
ক্লিপটোম্যানিয়া রোগটির সাথে আমার পরিচয় খুব মজার একটা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এক দূর সম্পর্কের কাজিনের বিয়ে ছিল। উনারা গাজীপুর থাকতেন সেই সুবাদে বিয়ের একদিন আগে আমরা সবাই গাজীপুর গেলাম।বিয়ের দিন সকালে আমি ড্রেসটা পড়বো সেটা বের করে রেখে একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি ড্রেস নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম বোনেরা মজা করে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু পরে সারা বাড়ি খুঁজেও ড্রেসটি আর পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে অন্য ড্রেস পড়েছিলাম বিয়েতে। এর দুই সপ্তাহ পরে সেই কাজিনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। দাওয়াত খেয়ে ফেরার সময় এক বোন ফিসফিস করে আমাকে বলল, তোর সেই ড্রেস পাওয়া গিয়েছে। তোর ড্রেসটা সাজ্জাদ ভাইয়ার ছোট শ্যালিকা চুরি করেছিল। আজ ওর রুমে ড্রেসটা দেখেছি আমরা। বিশ্বাস করতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিলো। কারণ চুরি করার কোন প্রয়োজন মাশফিয়ার ছিল না। কেননা কোন কিছুর অভাব তাদের ছিল না। এরপর আরো তিন-চার বার আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে যাবার সময় কিছু না কিছু না বলে নিয়ে গিয়েছিল মাশফিয়া। একসময় বড়দের কাছে পৌছে গেলো বিষয়টা। সাজ্জাদ ভাইয়া শুনে উনার ওয়াইফকে বললেন। ভাবী বললো উনার মাকে। আন্টি তো এইসব ঘটনা জানার পর খুবই লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করলেন। খুব বকাঝকা করলেন মাশফিয়াকে। বড়মামা তখন আমাদের বাড়িতে ছিলেন। বড়মামা একজন নিউরো সাইকোলজিস্ট। মামা তখন সবাইকে বুঝিয়ে বললেন, মাশফিয়া যেটা করছে সেটা আসলে চুরি না। এটা একটা মানসিক রোগ। যাকে ক্লিপটোম্যানিয়া বলে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অভাব বা লোভের কারণে চুরি করে না। বরং কোন কিছু ভালো লাগলে এরা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চৌর্যবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। এরা নিজেরাও বোঝে যে খুব খারাপ একটি কাজ করছে কিন্তু কিছু পছন্দ হলে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না চুরি করা থেকে।
ক্লিপটোম্যানিয়ার একজন ব্যক্তি কেন আক্রান্ত হন সেটার পেছনের প্রকৃত কারণ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে ধারণা করা হয় যে, মস্তিষ্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার সেরাটোনিনের কম নিঃসরণই মানুষের এই আচরণের জন্য দায়ী।ক্লিপটোম্যানিয়া সম্পর্কে বলার পর মামা মজার ছলে বলেছিলেন, কতই না ভালো হতো যদি এই মানসিক রোগটি একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের মানসিক ও আত্মিক উত্তম গুণাবলী চুরি করার ব্যাপারে উদ্ভুদ্ধ করতো। তাহলে আমি কিছু একটা করে আমার মস্তিষ্কে সেরাটোনিনের নিঃসরণ কমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। এবং বাড়ির প্রত্যেকের কাছ থেকে তাদের উত্তম গুণাবলী চুরি করে নিতাম আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। মামার