
- এহ হে! তুমি দেখি ঘেমে একেবারে শেষ হয়ে গেছো!
খুলো এসব ছাই পাশ খুলে একটু দম নাও!
বাসে সিটে বসতে না বসতেই কপালে টিপ কানে বড় বড় দুল পরা মহিলাটা মায়াকান্না শুরু করলো। ফারিহা অবশ্য একটু বিরক্তই। ঠিক আছে একটু নাহয় ভ্যাপসা গরমই পড়েছে, তাই বলে কি সব খুলে ফেলতে হবে বাসে ওঠার সাথে সাথেই!
আবার মহিলা বলে উঠলো
- এই মেয়ে তোমার গরম লাগছেনা? তোমাকে দেখে তো আমারই গরম লাগছে! আহারে!
- জী না। তেমন একটা গরম লাগছে না। অভ্যাস আছে।
- ওহ! আমি তো ভাবতেই পারি না! এভাবে মাথা ঢেকে নাক মুখ বন্ধ করে কীভাবে থাকো?
- কি বলেন! আমার তো এভাবেই ভালো লাগে। বাহিরের ধুলাবালি, অতি বেগুনী রশ্মির কারনে র্যাশ হওয়া, চুলে খুশকি হওয়া সহ অনেক রকম চর্ম রোগ থেকে তো নিস্তার পাচ্ছি!
- যাই বলো! তাই বলে এভাবে চলতে হবে নাকি! ঐসব রোগ হলে সেগুলোর প্রতিকার ও আছে। সানস্ক্রিন দিবে, চুলে খুশকিনাশক ওষুধ দিবে। তাই বলে মাথায় কাপড় দিতে হবে, এটা কিন্তু একটা লেইম এক্সকিউজ!
- আসলে কি আমি মনে করি prevention is better than cure তাই রোগ হওয়ার আগেই তার ব্যবস্থা নিয়েছি।
-কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি তোমার পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে এটা পরো । ঠিক না?
- জী না। মোটেও তা নয়। মা আমাকে শালীনতার প্রশিক্ষন দিয়েছেন , আর এর দরকারগুলো বুঝিয়েছেন বড় হওয়ার পরে, আমি নিজেই তখন মন থেকে হিজাব গ্রহন করেছি। কারো চাপে পরিনা, ভালোবাসেই পরি।
মহিলা বেশ বিরক্ত । এতক্ষনের জ্ঞান বিতরণ বৃথাই অপচয় হলো এই ভেবে। ফারিয়া জিজ্ঞেস করলো
- আপনি ভার্সিটিতে কি করেন?
- এই তো লাইব্রেরীতে আছি, জব করি।
- আর ভাইয়া?
- সে অবশ্য রাজনীতি করে। আমরা ২জনই একসাথে রাজনীতি করেছি ছাত্র জীবনে।
ফারিয়া এবার একটু একটু বুঝতে পারলো হিজাব নিয়ে মহিলার উৎকণ্ঠার কারন। নিশ্চয়ই প্রতিদিনই এভাবে কোন না কোন হিজাবিকে গরমের অজুহাত দেখিয়ে মায়াময় কথায় বাঁধার চেষ্টা করে!
