
হাসান সাহেব প্রচুর টাকার মালিক। বসুন্ধরায়২ টা ইলেক্ট্রনিক্স শপ থেকে মাসে আয় হয় ৫০ লাখ টাকা। সদরঘাটে একটা চিনির আর একটা বরফের কল আছে তার। এছাড়াও কার্পেট এর ব্যাবসা আছে, মিরপুরে তার নিজের একটা বিশাল রেস্টুরেন্ট আছে। সব মিলিয়ে মাসে কয়েক কোটি টাকা আয় তার।
কিন্তু বড়লোক হলেও তিনি দান খয়রাত তেমন করেননা । তার অবশ্য নিজের কিছু যুক্তি আছে এই বিষয়ে। প্রথমত তিনি মনে করেন তিনি এই সম্পদ কষ্ট করে উপার্জন করেছেন তার থেকে এক পয়সাও মানুষকে বিনে কষ্টে দেওয়া ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত , তিনি বছরে একবার জাকাত দেন , কিন্তু সদকা করাতো ফরজ নয় তাইনা!
আসুন , দেখে নেই তার জাকাত দেওয়ার ধরণ । হাসান সাহেব যাকাত দেন ২০ টা শাড়ি। তার সম্পদের পরিমাণ, ব্যাংকে কতো টাকা আছে এসব কিছুই তার হিসাবের দরকার হয়না। প্রতি বছর মার্কেট থেকে মিসেস হাসান সবচেয়ে কম দামী, ফ্যারফ্যারা কতো গুলো যাকাত শাড়ি কিনে আনেন।এই দিয়ে তিনি যাকাত দিয়ে দেন। কিন্তু সেই যে এক বছর পরিমাণ সময়ে নিসাব পরিমাণ মালে যে আড়াই শতাংশ হারে যাকাত দিতে হয় তা তারা কিছু মনেই করেন না।
যাকাতের হিসাব নিকাশ ও ঠিক মতো যাকাত দেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হওয়ার কারন কি? এর কয়েকটা কারন হতে পারে-
১ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসবাস করার কারনে গরীব দুঃখীর কষ্ট অনুভব করতে না পারার ব্যর্থতা।
২ সম্পদের মালিকানার ধারনায় ভুল। নিজেকে নিজের সম্পদের মালিক ভাবা।
৩ যাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা গড়ে না তোলা।
৪ রাষ্ট্রীয় ভাবে যাকাত তোলার সুনির্দিষ্ট কঠোর নীতিমালা না থাকা।
৫ রাষ্ট্রীয় ভাবে যাকাত বণ্টনের ব্যাবস্থা না থাকা।
৬ যাকাত কে নিছক ভিক্ষা মনে করা। যেখানে যাকাত শুধু দান ই নয় , ধনীর সম্পদে গরীবের অধিকার ও বটে ।
৭ যাকাতের যোগ্য ব্যক্তিদের সনাক্ত করতে না পারা
৮ যাকাতের জন্য নিম্ন মানের কাপড় কেনা
৯ যাকাতে কিছু শাড়ি লুঙ্গি দিয়ে দ্বায় মুক্ত হওয়া ।
আসলে যাকাত কেন দিতে হবে , আমাদের সমাজের মানুষ তাই বুঝেনা। সকল সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা । পৃথিবীতে তিনি মানুষের ভোগ করার জন্য প্রচুর সম্পদ দিয়েছেন। এরমধ্যে কিছু মানুষ হয়তো বুদ্ধি কিংবা মেধার বলে অধিক সম্পদ উপার্জন করে। কিন্তু তাই বলেই সে সেই সম্পদের যথেচ্ছা ব্যাবহার করতে পারেনা। তাকে অবশ্যই সেই সম্পদ তার প্রকৃত মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ করতে হবে। শুধু মাত্র এই সম্পদের মালিকানার ধারনায় পরিবর্তন আমাদের সমাজের অর্থনীতির আমুল পরিবর্তন সাধন করতে পারে, রোধ করতে পারে অর্থের অপচয়।
যাকাত সম্পদের মালিকানায় ইসলামী মতবাদের অন্যতম একটা ভিত্তি, যার মাধ্যমে আসলে বুঝা যায় আমরা সম্পদের মালিকানায় আল্লাহ্র প্রভুত্ব কতো খানি স্বীকার করছি।