কথা শুনে বাবা হাসতে হাসতে বললেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানোর জন্য এত কষ্ট করে মস্তিষ্কে সেরাটোনিনের নিঃসরণ কমানোর দরকার কি? তারচেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই পণ নিলেই তো হয় যে, আজ থেকে সবার উত্তম গুণাবলীর গুণে নিজেকে গুণান্বিত করার চেষ্টা করবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে করার চেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে করলেই না আরো বেশি লাভবান হওয়া যাবে এই ক্ষেত্রে। সবাই বাবার আইডিয়া শুনে অনেক মজা পেয়েছিল। আমিও মজা পেয়েছিলাম। কিন্তু মজার চেয়েও বেশি আকর্ষিত হয়েছিলাম আইডিয়াটির দ্বারা। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরছিল “সবার উত্তম গুণাবলীর গুণে নিজেকে গুণান্বিত করা” এই ভাবনাটি। আমার কাছে অনেকগুলো ডায়েরী ছিল। একজন একজন করে পরিবারের পছন্দের মানুষগুলোর নাম লিখলাম এককটি ডায়েরীতে। তারপর প্রত্যেকের ডায়েরীতে লিখতে শুধু করেছিলাম সেই ব্যক্তির মধ্যে যা যা উত্তম মনে হয়েছে আমার কাছে সেসব। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল আমার সবার উত্তম গুণাবলীর গুণে নিজেকে গুণান্বিত করার মিশন।
নিজে মেয়ে বলেই হয়তো মূল টার্গেট হিসেবে আমি বাবা, বাপী, চাচ্চু, মামা, নানাভাই, ভাইয়াদের বদলে মামণি, আম্মি, খালামণিদেরকেই বেছে নিয়েছিলাম। একদিন নানাভাই আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, কেউ যদি আমার চার মেয়েকে একসাথে দেখতে চায়, জানতে চায় তাহলে চারজনের কাছে আলাদা আলাদা যাবার দরকার নেই। শুধু আমার এই নানুমণিকে দেখে নিলেই হবে। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির একটি ছিল নানাভাইর সেই কথাটি। আর নানাভাইর চার কন্যার গুণে গুণান্বিত হতে গিয়ে আমি নিজের অজান্তেই সাংসারিক মনা হয়ে গিয়েছিলাম। মামণিকে দেখে আমি জেনেছিলাম নিজের স্বপ্ন ভুলে গিয়ে কিভাবে অন্যের স্বপ্নে রঙিন হয়েও ভীষণ আনন্দময় একটা জীবনযাপন করা সম্ভব হয়, মনে এতটুকু আক্ষেপ বা দীর্ঘশ্বাস লালন না করেও। আম্মিকে দেখে শিখেছিলাম কিভাবে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা গুলোকে অন্যের খুশির কাছে হাসিমুখে ত্যাগ করে দিতে হয়। মামনি আর আম্মিকে দেখেই অন্যের জন্য বেঁচে থাকার আনন্দকে উপলব্ধি করেছিলাম। কোন রকম প্রতিদানের আশা ছাড়াই ত্যাগের প্রেরণা পেয়েছিলাম। উনারা দুজন বুঝিয়ে বলেছিলেন মানুষের চেয়ে অসহায় প্রাণী পুরো দুনিয়াতে আর একটিও নেই। মানুষকে প্রতি মূহুর্ত টিকে থাকতে হয় আল্লাহর দয়া ও করুণার জোড়ে। আল্লাহ ক্ষমতা দেন বলেই কিছু করতে পারে মানুষ। সুতরাং, এমন অসহায় প্রাণীর কাছে প্রতিদানের আশা রাখা ঠিক নয়। প্রতিদানের আশা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপরই রাখা উচিত। মিলা খালামণি দেখিয়ে দিয়েছিলেন একটি মেয়ে কিভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অন্যায়ের সাথে আপোষহীন থাকতে পারে। খালামণি দৃঢ় কন্ঠে বলতেন, অন্যায়ের কোন বাবা-মা, ভাইবোন নেই। অন্যায়ের