
ছোটবেলা থেকেই উপহার দিতে এবং পেতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। কাছের দূরের পরিচিত সবাই জানেন উপহার হিসেবে বই আর গাছ আমার সবচেয়ে বেশী পছন্দ। তাই এই দুটো জিনিসই সবচেয়ে বেশী উপহার পাই আমি সাধারণত। কাউকে দেবার ক্ষেত্রেও এই দুটি জিনিসই আমার প্রথম পছন্দ থাকে। কিন্তু কিছুটা বড় হবার পর যখন পরিবারের বাইরে স্কুলের ফ্রেন্ডেদেরকে উপহার দিতে শুরু করলাম। তখন বুঝতে পারতাম অনেকেই আমার দেয়া উপহার পেয়ে খুব একটা খুশি হচ্ছে না। অথচ বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন ভালো বই হচ্ছে জ্ঞানের প্রতীক। আর গাছ হচ্ছে সজীবতা আর ত্যাগের প্রতীক। গাছ আমাদেরকে শেখায় কিভাবে প্রকৃতি থেকে অশুদ্ধ কিছুকে শুষে নিয়ে নির্মলতা ছড়িয়ে দিতে হয়। এবং জ্ঞান আমাদের সামনে নিত্যনতুন পন্থা উন্মোচন করেন কিভাবে প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেকে সজীব রাখা যায়। কিন্তু যখন এই অসাধারণ সুন্দর উপহার দুটিকে অবহেলিত হতে দেখতাম তখন খুব খুব বেশী কষ্ট পেতাম। একদিন মনখারাপ করে বাবাকে একথা বললে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বললেন, দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তাদের পছন্দ-অপছন্দও আলাদা। তাই কেউ যদি তোর অপছন্দের জিনিসকে অপছন্দ করে তাতে মনখারাপের কিছু নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। কখনো যদি কেউ তোর পছন্দে আপ্লুত হয় সেটা হচ্ছে অনেক বড় একটা প্রাপ্তি বা রিটার্ন গিফট।
যেদিন বাবা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাউকে উপহার দেয়া উচিত সে যা পছন্দ করে সেটার উপর ভিত্তি করে। আমি আমার বাবার অতি বাধ্য কন্যা। বাবা যা বলতেন বিনা তর্কে মেনে নিতাম সবসময়। কিন্তু সেদিন বাবার কথাটি আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। একজন গান শুনতে পছন্দ করতেই পারে। তাই বলে তাকে নিশ্চয়ই আমি গানের সিডি কিনে উপহার দেবো না? কিন্তু আবার এটাও মনেহলো যে, আমার উপহার পেয়ে যদি কেউ খুশিই না হয় তাহলে সেটা দেয়াটাই কি ব্যর্থ হয়ে যায় না? এমন দোলায়িত মন নিয়ে ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম। ভাইয়া হেসে বললেন, কাউকে উপহার দেবার সময় আমি না নিজের পছন্দ বিবেচনা করি, না যাকে দেবো তার পছন্দের কথা চিন্তা করি। আমি কাউকে সেই জিনিসই উপহার দেই যা তার ঐ মূহুর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। যেমন ধরো, কেউ হয়তো টাকার অভাবে বই কিনতে পারছে না। তাকে উপহার স্বরূপ শার্ট বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে লাঞ্চ করানোর চাইতে, বই কিনে দেয়াটাই আমি পছন্দ করবো। কারো হয়তো মানসিক সাপোর্টের প্রয়োজন। তাকে খুব সুন্দর একটা শোপিস কিনে দেবার চাইতে তাকে নিরবিচ্ছিন্ন খানিকটা সময় দেয়াটাকেই আমি ঐ মূহুর্তে জন্য তাকে দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার মনেকরি। আবার ধরো কেউ একটা কিছু নিয়ে খুব সমস্যায় আছে। তার সাহার্যার্থে এগিয়ে যাওয়াটাকেও আমি তার এবং আমার উভয়ের জন্য উপহার মনেকরি। ভাইয়ার কথাগুলো শুনে মনে হয়েছিল ঠিক এমন কিছু কথাই শুনতে চাইছিলাম আমি।
