সাহিত্য

শত কোটি গল্পের ভীড়ে

শত কোটি গল্পের ভীড়ে
১. প্রভাত নিজেকে প্রকাশ করছে। শান্ত ও শুভ্রতার সমস্ত ধাপ পরিপূর্ণ করে প্রকাশিত হচ্ছে। স্নিগ্ধ হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। হালকা ঠান্ঠা বাতাস বুলিয়ে দিচ্ছে ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরে আসা মুসল্লীদের পবিত্র শরীরে। প্রভাতের রবি এখনও ওঠেনি, প্রভাত প্রকাশিত হচ্ছে, নিবিড় অনুগত হয়ে নিজেকে প্রকাশ করছে। আর ধীরে পরাজিত হচ্ছে ল্যাম্পোষ্টের জ্বালানো আলোগুলো কেমন মলিন ও মূল্যহীন হয়ে , পাজিত হতে চলেছে প্রভাতের আলোর কাছে। এরপর পরিপূর্ন সকাল আগমণে ল্যাম্পপোষ্টের আলোগুলো ব্যার্থ হয়ে গেলো। আর এ মুহুর্তে ঐ লাইটগুলোকে পরাজিত সৈনিকের মতো মুখ গোমড়া লাগছে।...... দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আনিকা আনজুমের দু গন্ড বেয়ে, কোমল কন্ঠে বললো, -মণিকা তুই যত সুন্দর করে বর্ণনা করছিস দেখতে বোধ হয় তার চেয়ে আরো সুন্দর তাইনারে? মণিকা মমতাজ বোনের অশ্রু মুছে দেয়, -তুমি ঠিকই বললে, এই সৌন্দর্য কোন ভাষা দিয়ে খুব কমই প্রকাশ করা যায়, তুমি সত্যিই বুঝেছো, আসলে কী বলোতো তোমার উপলব্ধি শক্তিটা বেশ প্রখর! আর হ্যা ভেবে নিওনা আমি এা বলার জন্য বলছি.... আনিকা ও মণিকা বেলকণিতে বসে আছে। ওরা দুবোন জমজ এক ঘন্টার ছোট বড়। আনিকা এক ঘন্টা আগে জন্মেছে। আনিকা অনার্স থার্ড ইয়ারের ষ্টুডেন্ট, বায়ো কেমিষ্ট্রিতে অনার্স করছে। মণিকা মেডিকেলে,  ওদের বাবা হারিয়ে গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে, আনিকার মায়ের সাথে রাগ করে সেই যে বের হয়ে গেছেন আর ফেরেননি। ওদের বাবা আফসার উদ্দিন একজন নামকরা ব্যারিষ্টার ছিলেন। ওদের মা রোকেয়া আফসার স্বামী চলে যাবার পর অনেক কষ্টে মেয়েদেরকে বড় করেছেন। কিন্তু দু বছর আগে তিনিও ওদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। ওরা ওদের নিজেদের বাড়িতেই আছে, অভিভাবক হিসেবে ওদের সাথে আছেন, এক চাচা। এখনও বিয়ে করেননি। আনিকারা আশুলিয়ায় থাকে, দুতলা এক বিল্ডিং ওরা জন্মের পর থেকেই দেখছে। ওরা ইদানিং রেগুলার ফজরের নামাজ পড়ে, বেলকণিতে বসে থাকে। আনিকা অন্ধ হওয়ায় কিছুই দেখতে পায়না কিন্তু মণিকা সাধ্যমতো সমস্ত সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে থাকে। আনিকা মলিন কন্ঠে আবারও বললো, -চোখ যখন ছিলো তখনতো সকালটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি, আর এখন এই সৌন্দর্য দেখতে চেয়েও দেখা হচ্ছেনা...... মণিকা আনিকার হাত চেপে ধরে, -থাকনা আনিকা ওসব, আমরা আমাদের ভুলতো বুঝতে পেরেছি, এখন আর ভূল না করলেই হল তাইনা...... আচ্ছা চলো চাচা মনে হয় নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আনিা উে দাঁড়ানোর সময়, -চাচা কী বের হয়েছেন? -না মনে হয় বের হলেতো বলে যাবার কথা। টেবিলে বসলো আনিকা আর মণিকা। আনিকার কন্ঠে সামান্য উৎকন্ঠা ঝরে পড়ে, -মণিকা