একমাত্র রিলেটিভ হচ্ছে শয়তান। তাই সম্পর্কের বাঁধনে অন্যায়কে মাপতে গিয়ে আমি শয়তানের দোসর হতে চাই না। সুতরাং, যেই করুক অন্যায় ইজ অন্যায় টু মি। খালামণির সবচেয়ে অসাধারণ গুণটি ছিল নামাজের প্রতি উনার ভালোবাসা। আযানের সাথে সাথে নামাজ পড়তেই হবে এটা ছিল উনার জীবন মরণ পণ। বলতেন, আখিরাতে আমার হিসাব আমাকেই দিতে হবে। সুতরাং, দুনিয়ার সবকিছুর আগে আমার সেই আমল যেই আমলের হিসাব আল্লাহ সবার আগে নিবেন। একদিন খালামণির ফজরের নামাজ ক্বাযা হয়ে গিয়েছিল ঘুম থেকে উঠতে না পারার কারণে। কোন বাচ্চার কাছ থেকে তার প্রিয় খেলনাটা জোড় করে কেড়ে নিয়ে গেলে যেভাবে চিৎকার করে কান্না করে সেভাবে কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন খালামণি ঘুম ভাঙার পর। শুধু বলছিলেন, নিশ্চয়ই আমার দ্বারা কোন বড় গোনাহ হয়ে গিয়েছে। যার কারণে আমি আজ আমার রবের সাথে সাক্ষাত করতে পারলাম না!(সুবহানাআল্লাহ) আমি খালামণির মত ঈমানদার হতে পারিনি জানি। কিন্তু চেষ্টা করে যাচ্ছি এই গুণটিকে নিজের মাঝে ধারণ করার।
রিমা খালামণিকে ঘরে বাইরে উভয় দিকই সামলে নিতে দেখে বুঝেছিলাম একজন ওয়ার্কিং ওম্যানও হতে পারেন আদর্শ গৃহিণী। প্রতিদিন বিকাল ছটায় অফিস থেকে ফিরতেন রিমা খালামণি। আমি সেইসময় সব কাজ ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শুধুমাত্র গাড়ি থেকে নেমেই খালামণি বলবেন, এই তোরা কেউ চা-নাস্তা দিস না কিন্তু তোদের খালুজানকে। উনার চা-নাস্তা আমি নিজ হাতে বানাবো। জানি না কেন রোজ শোনার পরও রোজই মুগ্ধ করতো খালামণির এই কথাটি আমাকে। খালুজান খুব পছন্দ করতেন খালামণি খাবার সময় উনার পাশে বসে থাকাটা। এটা সেটা জোড় করে প্লেটে উঠিয়ে দেয়াটা। আগে তো করেছিনই এখনো খালামণি অতি যত্নের সাথে এই কাজটি করে যাচ্ছেন। যতই অসুস্থ্য হোক না কেন খালামণি নিজ হাতে খালুজানের জন্য রান্না করবেনই করবেন। খালুজান একদিন বলেছিলেন, উনার আম্মু ছোটবেলায় উলের মাফলার বানিয়ে দিতেন নিজ হাতে। পরদিনই খালামণি উলের কাজ শেখা শুরু করেছিলেন মামণির কাছে। পরের শীতে শুধু মাফলারই না সোয়েটারও বানিয়ে দিয়েছিলেন নিজ হাতে খালুজানকে। একটা মেয়ে কিভাবে তার স্বামীর ছোট থেকে ছোট ইচ্ছে ও শখগুলোকেও বুকে আগলে ধরতে পারে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন রিমা খালামণি আমাকে। প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর তিলাওয়াত করার অভ্যাস ছিল বাবার। এজমার সমস্যার কারণে কিছুক্ষণ তিলাওয়াত করার পরই বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত মাঝে মাঝে। মামণি তখন বলতেন, দাও আজ তোমার হয়ে আমি তিলাওয়াত করে দিচ্ছি। বাবা তখন যে ভালোবাসার দৃষ্টিতে মামণির দিকে তাকাতেন। মামণির মুখে যে মৃদু হাসির রেখে ফুটে উঠেই সাথে সাথে মিলিয়ে যেত। দুজন সেই মূহুর্তেই অভিব্যক্তি ভাষায় প্রকাশ করার শব্দভান্ডার আমার কাছে অন্তত নেই। তবে আমি যতদিন দেখেছি অজান্তেই সুবহানআল্লাহ বেড়িয়ে এসেছে ভেতর থেকে। বাপী একটু রগচটা স্বভাবের। একটুতেই হৈচৈ বাঁধিয়ে দিতেন। কি নির্বিকার ভাবে যে বাপীর অকারণ অনর্থক