আমার বিয়ের পর পরই যখন দেশের বাইরে চলে এলাম। সংসার, ক্লাস সবকিছু মিলিয়ে রীতিমত হিমশিম খেতাম। আমার হাজবেন্ড আমাকে অনেক বেশীই সাহায্য করতেন। কিন্তু উনার কিছু কিছু সাহায্যকে জীবনে পাওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার বললেও কম বলা হয়ে যাবে। এমনিতে সবসময় বাসায় ফিরে দুজন একসাথে রাতে রান্না করতাম। কোন কোন দিন পড়ার চাপে রান্না করা সম্ভব হতো না। সেদিন হয়তো উনিও বাসায় ফিরতে অনেক রাত করে ফেলতেন। পরদিন ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে বাসায় ফেরার পথে যখন মনে হতো বাসায় গিয়ে রান্না করতে হবে শরীর আরো দুর্বল হয়ে যেত। সমস্যা ছিল আমরা একজনও বাইরের খাবার খেতে পারতাম না। এমন দুর্বল মন নিয়ে ঘরে ঢুকে যখন দেখতাম আমার পছন্দের কোন খাবারের ঘ্রাণ ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে আনন্দ আর প্রাপ্তিতে চোখ ভরে যেতো। এমন শুধু একদিন দুদিন না। অসংখ্য দিন উনি আগেই বাইরে থেকে এসে রান্না করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছেন। যখন প্রথম কনসিভ করেছিলাম ভয়াবহ রকম অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলাম। হসপিটালে থাকতে হয়েছে বেশ কিছুদিন। বাসায় ফেরার পর খাবার তো দূরের কথা কোন মানুষ কাছে আসলেও গন্ধে বমি আসতো। উনি অন্য কাউকে তো আমার কাছে আসতে দিতেনই না এমনকি নিজেও আসতেন না। এই মনেহতো জিলাপি খাবো কিংবা স্পাইসি কিছু। বেচারা সাথে সাথে বানিয়ে আনতেন। কিন্তু সেই খাবার দেখার সাথে সাথেই ইয়াক ইয়াক শুরু করতাম। কখনো বমি করে ঘর বাড়ি ভাসিয়ে ফেলতাম। উনি কোনকিছু নিয়েই রাগ করা তো দূরে থাক একটু বিরক্তও হননি আমার উপর। আমি সবসময় বলি, আপনি সারাজীবন আমাকে অসংখ্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু এই উপহার গুলোর পাশে অন্য আর সব উপহার ম্লান হয়ে যায়।
আমার দুই স্টুডেন্ট গত সপ্তাহে বিয়ে করেছে। গত কয়েকদিন থেকেই দুজন আলাদা আলাদা মেইল পাঠিয়ে পরামর্শ চাইছে এমন কি সারপ্রাইজ গিফট দেয়া যায়। যার রেশ সারাজীবন তাদের পিছু পিছু চলবে মিষ্টি ভালোবাসাময় সুখানুভূতি পরশ নিয়ে। ড্রেস, অর্নামেন্স, ফ্লাওয়ারস, সারপ্রাইজ ট্যুর সবকিছুই একটা সময় পুরনো হয়ে যায়। নতুন কিছু এসে সেটার জায়গা দখল করে নেয়। তাই এমন কিছু অনুভূতি ওরা একে অন্যেকে দিতে চায় যা সবসময় করে যাবে নতুনত্বের আস্বাদন।যে উপহার প্রাপ্তির মুগ্ধতার ছোঁয়ায় হৃদয়কে তোলপাড় করে দু’ আঁখি গলে বেড়িয়ে আসবে আনন্দ্রাশ্রু রূপে। আজ ক্লাস শেষে তাই আমার নিজের জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার গুলোর কথা শেয়ার করলাম স্টুডেন্টদের সবার সাথে। যেসব মুহুর্তের কথা ভাবলে এখনো আমার মনে আনন্দের ঝড় ওঠে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয় অন্তর। অন্তরাত্মা থেকে ঢেউয়ের মত ছলকে ছলকে দোয়া বেড়িয়ে আসে সেই মানুষটির জন্য। যিনি আমার জীবনের সমস্ত জটিল, কঠিন মুহূর্তগুলোকেই আমার জন্য এক একটি উপহারে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন। অনেক অনেক বেশী সুন্দর একটা মন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উনাকে দিয়েছিলেন। যে মনটি সর্বদা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছে আমার মনকে নিজ মহিমায়। আমি ভুলে গেলেও তাই আমার মন কখনো ভুলে যায় না তার জন্য দোয়া করতে......
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)