ফারিয়া ভাবল। যাক গে, সে তার কাজ করুক। যে যেটা বুঝে পালন করবে, কারো কথায় নিশ্চয়ই সে তা ছাড়বে না। আর যে কোন কাজ নিজের মন থেকে করাটাই অনেক বেশী স্থায়ী রেখাপাত করে জীবনে।
মহিলা একা একাই নিজের সুখ দুঃখের কথা বলে গেলো । নিজের স্বামীর কথাই বেশী বলল সে। স্বামী একজন মহান বিপ্লবী ছিলেন । কিন্তু , বিয়ের পর সেই বিপ্লব আর দেশ দশের চিন্তা নাকি আর কাজ করেনা। এখন মানুষটাকে নিছক বস্তুবাদী লোভী বলেই মনে হয়।
কথা বলতে বলতে কখন যে স্টপেজ চলে আসলো কেউ খেয়াল করেনি। মহিলা নেমে গেলো নিজের গন্তব্যে।
এরপর অনেকদিন মহিলাকে দেখেনি ফারিহা।
প্রায় ৬ মাস পর
সকালে বাসে উঠে বসলো ফারিহা। গ্রীষ্ম পেরিয়ে শীতের আবির্ভাব হয়েছে । ভার্সিটির বাসের সিটগুলো ভীষণ ধুলামলিন । মুছে একপাশে ফারিহা বসলো। আজ তেমন লোকজন নেই বাসে।
পরের স্টপেজ থেকে ছয়মাস আগে দেখা হওয়া সেই লাইব্রেরিয়ান মহিলা পাশে এসে বসলো। শীতকাল হলেও রোদের তাপ কম না একটু ও । মহিলা অবশ্য ফারিহাকে চিনতে পারলো না।
বাসে ওঠার পরই রোদের এক হলকা এসে জানালার পাশে আছড়ে পড়লো । চুল লাল হয়ে যাবে ভেবে সানস্ক্রিন দেওয়ার পরামর্শ দাতা প্রথমেই মাথায় কাপড় দিলেন।
চলতি পথে একটু পরেই সদ্য সমাপ্ত হওয়া ফ্লাইওভারের রাস্তা। কয়েক কেজি ফ্রি ধুলাবালি নাকে, মাথায় চোখে ঢোকা খুব আশ্চর্য কোন বিষয় নয় এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য। জানলার পাশে বসা সেই মহিলা এই বাস্তবতা বুঝে নাকেও কাপড় দিয়ে ফেললেন।
পাশ থেকে দেখে কোন অংশেই হিজাব বিহীন কেউ মনে হচ্ছিলো না ফারিহার কাছে।
ফারিহার মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলল। সে মহিলাকে বলল
- ইশ! কি ভ্যাপসা গরম! কি রোদ! এভাবে প্যাকেট হয়ে বসে আছেন যে!
- আরে! আর বলো না! রাস্তায় যা রোদ! আর ধুলাবালি দেখে মনে হচ্ছে প্রাকৃতিক উপায়ে মেকআপ ও হয়ে যেতে পারে!
- রোদ তাতে কি! আপনি তো সানস্ক্রিন দিয়েই বের হয়েছেন মনে হয়!
- যতোই সানস্ক্রিনই দাও, ইউভিরে সরাসরি চামড়ায় লাগলে স্কিন তো ক্ষতিগ্রস্থ হয়ই!
- ও তাই নাকি! কিন্তু এভাবে মাথায় কাপড় দিয়ে নাকে কাপড় ধরলে মনে হয় বাজে গন্ধ লাগছে নাকে! দেখতে ভালো লাগে না তাই বললাম।
- কি আর করার বলো! ঢাকা শহর তো দিন দিন বাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। আর বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা ও তো জানোই!
- তারচেয়ে তো এভাবে বোরখা হিজাব পড়ে স্থায়ী সুরক্ষা নিয়ে বের হওয়াই ভালো কি বলেন!
দেখেন আমার আপনার মতো কৃত্তিম ভাবে মাথায় কাপড় ও দিতে হচ্ছে না, নাকেও দিতে হচ্ছে না। আবার আপনি তো সারা রাস্তাই এভাবে থাকতে পারবেন না। একসময় আপনার স্বাভাবিক পোশাকে ফিরতেই হবে। আর আমার স্বাভাবিক পোশাকই এটা। তাই টানাটানির ঝামেলা নেই । আবার ইভ টিজিং খারাপ লোকের দৃষ্টি থেকেও বাঁচা যায়, ফিজিক্যাল ফিটনেস নিয়ে ডিস স্যাটিস্ফ্যাকশন থেকেও তো রক্ষা । কি বলেন?
- না মানে মানে! তোমার গরম লাগেনা?
- একটু গরম লাগলে নাহয় লাগলোই । কিন্তু তার বিপরীতে অনেক সুবিধা, এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে পারলে ক্ষতি কি! আর এই শীতে তো এক্সট্রা একটা সুবিধা আছেই। বাড়তি উষ্ণতার বাহক ও এই পোশাক।
কথাগুলো বলে ফারিয়া একটু খুশী খুশী মনেই ভাবতে লাগলো মহিলা তার জবাবগুলো সঠিক সময়েই বুঝে পেয়েছে। পাশে তাকিয়ে দেখল লাইব্রেরিয়ান মহিলা দ্বিধান্বিত বদনে এখনো চিন্তার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন ।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)