
সুন্দর নারী, শব্দটি শুনলেই মনে ঐশ্বরিয়া রায় কিংবা অ্যাঞ্জলিনা জলি কিংবা এমনই কোন মেদহীন সুন্দরী নায়িকার ছবিই মানসপটে ভেসে ওঠে। অনেক আগের কালের মুরুব্বিদের বিশেষ করে দাদী নানী শ্রেণীর মানুষরা যখন টিভি দেখেন, সুস্মিতা বা অন্য কোন হিন্দি ছবির নায়িকাকে দেখে অবাক নয়নে তাকিয়ে থেকে বলতে শুনেছি- এই মেয়ের দেখি পেটই নেই রে!
মানে, মাঝে মাঝে হয়তো স্বর্গের অপ্সরা ও মনে হয় এদেরকে।
কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। সচরাচর শতকরা ১০০ ভাগ নারীর মধ্যে এমন অপ্সরা বেশী হলে ২০-৩০ ভাগ হবে। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রমদেরই রোল মডেল হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছে আমাদের সামনে, যার প্রধান নিয়ামক পুঁজিবাদী মিডিয়া। যারা এক প্রকার নারী নিয়ে ধান্দাবাজির ব্যবসায়ই নেমেছে।
সে যাই হোক! প্রশ্ন হলো তাহলে কি মেদহীন দেহের দরকার নেই? খেয়ে খেয়ে কি ভুসভুসে পেট বানাবো!
না সেটা অবশ্যই বলছিনা। কিন্তু এই ডায়েট যেন হয় শুধুই স্বাস্থ্য সচেতনতার উদ্দেশ্যে। এই ডায়েট যেন শো অফের মানসিকতা, বা ঐ ২০ ভাগ নারী পণ্যের মতো হয়ে ওঠার জন্য না হয়!
আসলে ডায়েট কি দেয় আর কি নেয়, তা নিয়ে হিসাব কিতাব আমরা হয়তো করিই না। কিছু বাস্তব ঘটনা দেখেছি চোখের সামনে। এই চিকন হওয়া, মেদহীন নায়িকাময় দেহের জন্য ডায়েট এর বলি হতে দেখেছি অনেককে। একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা ঠিক আছে। কিন্তু সৌন্দর্য যখন স্বাস্থ্যের চেয়েও বড় হয়ে যায়, তখন ব্যক্তি কিন্তু মানসিক এবং শারীরিক ২ ধরনের চাপেরই সম্মুখীন হয়।
চলুন দেখা যাক আজকের লেখার কেস স্টাডি গুলো।
কেস স্টাডি -১
মাইশা ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্বাস্থ্য নেই বললেই চলে। কিন্তু ইদানিং বান্ধুবিদের কাছে শুনে শুনে বেশ ভয় ঢুকেছে মনে। বয়স বাড়তে থাকলে নাকি মেয়েরা এমনিই মোটা হয়ে যায়। তাই এখন থেকেই কঠোর ডায়েট এর কোন বিকল্প নেই। আর মা! মাকে দেখেই মাইশা বুঝেছে কি বিশ্রী দেখায় মোটা হলে। তাই এখন থেকেই কনট্রোলের তীব্র সাধ তার।
তো শুরু হলো তার ডায়েট। ডায়েট করতে যেয়ে সকালে আধাখান রুটি, দুপুরে একটা আপেল, আর রাতে না খেয়েই দিন কাটে মাইশার। একদিন ২ দিন ৩দিন! ৪ দিনের দিন কোচিং এ মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে!
বান্ধুবিরা ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে আসে। গ্যাসের ব্যাথায় মাইশা এখন বিধ্বস্ত।
কেস স্টাডি – ২
সদ্য বিবাহিতা মুনিয়ার দেহের গড়ন আগে থেকেই মাঝারি। কিন্তু স্বামী তাওসিফের চাহিদা একবারে ঐশ্বরিয়া। যদিও বাচ্চা হওয়ার পর ঐশ্বরিয়ার ও গাল ঝুলে পড়েছে। কিন্তু তাও কথায় কথায় এক তুলনা। এক চামচ ভাত খেতে হবে দিনে এই শর্ত সে নেট ঘেঁটে ঘেঁটে জুড়ে দেয়।
নতুন ঘরের দেয়ালে ভালোবাসার কথা লেখা না থাকলেও ডায়েট রিমাইন্ডার দিয়ে ভর্তি। নিজ দায়িত্বে তাওসিফ লিখে দিয়েছে। একটা জিরো ফিগার শো পিস তার চাইই চাই।
অফিস থেকে তওসিফ বাসায় ফিরে মুনিয়ার প্রিয় ফ্রাইড চিকেন নিয়ে। সারাদিনের ডায়েটে সারাক্ষণ ক্ষুধা ক্ষুধা একটা ভাব থাকেই। তওসিফ প্যাকেটটা তার হাতে দেয়, মুনিয়া আনন্দে খুলে দেখে, একটি মাত্র ফ্রাই। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তওসিফের দিকে।
-তোমার জন্য আনিনি। তুমি না অন ডায়েট!