রাগ, হৈচৈ মেনে নিতেন আম্মি। কিভাবে পারে এমন জানতে চাইলে আম্মি হেসে বলতেন, হয়তো আমি করিনি কিন্তু কেউ না কেউ তো নিশ্চয়ই রাগ করার মত কিছু করেছে। তার সাথে হৈচৈ করতে পারছে না বলেই আমার সাথে করছে। সেকথা জানি বলেই জবাব দিতেও যাই না। জীবনসাথী হয়েও আমিই যদি দূর্যোগ ও দুর্ভোগের মূহুর্তগুলোতে নীরব বা সরব হয়ে পাশে থাকতে না পারি তাহলে বেচারা কোথায় যাবে? তাছাড়া কিছুক্ষণ হৈচৈ করে রাগ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে নিজের এসে আবার সরি সরি করবে। তখন যদি বলি আধঘন্টা নীলডাউন করে বসে থাকো। তাতেও আপত্তি করবে না তোর বাপী। সুতরাং, শুধু শুধু রাগের সময় জবাব দিয়ে এমন বাধ্য স্বামীকে হাতছাড়া করতে যাব কোন দুঃখে।
মামণি, আম্মি আর খালামণিদেরকে দেখেই বুঝেছিলাম মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা সব ভূমিকাতেই মেয়েরা পুরুষদের জন্য মস্ত বড় এক আশ্রয়ের জায়গা।মেয়েদের সবচেয়ে বড় কোয়ালিটির একটি হচ্ছে, যে কোন অসহায় না দুর্বল পরিস্থিতিতে মায়া, মমতা, ভালোবাসা, স্নেহের ক্ষমতা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মনে নির্ভরতার আশ্বাস জাগিয়ে যাওয়া। আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞেস করে আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য কি? আমি হাসতে হাসতে জবাব দেই, আমার সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য হচ্ছে ক্লিপটোম্যানিয়া। স্বইচ্ছায় আত্মনিয়ন্ত্রিত ক্লিপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আমি এই চারজন অসাধারণ মানবীর ভেতর থেকে তাদের উত্তম গুণাবলী চুরি করার চেষ্টা করেছি প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে। উনারাই আমাকে দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন, বুঝিয়েছেন একজন আদর্শ জীবনসঙ্গিনীর কেমন হওয়া উচিত। আসলে বিয়ে নারী পুরুষ উভয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। যে অধ্যায় বৃহত্তর জীবনের শুভ সূচনা করে। জীবনকে পূর্ণতা দান করে বিকশিত করে। জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে, উপভোগ করতে শেখায়। বিয়ে মানুষের স্বভাবকে সুশোভিত করে চরিত্রকে মাধুর্যপূর্ণ করে তোলে। কিন্তু এইসব কিছুর সাথে সাথে বিয়ে একটি বিশাল বড় দায়িত্ব। জীবনের সব রঙে, সব রূপে মিলেমিশে একাকার হয়ে হাতে হাত রেখে এক সাথে পথ চলার অঙ্গীকার বিয়ে। স্বামী-স্ত্রীও যদি একে অন্যের দোষ-গুণ, ভালো-মন্দ, ব্যর্থতা, অপরাগতা ইত্যাদিকে মেনে নিয়ে পারে, তাহলে অনেক অপুর্ণতা স্বত্ত্বেরও গড়ে তোলা যায় সুখের সংসার। তাছাড়া সংসার মানেই আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মিলন মেলা। সংসারে শুধু সুখ কিংবা শুধু দুঃখ কোনটাই অবধারিত নয়। ঋতু বদলের মতো সুখ-দুঃখও পালাক্রমে আসতে থাকে সংসারে। আর এসবকে মেনে নিয়ে যারা পথ চলতে চেষ্টা করে তারা শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গড়ে নিতে পারে দুনিয়ার বুকে ছোট্ট এক টুকরো জান্নাত।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)