায় তানিয়া, উজ্জয়িনী ওকে জড়িয়ে ধরেই ভেতরে নিয়ে যায়। শবনম মোস্তারী মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তানিয়ার, শান্তনা দেন। এরপর বলেন, -দুই বান্ধবী গল্প করো আমি একটু চা নাস্তা বানাই। চলে যান তিনি। উজ্জয়িনী, তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে, -  পুলিশ এসেছিলো কাল? -হুম, সব জেরা শেষ এটা একটা ফুড পয়জনিং হিসেবেই তারা ধরে নিয়েছেন, এক্সিডেন্টটাকেই আসল মৃত্যুর কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন, কিনতু আসিফতো জোর কন্ঠে বলছে ওটা বিষ। তুই কাল যাসনি কেন? তোর খোঁজ করছিলো বারবার। -আমি আসিফ আসবে ভেবেই যাইনি! কিন্তু মা বললো তোর ওখান থেকে বাসায় এসেছিলো।  ভাইয়া, আন্টিরা চলে গেছেন? -না আছে। কিছুক্ষণ থামে তানিয়া, উসখুস করে...... বরবার ওর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, উজ্জয়িনী সেটা খেয়াল করে, তানিয়ার ডান হাত দুহাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে, -কি বলতে চাস বল! কোন সংকোচ করিসনা, আমি সব সময় তোর পাশে থাকার চেষ্টা করবো..... আবারো কেঁদে ফেলে তানিয়া, ধরা গলায়, - পুলিশ তো সামলানো গেছে কিন্তু নিজেকে ক্ষমা করবো কি করে? ওটা যে বিষই ছিলো! উজ্জয়িনীর দৃষ্টিতে ভয় আর শংকা, কাঁপা গলায়,  -বিষ? তুই দিয়েছিস? কথা বলেনা তানিয়া, কেঁদে যায় অবিরাম, উজ্জয়িনী ওর চুপ থাকা সহ্য করতে পারেনা, -কি কথা বলছিসনা কেন বল! -বুয়ার সাথে অবৈধ সম্পর্ক, সেদিন আবার বেডরুমে……………………. থামিয়ে দেয় উজ্জয়িনী, ওর পুরো শরীর ঘৃণায় খচখচ করে ওঠে, মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে যায়, -তুই অফিসে ছিলি? -না অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম, একটা ফাইল ছেড়ে এসেছিলাম নিতে গিয়ে……..। -এজন্যই বলেছিলাম তানিয়া ইসলামই মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় তৈরী করতে পারে, যার ভেতরে আল্লাহর ভয় থাকেনা সে তো লোকচক্ষুর আড়ালে নোংরা কাজ করবেই........ উজ্জয়িনী থেমে থাকে অনেক্ষণ, সম্পর্কের সংগায় একটি বিভ্রাট যোগ হয়, চোখে দেখা খুব সুশ্রী মানুষটির আড়লটা কি এতোটায় জঘণ্য? তানিয়াকে খুব ভালোবাসী বলে ফলাও করে বেড়াতো, উজ্জয়িনীর সামনেই একদিন সে কি দুর্দান্ত প্রেম। তানিয়া খুব বিশ্বাস করতো লোকটাকে। সবইতো ছিল লোক দেখানো। নাংরামী যখন কারো মনের চারপাশ দখল করে ফেলে তখন আর ভালো কোন কিছুই মনকে আলোড়িত করতে পারেনা, তখন সে যা কিছুই দেখে যা কিছুই করে সবকিছুতে সেই একই জিনিসের প্রলেপ। উজ্জয়িনী ভাবে, কি জানি তানিয়া হয়তো ঠিই করেছে ………..

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন