
সাহিত্য
উজ্জয়িনী সিরিজ -৩

"বিবর্ণতার আড়াল থেকে"
চারেদিকে কুয়াশায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঢাকার রাজপথ বড্ড অচেনা লাগছে আজ। উজ্জয়িনী ঝড়ের বেগে হাঁটছে যেন, তবুও শীতের প্রকোপ ওকে বারবার বাড়ি ফেরার তাকিদ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই যেতেই হবে। গত এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে আজই কেবল বের হয়েছে "অরফানেজ হোম" এর উদ্দেশ্যে। চাকুরী তো! ঝড়, রোদ, বৃষ্টি, অসুস্থতা সবই উপেক্ষা করতে হয়। বাস্তবতা এতো রূঢ় কেন? একটু খানি দুর্বলতা থাকলে আর যেন টিকে থাকা যায়না এই পৃথিবীতে। যে যত দুর্বল বাস্তবতা তার কাছে ততই কঠিন হয়ে ধরা দেয়। উজ্জয়িনী হঠাৎই থমকে দাঁড়ায় ওর মনে হলো অনেক্ষণ ধরে কোন গাড়ীর হর্ণ বেজে চলেছে। সাইডে দাড়ায় উজ্জয়িনী কিন্তু গাড়িটা ওর পাশ দিয়ে চলে না গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে যায়। উজ্জয়িনী খানিকটা ইতস্তত করে আবার হাঁটতে শুরু করে কিন্তু গাড়ী থেকে এবার কেউ ডেকে ওঠে,
-উজ্জয়িনী!
পেছনে তাকায়, খুব পরিচিত এই কন্ঠ! গাড়ীর গ্লাস নামানো, মাথা বের করে দিয়ে ডাকছে খুব পরিচিত একজন, বহুদিন চলে গেছে দেখা হয়নি তার চিনতে একটু কষ্টই হয় উজ্জয়িনীর, কারণ ইতোমধ্যেই মানুষটি দাঁড়ি রেখে দিয়েছে। উজ্জয়িনীর মলিন কন্ঠ,
-মেজ ভাইয়া! তুমি এদিকে যে! এগিয়ে আসে উজ্জয়িনী।
মলিন চেহারা উজ্জয়িনীর মেঝ ভাইয়া উজায়ের হোসাইনের,
-গাড়ীতে আয়!
-না ভাইয়া, বলো কী বলবে? আমার তাড়া আছে।
-তুই কোথায় যাবি বল, আমি তোকে সেখানে পৌঁছে দেব।
বাধ্য হয়ে ওঠে, উজায়ের হোসাইনের পাশের সিটে, উজায়ের গাড়ী স্টার্ট করে,
-এভাবে এতো ভোরবেলা বের হয়েছিস যে, আর হেঁটে হেঁটে কেন?
না খুবই শীত লাগছে তো। আর রিকশা বা সি এনজি নিলে আরো বেশী শীত করবে তাই! তোমার কী অবস্থা বলো, ভাবী তারপর বাবুটা কেমন আছে?
-আছে ভালো, তুই এতো শুকিয়ে গেছিস যে, অসুস্থ? মা কেমন আছে?
-এই একটু জ্বর হয়েছিলো তো তাই, আর মা আছে ভালোই। বড় ভাইয়ার সাথে তোমার যোগাযোগ আছে?
-হ্যা আছে।
-ভাইয়া আমার মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাচ্ছ বলো কী বলবে!
উজায়ের মাথা নিচু করে, মলিন কন্ঠে,
-আমায় একটা হেল্প করবি বোন! তোর ভাবী একমাস হলো বাপের বাড়ী গেছে আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখবেনা বলে, বাবুকে নিয়ে গেছে, বাবুকে না দেখে আমি আর থাকতে পারছিনা যে! উজ্জয়িনীর ঠোঁট জুড়ে বিবর্ণ হাসি,
- অহ! এই ব্যাপার তাহলে! তাইতো বলি আমার ভাইয়া আমার কাছে কেন? ভাইয়া ভেবে দেখ, তুমি তোমার ছেলেকে একমাস না দেখে এতো কষ্ট পাচ্ছ। আর আমার মা তার ছেলেদেরকে বছরের পর বছর না দেখে কতটা কষ্ট পাচ্ছে! একটু থামে উজ্জয়িনী আবারও বলে, কিন্তু এতে আমি কি করতে পারি?
লজ্জা আর দুঃখে উজায়েরের মুখমন্ডল বড্ড নিরীহ মনে হচ্ছে, মাথা নিচু রেখে গাড়ী চালায় আর বলে,
-তোর ভাবী ওর ছোট ভাইয়ের সাথে তোকে বিয়ে দিতে চায়, ওর ছোট ভাই নাকী তোকে খুব পছন্দ করে এই নিয়ে আমার সাথে.........
-গাড়ী থামাও ভাইয়া! আমাকে নামতে দাও! আমি আর শুনতে পারছিনা, গাড়ী থামায় উজায়ের এখানেই তোর কাজ? আমি দিয়ে আসছি আর বলবনা, আর কিছুই বলবনা, সত্যি বলছি!
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। উজ্জয়িনী মাকে কল দেয়, আর জানিয়ে দেয় আজ বিকেলে বাসায় ফিরছিনা, এম বি এর ক্লাস করে রাতেই ফেরার কথাটাও জানায়। উজায়েরের শশুর বাড়ী ফার্মগেট। রওয়ানা দেয় সেই উদ্দেশ্যে। বাসে বসে অনেক্ষন কাঁদে উজ্জয়িনী দুই ভাইয়ের সমস্ত কষ্ট দেওয়ার ঘটনাগুলো ওর মনে পড়ে যায়! ইশ! কতটা স্বার্থপর ওরা! কেন এমন হয়? আজ এসেছে নিজের স্বার্থের জন্যই, কিন্তু আমি কী পারলাম স্বার্থপর হতে? কেন পারলামনা? বারবার মেজ ভাইয়ার মলিন চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে......
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজায়,দরজা খুলেই সামনে দাঁড়ানো ওর চার বছরের ভাতিজা মাহী, হেসে দেয় উজ্জয়িনী,
-ওলে বাবালে আমার সোনা বাবুতা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?
মাহীও হাসে,
-ফুপ্পি কেমন আছ?
-ও বাবা তোমার কথা দেখি স্পষ্ট হয়ে গেছে। কোলে তুলে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে,
-তোমর আম্মু......... এগিয়ে আসে মাহীর মা মল্লিকা, মুচকী হেসে,
-উজ্জয়িনী যে! কি খবর এসো ভেতরে। উজ্জয়িনী সোফায় বসে মাহীর সাথে মিষ্টি মিষ্টি দুষ্টুমিতে ব্যস্ত হয়ে যায়, মল্লিকা চা নাস্তা নিয়ে আসে, সাথে আসেন মল্লিকার মা বাবা, আর সেই ছোট ভাইটি সবার সাথেই মোটামুটি কথা বলে উজ্জয়িনী, সবাই চলে যায়। মল্লিকা বললো বলো কী খবর?
-ভাবী তুমি ভাইয়ার সাথে রাগ করে ঠিক করোনি!
-উজ্জয়িনী এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কথা বলো! রাগে লাল হয়ে যায় মল্লিকা...
-ভাবী তুমি যৌক্তিক হও, দ্যাখো ভাইয়াদের কারোর সাথেই আমার যোগাযোগ নেই, আর তুমি যে প্রস্তাব দিয়েছো তাতে ভাইয়ার করনীয় কিছু আছে? আমি যদি রাজি না থাকি? বলো এটা আগে বলো?
চুপ থাকে মল্লিকা, উজ্জয়িনী বলে যায়,
-দ্যাখো ভাইয়া যদি তোমার প্রস্তাবে রাজি না থাকতো তাহলে কী আজ আমাকে পাঠাতো? ভাইয়া তোমাকে ছাড়া কতো কষ্টে আছে একবার দেখলে বুঝতে!
মল্লিকা কেঁদে ফেলে,
-আমিও কী ওকে ছাড়া ভালো আছি? মাহী প্রতিদিন রাতে বাবা আসেনা কেন বলে চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু তুমি বলো তুমি আমার ভাইকে বিয়ে করবে?
উজ্জয়িনীর ভেতরটা রাগে ফেটে পড়ে, ওর মন বলে কে একটা থাপ্পড় দিতে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করেনা, বললো,
-ভাবী বিয়ে করা না করা আমার হাতে নেই, এ ব্যাপারে ভাগ্যটাও লাগে, তুমি বরং তোমার ভাইয়ের ফোন নাম্বার দাও, আমি কথা বলে নেব, তবে হ্যা একটা শর্তে।
খুশি হয় মল্লিকা,
-কী?
-তুমি এই মুহুর্তে ভাইয়াকে ফোন করে এখানে আসতে বলবে।
-হ্যা অবশ্যই, আমি লাউড স্পিার দিচ্ছি। গদগদ কন্ঠে মল্লিকা উজায়েরকে আসতে বলে। উজ্জয়িনী বেদনার হাসি হাসে, বলে,
-আসি ভাবী, আমার ক্লাস আছে।
-তোমার ভাইয়া আসুক দেখাকে যেও!
-না ভাবী তার আর প্রয়োজন হবেনা! তবে একটা কথা বলছি ভাবী, প্রতিটি সম্পর্কের আলাদা আলাদা মূল্য আছে জানোতো! একটা সম্পর্কের জন্য অন্য সম্পর্ককে ছোট করতে নেই! তাতে জটিলতা বাড়ে, প্রতিটি সম্পর্ক একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে অনেক মূল্যবান, প্রতিটি সম্পর্ক স্ব স্ব অবস্থান থেকে জরুরী............... ছোট্ট মাহী উজ্জয়িনীর কোলে, মলিন কন্ঠে,
-ফুপ্পি তুমি কাঁদছ?
উজ্জয়িনী কান্না লুকোনোর চেষ্টা করে,
-নাতো বাবু, চোখে কিছু পড়েছে বোধহয়। দ্যাখো তোমার জন্য রিমোর্ট কনট্রোল গাড়ী এনেছি, এই নাও।
মাহী উচ্ছল কন্ঠে,
-থ্যাঙ্ক ইউ ফুপ্পি!
মাহীকে চুমু দিয়ে,
-আসছি ভাবী।

আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)