বিবিধ

সাফল্য লুকায়িত প্রতি ধাপেই...

সাফল্য লুকায়িত প্রতি ধাপেই...
  বেশ কয়েক মাস আগে আমার ভাইয়াদের একজন তার ক্লাসের পনেরোজন মুসলিম স্টুডেন্টকে আমাকে উপহার স্বরূপ দিয়েছিলেন। যেহেতু ওরা সবাই ইউরোপ কান্টিগুলোতেই জন্মেছে এবং বড় হয়েছে। তাই ইসলামের বেসিক জ্ঞানেও অনেক ঘাটতি ওদের। আমার দায়িত্ব ওদেরকে ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করা। এই দায়িত্ব দেবার সময় খুবই রহস্যজনক কন্ঠে ভাইয়া বলেছিলেন, ইনশাআল্লাহ আজ থেকে একাকী বা বোরিং হবার সময় তুমি আর পাবে না। সেদিন ভাইয়ার কথাকে মজা মনে করে উড়িয়ে দিলেও যত দিন যাচ্ছে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি সেই কথার সত্যতা। আমার নয় বছর বয়সী ছেলে যতটা না যন্ত্রণা করে এই উনিশ-বিশ বছর বয়সী ছেলেমেয়েগুলো তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি জ্বালায়। সমস্যা না থাকলে এরা সমস্যা খুঁজে বের করে ম্যাসেজ পাঠাবে ম্যাম জানেন আজ কি হয়েছে? সূর্যোদয়ের পরও আলো ফুটতে এক ঘন্টা লেগেছে মেঘ আর কুয়াশার কারণে। কত শখ করে বসে ছিলাম সূর্যোদয় দেখবো। দিনের প্রথম ইচ্ছেটাই মুখ দেখতে এক ঘন্টা দেরি করলো। এটা একটা কাজ হলো বলেন? কিছু না বলে যে থাকবো সেটারও কোন উপায় দেই। জবাব দেবার আগ পর্যন্ত একটা পর একটা ম্যাসেজ পাঠাতেই থাকবে। গত কয়েকমাস আগে উনাদের একজন নিজের ফেসবুক আইডি আর পাসওয়ার্ড দিয়ে বললো, ম্যাম ফেসবুকের কারণে পড়াশোনা কাজকর্ম কিছুই ঠিকমতো করতে পারি না। আজ থেকে আমার ফেসবুক আপনার কন্ট্রোলে। আপনি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে নিজের কাছেই গোপন রেখে দিবেন। আমি চাইলেও আমাকে দিবেন না। এটাই একমাত্র আমার ফেসবুক নেশা কাটানোর উপায়। একবার ভাবলাম বলি, তুমি তো দেখছি মাথা ব্যথা দূর করার জন্য মাথাই কেটে ফেলতে চাইছো। তারচেয়ে বরং ধীরে ধীরে নেশা কাটানোর চেষ্টা করো। এতে তোমার নিজের উপর আস্থা বাড়বে। আমি যদি কন্ট্রোল করি সেক্ষেত্রে তুমি বাধ্য থাকবে ফেসবুক থেকে দূরে থাকতে। সুযোগ পেলেই যে আবার পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যাবে না এই গ্যারান্টি কে দেবে? পরে ভাবলাম থাক চাইছে যখন ট্রাই করে দেখুক। আরেকদিন আরেকজনকে দেখি ক্লাসে ঝিম ধরে বসে আসে। চোখ মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই দু’হাতে মাথা চেপে ধরছে। জানতে চাইলাম ঘটনা কি? জবাবে বলল, বারো কিলো বাড়তি ওজন ঝরাতে হবে ম্যাম। কিন্তু ডায়েট মেনে চলতে পারি না। এক্সারসাইজও দুদিন করি তো তিনদিন করা হয়না। তাই এক সপ্তাহে পাঁচ কিলো ওজন কমানোর একটা প্যাকেজ ফলো করছি। প্রথমদিন শুধু ফ্রুটস খেতে হবে। গতকাল সারাদিন শুধু ফ্রুটস আর পানি খেয়েছি। আজ দ্বিতীয় দিন। আজ শুধু ভেজিটেবল খাবো। সকাল থেকে গাজর আর শশা খেয়েছি শুধু। ওকে কি বলবো বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ চুপচাপ। আরেকজন নয় থেকে দশ ঘন্টা করে ঘুমাতো প্রতিদিন। হঠাৎ তার আত্নোপোলব্ধি হলো সে দিনের তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। এই হিসাব কিভাবে দেবে আল্লাহর কাছে? ব্যাস সে ছয় ঘন্টার বেশি না ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। যারফলে সারাদিনই ঘুমঘুম আবেশ ঘিরে রাখতো ওকে। শুধু সুযোগ খুজঁতো কিভাবে মাথা কোথাও রেখে চোখ বন্ধ করা যায় একটু। ওকে বললাম এটা তোমার শরীর, এল্যার্ম ক্লক নয় যে চাবি ঘুরিয়ে তিন ঘন্টা আগে সেট করে দিবে আর একই রকম সার্ভিস দেবে তোমাকে। আত্মউন্নয়নের জন্য করা নানান ধরণের রুটিন নিয়ে অথৈ সাগরে এমন হাবুডুবু খেতে দেখছি স্টুডেন্টদেরকে আজকাল। কেউ পড়াশোনার রুটিন ঠিক রাখতে পারছে না, কেউ চাইছে ঘুমের সময় কমাতে, কারো সময়কে গ্রোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে ভার্চুয়াল জগত, কেউ ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে পারিবারিক যোগাযোগের। এমন কেউ ওজন কমাতে চায়, কেউ বাড়াতে চায়। মোটকথা সবাই চাইছে ভারসাম্য রক্ষা করে আত্নউন্নয়ন করতে। কিন্তু আটকে যাচ্ছে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায়। স্টুডেন্ট লাইফের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি মনেহয় রুটিন মেইন্টেইন করে চলা। আসলে মনেহয় শুধু স্টুডেন্ট লাইফেই নয়। লাইফের প্রতিটা স্টেজেই রুটিন মেইন্টেইন করে চলাটা বেশ কঠিন বেশির ভাগ মানুষের জন্যই। যারা পারফেকশনিস্ট তাদের হিসাব আলাদা। আমাকে দিয়ে আত্নোউন্নয়ন মূলক সব কাজ করিয়ে নিতে পারলেও। নানান ধরণের শাস্তি দিয়েও ভাইয়ারা রুটিন মানিয়ে চলাতে পারতেন না ছোটবেলায়। শুধুমাত্র সময় মতো সালাত আদায় করা ছাড়া বাকি সব কাজে আমি আমার ইচ্ছে মতো করতাম। আমাকে যদি কেউ বলতো যে, এখন তুমি এই কাজটি করবে। আমি সেই কাজটি ছাড়া দুনিয়ার আর সব কাজ করে আসতে পারতাম। কিন্তু ঐ কাজটি করতে গেলে মাথা ঝিমঝিম করতো, কিভাবে কি করবো তালগোল পাকিয়ে একাকার করে ফেলতাম। এই অবস্থা দেখে একসময় ভাইয়ারা কিছুদিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাকে আমার মত। এরপর একদিন ভাইয়া বললেন, তোমার যেহেতু অন্যের করে দেয়া রুটিন মেনে চলতে সমস্যা হয়। সেহেতু এক কাজ করো তুমি নিজেই নিজের রুটিন তৈরি করো। আইডিয়াটা খারাপ লাগলো না। বেশ কয়েকদিন মেহনত করে নিজের জন্য একটা রুটিন তৈরি করলাম। কিন্তু ফলো করতে গিয়ে দেখলাম যখন ঘুমের সময় লেখা তখন কিছুতেই আমার ঘুম আসে না। যখন রুটিনে ফিজিক্স লেখা তখন আমার বায়োলজি পড়তে ইচ্ছে করে। যখন ইংরেজী লেখা তখন উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে করে। কয়েকদিন ট্রাই করে ঘোষনা করে দিলাম আমাকে দিয়ে আর যাইহোক রুটিন ফলো করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমার ভাইয়ারাও ছিলেন নাছোড় বান্দা। আমাকে রুটিন মোতাবেগ চালিয়েই ছাড়বেন। ভাইয়া পরামর্শ দিয়ে বললেন, তুমি লং টাইমের রুটিন করো না। প্রথমে একদিন দিয়ে শুরু করো। যদি একদিন তুমি সারাদিনের জন্য করে রাখা রুটিন ফলো করতে পারো তখন কিছুটা কনফিডেন্স আসবে নিজের প্রতি। এমন একদিন একদিন করে এক সপ্তাহ রুটিন মেনে চলো। এরপর দুদিনের টার্গেট নাও। এরপর তিনদিন, এরপর চারদিন। এভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে নিজের কাছে প্রুফ করতে চেষ্টা করো। একবার যদি তোমার ভেতরে এই কনফিডেন্স এসে যায় যে, তুমি পারবে রুটিন মেনে চলতে। তাহলেই বেড়িয়ে আসতে পারবে রুটিন ফোবিয়া থেকে। আমি এরপর তাই করেছিলাম। একদিন একদিন করে নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেছি রুটিনের সাথে। আগামীকালও রুটিন মেনে চলতে পারবো কিনা সেই চিন্তা একদম দূর করে দিয়েছিলাম মন থেকে। আগামীকালের চিন্তা আগামীকাল করা যাবে। আমি আগে আমার আজকের সব কাজ তো ঠিকমতো করার চেষ্টা করি। আমাকে হয়তো দশ তলায় উঠতে হবে। প্রথমেই কিভাবে উঠবো, এটা তো আমার দ্বারা সম্ভব নয়, আমি এটা কিছুতেই পারবো না। ইত্যাদি নেতিবাচক কথার দ্বারা নিরাশ না হয়ে বরং সিঁড়িতে পা রাখা উচিত। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে গেলে হাঁপিয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে তাই প্রতিটা সিঁড়িতে পা রেখে এক ধাপ করে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমত্তা। আমি কখনোই চিন্তা করিনি সপ্তাহের সাতদিনে আমাকে সাত কদম এগিয়ে যেতে হবে জীবন সফরে। বরং আমার টার্গেট ছিল প্রতিদিন এক কদম করে এগিয়ে যাওয়া গন্তব্যের পানে। সেই অভ্যাস আমার মাঝে এখনো বিদ্যমান আলহামদুলিল্লাহ। রুটিন মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যাবার পরও আমি অতীত রোমন্থন বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার চেয়ে বর্তমানকে কাজে লাগাতেই সচেষ্ট। গতকাল হয়তো আমি রুটিনে কোন একটি বা দুটি কাজ উল্টো পাল্টা করেছি। সেটি নিয়ে নিজেকে দোষারোপ বা নিজের স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় না করিয়ে আজকের রুটিন ঠিকমতো ফলো করতে চেষ্টা করেছি। আবার আগামীকাল হয়তো হঠাৎ কিছু কাজ এসে পড়েছে বা কোথাও যেতে হবে কিংবা কেউ আসবে আমার কাছে। রুটিন মেনে চলতে পারবো না ভেবে চিন্তিত না হয়ে কোন না কোন ভাবে অ্যাডজাস্ট করে নেবো এমন আশাবাদী ধারণা রাখার চেষ্টা করি। আবার মাঝে মাঝে দু’এক দিন এত বেশি থাকে এনার্জি লেভেল সেদিন আগিয়ে রাখা যায় রুটিনের অনেক কিছু। কিংবা পুষিয়ে নেয়া যায় জমে থাকা কাজ। আসলে রুটিন তো জীবনের সবকিছুতে সাজিয়ে গুছিয়ে সুন্দর করার লক্ষ্যেই। কিন্তু সেটাই যদি মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাড়াঁয় তাহলে তো অবস্থাটা মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত হয়ে যায়। তাই আমার মনেহয় যে, রুটিন সেটা খাবারের হোক, পড়ার হোক, ব্যায়ামের হোক কিংবা অন্য যে কোন বিষয়েরই। একদিনেই সেটার সাথে নিজেকে মানিয়ে চলানোর চেষ্টা না করানোই উচিত। বরং ধীরে ধীরে সেটার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করতে হবে। আবার দু’এক দিন যদি সব এলোমেলো হয়ে যায় তাতেও মন খারাপ করে হাল ছেড়ে দেবার কিছু নেই। বছরের ৩৬৫ দিনই একই রকম ভাবে কাটানো সম্ভব না এটাই স্বাভাবিক। নিজের বদভ্যাস সমূহ দূর করার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে কোন বদভ্যাস যেমন একদিনে শরীর ও মন বাসা বাঁধে না। তেমনি একদিনেই সেটিকে দূর করে দেয়াও সম্ভব নয়। এমন চেষ্টা করলে বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ হতে হয়। যারফলে মনোবল, নিজের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়। তাই বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে চলা। এক লাফে সিঁড়ির দশ ধাপ পেরোবার চেষ্টা করে ব্যর্থ বা নিরাশ হবার চেয়ে, প্রতি ধাপে কদমকে একটু করে মজবুত করে এগিয়ে চলাই উত্তম। একটি ধাপ পেরোনো মানে ছোট্ট একটি সাফল্যের আস্বাদন। যা ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাবে মূল সাফল্যের পানে ইনশাআল্লাহ.........

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