তাই যাকাত দান নয়, ভিক্ষাও নয়। যাকাত হোল ধনীর সম্পদে গরীবের অধিকার।
মন চলে যায় খেলাফায়ে রাশেদিনের সেই যুগে। যখন মানুষ পরিপূর্ণ ভাবে যাকাতের নীতিমালা মেনে চলায় আরবে যাকাত গ্রহণ করার কোন লোক ছিলনা। আজকে সমাজে এতো ক্ষুধা দারিদ্র্য বঞ্চনার কারন কি? কারন একটাই । সেটা হোল যাকাতের নিয়ম কে মনগড়া বানিয়ে যার যার ইচ্ছামতো লুকোচুরি করে যাকাত দেওয়া।
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির মেরুদণ্ড । হজরত ওমর (রা) বলেছেন- যখন দিবে , ধনী করে দাও।
এই মর্ম বানী আজ কেউ বুঝেনা।
ঈদের সময় আসলে যাকাতের কিছু নিম্ন মানের শাড়ি বিতরণ করেই আমাদের দায়িত্ত শেষ করি । কিন্তু আসলেকি এভাবে যাকাত দিতে হয়? যাকাত দিতে হবে এমন ভাবে এমন ব্যক্তিকে যাতে তার আর পরবর্তীতে যাকাত না নেওয়া লাগে, যাতে সে এই যাকাতের অর্থ দিয়ে কিছু করে খেতে পারে, তার নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুঃস্থ মহিলাদের সেলাই মেশিন দেওয়া, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করা, ছেলেদের কে ছোট মুদির দোকান করে দেওয়া কিংবা রিকশা কিনে দেওয়া, মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের পড়ালেখার জন্য নগদ অর্থ দেওয়া , তাদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ছাড়াও আরও অনেক ভাবেই যাকাতের যোগ্য ব্যক্তিদের যাকাত দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কিন্তু একবার ভেবে দেখু... , যাকাতের ওই নিম্ন মানের কিছু শাড়ি দিয়ে অভাবী দুঃস্থ মানুষগুলোর কতো টা উপকার হয়? মাস ঘুরতে না ঘুরতেই ওইসব শাড়ি ছিঁড়ে যায়। আর তারাও গালি দেয় মনে মনে এই ভেবে যে যাকাতের শাড়ি বলেই এগুলোর এই দশা। কিন্তু , তারা কি আমাদের ভাই বোন নয়? তাহলে আমরা নিজেদের জন্য যে কাপড় পড়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা তা তাদের কীভাবে দেই?
আর সবচেয়ে বড় কথা হোল কোন রকম হিসাব নিকাশ ছাড়াই গণহারে যাকাতের শাড়ি দিয়ে দিলেই যাকাত আদায় হয়ে যায়না। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হোল দারিদ্র্য বিমোচন করা। সমাজ থেকে ক্ষুধা দারিদ্র্যকে চিরতরে নির্বাসন দিতেই যাকাতের আবেদন।
তাই তো আমাদের চেতনার কবি আহ্বান করেছিলেন –
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের ও ভাগ আছে ও পেয়ালাতে।
ভোগীদের উদ্বৃত্ত অন্নে আছে অধিকার ,
এই পৃথিবীতে ক্ষুধিতের , এ যেন আল্লাহ্র ফরমান।
মোরা শুধু জানি , যার ঘরে ধন রত্ন জমানো আছে
ঈদ আসিয়াছে , যাকাত আদায় করিব তাদের কাছে ।
যক্ষের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা জমাইয়া যারা ,
খোদার সৃষ্ট কাঙ্গালে যাকাত দেয়না , মরিবে তারা ।
ইহা আমাদের ক্রোধ নয় , ইহা আল্লাহ্র অভিশাপ,
অর্থের নামে জমেছে তোমার ব্যাংকে বিপুল পাপ।
মন খুলে আজ দাও যাকাত
করোনা হিসাব , হিসাবী হৃদয়ের অঙ্কপাত।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)