রাগে কটমট করে মুনিয়া। ভালোবাসার মানুষটি এতো স্বার্থপর কীভাবে হয়?
কেস স্টাডি- ৩
দুই দুইবার সিজারে পেটে দাগ পরে গেছে তুলির। কিছুই করার নেই। পৃথিবীতে নতুন একটা প্রানের আগমনে কতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তা একজন মা ছাড়া কেই বা বুঝবে?
অনেকদিন বিশ্রামে থাকায় মেদ ও বেড়েছে তার। স্বামী বলে এবার বিছানা ছেড়ে ওঠো। এরপর আছে ডায়েট করা ফ্রি উপদেশ। কানের কাছে এক গান শুনতে আর কতোই বা ভালো লাগে। তাই একদিন ঘোষণা দিয়েই ডায়েট শুরু করে তুলি।
এরপর একসাথে খেতে বসলে এক চামচের যায়গায় ২ চামচ ভাত নিলেই স্বামী বাঁকা চোখে তাকায়।
-এহ হে! এই না সেদিন ডায়েট শুরু করলে? এতো খাচ্ছ যে?
সদ্য মা হওয়া তুলির এখন প্রচুর খাবারের চাহিদা। কিন্তু স্বামীকে তা বুঝানো সম্ভব নয়। মেয়ে মানুষের শরীর থেকে কি পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়, আর কেমন কষ্ট লাগে সেটা একটা মেয়ে ছাড়া কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। তুলি ডায়েট চালু রাখে। মা না খাওয়ায় বাচ্চার স্বাস্থ্য ও দিন দিন অবনতির দিকে যায়।
তুলিও খুব ভেঙ্গে পরে। প্রায় সময়ই তুলির বুকের ২ পাশ চাপ দিয়ে আসে। কেন এমন লাগে বুঝে উঠে না সে । আসলে যে গ্লুকোজের অভাবে এসিড জমে জমে ঘটনাটা হার্ট ফেইলিউর এর দিকে যাচ্ছে তুলি তা আঁচ করতে পারেনা। একদিন অতিরিক্ত ডায়েটের ফলে সত্যিই হার্ট অ্যাটাক হয় তুলির, সদ্যজাত সন্তানকে রেখেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে সে।
প্রিয় পাঠক, ডায়েট কন্ট্রোল বা পরিমিত আহার খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া সুস্থ থাকার। বেশীরভাগ সময়ই বিবাহিত মেয়েরা হুট করেই হয়তো একটু মোটা হয়ে যায়। এর পিছনে অনেকগুলো সামাজিক কারন বিদ্যমান। বাংলাদেশের সমাজে বেশীরভাগ মেয়েই মাঝারি গড়নের হয়। আর ভার্জিন বোতলের শেইপ তো সবাই দেখেছেন নিশ্চয়ই। মেয়েদের এমন আকৃতিতে বানানো হয়েছে যে অল্পতেই অনেক মোটা হয়ে যেতে পারে। তার মধ্যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও একটা বিষয়।
আর সত্যি কথা বলতে যে অনেকের মতে - সংসারে কোন কাজই নেই।
তারমানে কাজের কোন সীমা পরিসীমা নেই বলেই অনেক ছেলে ঢালাও বলে ফেলে- সারাদিন বাসায় কি করো! খাও আর ঘুমাও!
কিন্তু আসলে সংসার এক অজস্ত্র কাজের সমুদ্রের নাম। যেখানে কোন কাজই কাজ বলে গণ্য হয়না। আবার এইসব কাজ শেষে নিজের জন্য আলাদা সময় বের করা ও মুশকিল।
তাই ঐভাবে নায়িকাদের মতো শরীর গড়ার সময় আমাদের দেশের গৃহিণীরা পায় ও না।
ডায়েট ততোটুকুই করা উচিৎ যতোটুকু করলে একজন মানুষ রাস্তাঘাটে ফিট হয়ে যাবে না, হার্ট ফেইলিউর করবে না।
অতিরিক্ত ডায়েটের ফলে অ্যানিমিক হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। আর এই অতিরিক্ত ডায়েট করার প্রবণতাকে ANORESIA NERVOSA বলা হয়।
যে রোগে পশ্চিমা নারীরা বেশ ভুক্তভুগি।
এই মাত্রাতিরিক্ত ডায়েটের ফলে যে কেউ যে কোন সময় অ্যানিমিক হার্ট ফেইলিউর এর শিকার হতেই পারেন।
আমি অবশ্য ডাক্তারি বিষয়গুলোকে হাইলাইট করতে চাচ্ছি না।
ডায়েটের মানবিক দিকগুলো বিবেচনাই লেখার উদ্দেশ্য। অনেক স্বামীই ভাবেন- আমার বউ আমার চোখে সুন্দর দেখার জন্য ২/ ৪ বেলা না খেয়ে থাকতেই পারে!