প্রতিদিন যাতায়াতে তোর অনেক কষ্ট হয় তাইনা? তারচেয়ে হলে থাকায়তো ভালো...... মণিকা আনিকার প্লেটে পরোটা তুলে দিয়ে, -তুমি কী এবার চুপ করবে? এককথা বারবার বলে কী প্রমান করতে চাও হ্যা? এইতো যে আমার সাথে থাকে তোমার ভালো লাগেনা......... মলিন কন্ঠ আনিকার, -তাই বললাম কী? -না বলোনি, কিন্তু এই যে আমা দুবোন একসাথে এতোটা সময় থাকতে পারছি, দুজন দুজনের খুব ভাল বন্ধুওতো তাইনা? আমি সত্যি বলছি যাতায়াতের কষ্ট আমার কাছে কিছুই মনে হয়না, ভোরবেলা কোনরকম জ্যাম থাকেনা, বলেই এতো আগে বের হই। শুধু ফেরার সময় জ্যাম বেশী থাকে, তবে বাসায় ফিরে তোমাকে দেখলেই সব কষ্ট শেষ...... ওদের চাচা আকরাম উদ্দিন চুল ঠিক করে রুম থেকে বের হন, -কী কথা হচ্ছে দুজনের? যে কথায় হোক কাউকে কিন্তু আমি আমার কাছ ছাড়া হতে দেবনা বলে দিলাম হু! মণিকা হাস্সোজ্জবল কন্ঠে, -হ্যা চাচা সেটাই বুঝাও তোমার মেয়েকে। আকরাম উদ্দিন মুখের খাবার শেষ করে, -আনিকা কলেজ যাবেনা? -না চাচা, আজ ভালো লাগছেনা, আর আমি কলেজ গেলে মণিকার আমাকে কলেজে দিয়ে তারপর মেডিকেলে যেতে হয়, অনেক সময়ের ব্যাপার... মণিকা অভিমানী কন্ঠে, -তুমি আজ এসব কেন বলছো? ফরমাল কথা তোমার মুখে মানায়না আনিকা! আকরাম উদ্দিন চায়ে দুবার চুমুক দেন, ওদের দুবোনের কথার বিষয়ে কিছুই না বলে, -নতুন নোটসগুলো কী রেকর্ড করে দিয়েছো মণিকা? উঠে দাঁড়ায় মণিকা, -হ্যা চাচা দিয়েছি, তবে দুটা বাকী আছে, আজ ফিরে এসে করে দেবো। দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে রেডী হয়ে, বের হয় মণিকা। আকরাম উদ্দিনও বেরুবার আগে বুয়াকে লক্ষ্য করে, -বুয়া আনিকার প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে যেও, আর আনিকা আমি বা মনিকা বাসায় ফিরলে তোমাকে কল দেবো, তাঁর আগে শুধু কলিং বেল বাজলে দরোজা খুলবেনা। আিকা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে। ২ আনিকা বুয়াকে গেট লাগাতে বলে নিজের রুমে গিয়ে অনেক দিনের পুরনো এক ক্যাসেট প্লেয়ার অন করে, যেটাতে ওর পড়ালেখাগুলো রেকর্ড করা আছে, পরশুদিন মণিকা দুটো  নোট রেকর্ড করে দিয়েছে, সেগুলো  শিখতে হবে তাই। আনিা এভাবেই পড়ালেখা চালিয়ে আসছে গত চার বছর ধরে, অনেক কষ্ট হলেও সে করছে, ব্যাবহারিকগুলোতে ওর ফ্রেন্ডরা টিচাররা খুব হেল্প করেছে।  আনিকার খুব প্রিয় একজন টিচার তানিয়ে তানভীর মাঝে মাঝে বাসায় এসে ওকে হেল্প করে যান, শিখিয়ে দিয়ে যান। প্রায় দু তিন ঘন্টা পর আনিকা পড়া শেষ করে, বুয়াও কাপড় ধোয়া বাসন মাজা ঘর মোছার কাজ শেষ করে আনিকার কাছে এসে, -খালা কি রান্না হইবে? -ফ্রিজে কি কি আছে? বুয়া আয়েশ করে বলতে শুরু করলো, -ইলিশ মাছ, শিং মাছ, মুরগী, খাসির মাংস, কাঁচ কলা, বেগুন, ঢেড়স এরপরে............. -থাক থাক আর বলতে হবেনা, খালা তুমি ঢেড়স ভাজি করো, ডাল, সর্ষে ইলিশ আর বেশী ঝাল দিয়ে খাসির মাংস। আমি গোসল করতে গেলাম। আনিকা বাথরুমে ঢুকলো আর বুয়া রান্নাঘরে। রান্না