অনেকে বউকে শো পিস ভাবেন। পার্টি, কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানে শো করার জন্য। তাই বউয়ের জিরো ফিগার একটা বিগ ফ্যাক্ট।
অথচ, বিয়ের যে উদ্দেশ্য শুধুই জিরো ফিগারের ভোগবাদ নয়, বরং সন্তান জন্মদান এবং তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সেটা অনেকেই ভুলে যান। আর সন্তান জন্মদানের শারীরিক যাবতীয় ধকল একটি মেয়ের উপর দিয়েই যায়। এবং এই এক ধকলের পরে সে চাইলেও পারেনা বিপাশা বসুর মতো ডায়েট চার্ট ফলো করতে, কিংবা কোমরে পরা সিজারের দাগগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে। পৃথিবীকে নতুন প্রাণ উপহার দেওয়ার বিনিময়ে প্রকৃতি নারীর অনেক কিছুই বদলে দিয়ে যায়। যা পুরুষের অনুধাবনের ঊর্ধ্বে।
গবেষণায় জানা গেছে – প্রতি ৫ জনে ১জন মহিলা সন্তান জন্মদানের পর তার স্বামীর কাছ থেকে ওজন কমানোর জন্য চাপ পেয়ে থাকেন।
ওয়েস্ট বারমিংহামের এক হসপিটালের ডাক্তার বলেন-“ সদ্য মা হওয়া নারীরা একদম অদরকারী চাপে ভুগে এমন একটা সময় যখন তাদের শারীরিক এবং আবেগজনিত বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে, এবং এই সময়টা ওজন কমানোর চেয়ে বাচ্চার সুস্বাস্থ্যের দিকেই নজর দেওয়া বেশী দরকার। ”
গবেষণায় এও দেখা গেছে যে- শতকরা ১ ভাগ পুরুষই বুঝে পায় না কেন বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই মেয়েদের শরীর আগের আকৃতি ফিরে পায়না!
কেট মিডল্টন মা হবার পর পশ্চিমা মিডিয়া যেভাবে তার বডি শেইপ নিয়ে লিখেছিল তা যে কোন সভ্য সমাজেই এক অবাক বিস্ময়ের বিষয় বটে।
তাই দেখা যায়, স্বামী যতোই ডায়েট নিয়ে মানসিক চাপ দেক, কিংবা মেয়েরা যতোই ডায়েট করুক, তার দেহ ঠিক নায়িকাদের মতো কখনোই হয়ে উঠে না, যেটাই মিডিয়ার মাধ্যমে আদর্শ নারী অবয়ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
এক্ষেত্রে অনেকে অজুহাত দেখান যে তিনি স্ত্রীর ব্যাপারে স্বাস্থ্য সচেতন তাই ডায়েট নিয়ে প্রেশার দেন। অথচ, সচেতন হওয়া আর স্বার্থপরতা এক জিনিষ নয়।
সচেতন হলে সবার আগে প্রাধান্য দিবে সুস্থতার উপরে, আর স্বার্থপর হলে সুস্থ অসুস্থ আহারি অনাহারি কোন বিষয় নয়, কোমরের মাপটাই বিষয়।
শারীরিক সৌন্দর্যের ধারনা যেন আমাদের স্বার্থপর করে না দেয় আমাদেরই সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির বিষয়ে। ততোটুকুই রক্ষণশীল হই, যতোটুকু জীবনসঙ্গীর জন্য কল্যাণকর। স্বার্থপর হয়ে শো পিস বানানোর আকাঙ্ক্ষায় আমরা যেন মানবিকতার সীমা লঙ্ঘন না করি। শেষ করছি Bertrand Russell এর বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে-
Diet, injections and injunctions will combine, from a very early age, to produce the sort of character and the sort of beliefs that the authorities consider desirable, and any serious criticism of the powers that be will become psychologically impossible. Even if all are miserable, all will believe themselves happy, because the government will tell them that they are so. ( The Impact of Science on Society 1953 )
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)