শেষ করে বুয়া আনিকার জন্য খাবার রেডি করে টেবিলে রেখে দিলো, আনিা বুয়াকে লক্ষ্য করে, -খালা তুমি খেয়ে যেও। -আইচ্ছা। আনিকার হঠাৎই খুব মন খারাপ হলো, টিভি দেখা, ম্যাগাজিন পড়া, মূলত বিনোদনের কোনটাই আনিকা নিতে পারেনা। ওর অন্ধ হয়ে যাওয়ার দিনটি খুবই মারাত্মক, যেদিনটির কথা আজও আনিকার মনে পড়ে। সেসময় ওদের ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা শেষ হয়েছে, মণিকাও একই সাথে পড়তো। সেদিন ওরা ম্যাথ টিচারের কাছে পড়তে যাচ্ছিলো, সিড়ি বেয়ে স্যারের বাসায় যাচ্ছিলো। হঠাৎই অদৈত বর্মন নামে একজন নামছিলো। ছেলেটি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিলো কিনা সেই মুহুর্তে আনিকা তা বুঝতে পারেনি, শুধু মনে পড়ে ছেলেটির ডানহাতের তালু আনিকার মুখমণ্ডলে পড়েছিলো আর প্রচন্ড এক ধাক্কা খেয়ে আনিকা গড়তে গড়তে নিচে পড়ে যায়। তবে আনিকা ধারণা করে ছেলেটি ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিয়েছে, কারণ সে একটা সরি পর্যন্ত বলেনি। আনিকার চোখে জমানো জলগুলো টপটপ করে ঝরছে........ ঘড়িতে দুটা বাজার সংকেত কানে যায় আনিকার, যোহরের নামাজের জন্য জায়নামাজে দাঁড়ায়। বিকাল ৫টা। বুয়া আনিকাকে বড় এক মগ ভর্তি কফি দিয়ে গেছে। বেলকনিতে বসে বেশ আয়েশ করে পান করছে। ওর মোবাইলটা ড্রয়িং রুমে, তাই প্রথম বারেই কল রিসিভ করতে পারলোনা। এবার কলের অপেক্ষায় ড্রয়িং রুমেই বসলো, কিছুক্ষণ পরে আবারো কল আসায় রিসিভ করলো, -হ্যালো! কে? -আমি তোমার তানিয়া ম্যাম, কেমন আছো আনিকা? -এইতো ম্যাম, আপনি কেমন আছেন? আপনি কী আজ আসছেন? -হ্যা আমি এইতো তোমাদের বাসার পাশেই। একটু পরেই উনি চলে আসায় আনিকা গেট খুলে ওনাকে ভেতরে বসালো, আনিকাও বসতে বসতে, -ম্যাম পার্টিতে গেলেননা? -না মনটা ভালো নেই, তোমর ব্যাবহারিক গুলোর কী অবস্থা? আনিকা বিস্মিত হলো, কারণ তানিয়া তানভীর ওর ব্যাবহারিকগুলো পুরো কমপ্লিট করে দিয়েছেন, তবুও হাস্সোজ্জ্বল কন্ঠে, -এইতো এখন নিজে নিজে পারি, ম্যাম আপনি কী বাড়ি থেকে আসছেন? কোন উত্তর না আসায় ভয়ে চুপসে যায় আনিকা, ভীত ও কাঁপা গলায়, -ম্যাম আপনি কোথায়? তবুও উত্তর নেই। আনিকা নিজের করনীয়টা বুঝে উঠছেনা, ধীরে ধীরে নিজের রুমে ঢুকলো, তখনই মহিলাটি ক্লোরোফরম মিশ্রিত রুমাল ওর নাকে চেপে ধরলো আর আনিকা সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। আর মহিলা তন্ন তন্ন করে কিছু একটা খুঁজে থাকে, ওয়ার্ডোবের দ্বিতীয় ড্রয়ারে কিছু কাগজপত্র রাখা আছে, সেগুলো উল্টে পাল্টে খুঁজতে গিয়ে একটা সাদা কাগছে আঙ্গুলের টিপছাপ দেখতে পেয়ে কাগজটা ভাঁজ করে নিয়ে নিলো। আর সবশেষে পেলো একটা দলীল, নিজের বাবার স্বাক্ষর করা দলীল, স্বাক্ষের জায়গায় নামটি স্পষ্ট নারায়ন ভট্টাচার্য! আর সেটা পেয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেলো। চলবে.....................

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)