
ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার গ্রামে ঈদ করা হয়েছে। কোরবানী ঈদের সময় অনেক আনন্দ করলেও রামাদানে গ্রামে গেলে ভীষণ মনখারাপ হতো আমাদের বোনদের। কারণ তখন আমরা অনুভব করতাম যে আমরা আসলে অনেক গরীব। আমি ছোটবেলায় একটু বেশিই ইমোশনাল ছিলাম। তাই নিজেদের গরীব ভেবে বোনেরা মনখারাপ করে ক্ষান্ত দিলেও আমি চুপিচুপি কান্নাও করতাম। আমরা যে ভীষণ গরীব এই উপলব্ধিটা করিয়েছিলেন আমাদের পাশের বাড়ির চাচা। যাকাত দেবার জন্য উনি ট্রাক ভর্তি করে শাড়ি, লুঙ্গি ইত্যাদি আনতেন আর গ্রামের সব অভাবী মানুষদের মাঝে বিতরণ করতেন। কিন্তু আমাদের বাবা-ভাইয়ারা এমন কিছুই করতেন না। আমাদের যাকাতের অর্থ দুই-চারজন করে মানুষকেই দেয়া হতো প্রতিবছর। তাই নিজেদেরকে গরীব ভেবে মনখারাপ করা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না আমাদের জন্য।
সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ফুটে ওঠে। নিজেদের ভাবনাকে দিয়েই বুঝতে পারি বাচ্চাদের মন আসলে কত সহজ সরল থাকে। বাচ্চারা যা দেখে সেটাকে কেন্দ্র করেই একটা ভাবনা তৈরি করে ফেলে মনে। ঘটনার গভীরতা চিন্তা করে দেখে না। আমাদের মনের এই ভাবনা জানতে পেরে বাবা বুঝিয়ে বলেছিলেন, ট্রাক ভর্তি করে সবাইকে শাড়ি-লুঙ্গি দেবার চাইতে যাকাতের সমূদয় টাকা একজন বা দুইজন মানুষকে দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করাটা অনেক বেশি উপকারী। এতে সমাজ থেকে খুব ধীরে হলেও অসহায়ত্ব কমানোর একটা সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হচ্ছে এই আশাটা রাখা যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে একজন মানুষকে হলেও দারিদ্রের কষাঘাত থেকে বের হতে সাহায্য করা গিয়েছে এই তৃপ্তি ও প্রশান্তিতে স্নাত হওয়া যায়।
আলহামদুলিল্লাহ এখন এই কনসেপ্টটি আশেপাশের অনেকের মধ্যেই দেখতে পাই। বেশ কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিলো কিছু বোনের সাথে। তারাও ঠিক এভাবেই বলছিলেন, দশজন মানুষকে যাকাতের দশ হাজার টাকা দেবার চাইতে একজনকে সেটা দিয়ে তাকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করাটাই অনেক বেশি কল্যাণকর। উনাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ছোটবেলার স্মৃতি মনের কোণে উঁকি দিয়ে একরাশ ভালো লাগা ছড়িয়ে গিয়েছিল। সেদিন বোনেদের সাথে রামাদান মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ইসলামে রামাদান মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। তাই কোন মুসলিম এই মাসটিকে হেলায় হারাতে পারে না। বলা হয় প্রতিটা কাজ বা ব্যবসার যেমন নির্দিস্ট একটা মৌসুম থাকে রামাদান মাস তেমন নেক আমলের মৌসুম।
কোন একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম, “ কৃষক যেমন ফসল কাটার মৌসুমে তার গোলা ভর্তি করে নেয়, ব্যবসায়ী তার মৌসুমে পর্যাপ্ত মুনাফা করে আগত দুঃসময়ের ব্যবস্থা করে নেয়, তেমনি আল্লাহর বান্দারা মাহে রামাদানে তাদের নেক আমলের ভান্ডার পরিপূর্ণ করে নেয়।” এত চমৎকার লেগেছিল এই কথাটা। মনে হয়েছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে জরাগ্রস্ত মানুষগুলোর জন্য নিজ নিজ নেক আমলের ভান্ডার পরিপূর্ণ করে নেবার অসাধারণ একটি সুযোগ এটি। এই মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জান্নাতের দরজা খুলে দেন, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেন, শয়তানকে শিকলে বেঁধে ফেলেন। জান্নাতের দরজা খোলা, জাহান্নামের দরজা বন্ধ এবং শয়তান শিকলে বন্দি। এরচেয়ে সূবর্ণ সুযোগ আর কি হয়ে পারে একজন মুসলিমের জন্য?!
“শাহরু রামাদানাল্লাযি উনযিলা ফীহিল কুরআন”। রামাদান হচ্ছে সেই মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আর কুরআন হচ্ছে সেই পবিত্র গ্রন্থ যার মাধ্যমে আমরা জানি আমাদের জন্য আল্লাহর বলে দেয়া নির্দেশনাবলী। ইসলামের ইতিহাসের দুই যুগান্তকারী বিজয়ঃ বদর ও মক্কা বিজয় রামাদান মাসেই সম্পন্ন হয়। এই মাস তাই শুধু কুরআন নাজিলের মাসই নয়, এই মাস জিহাদ আর বিজয়ের মাসও। ছোটবেলায় যখন জেনেছিলাম রামাদান মাস জিহাদ আর বিজয়ের মাস খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বদর ও মক্কা বিজয় তো রাসূল(সঃ)আর সাহাবীগণ করে ফেলেছেন। আমি তাহলে এখন কি করবো? আমার কথা শুনে ভাইয়া হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তাকওয়া অর্জনের জন্য নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যাতে নিজেই নিজের মাথায় বিজয়ীর মুকুট পড়িয়ে দিতে পারো এই চেষ্টা করো তুমি।
বেশ কয়েক বছর হলো কিছু প্রবাসী ভাইবোনকে একত্রিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে আত্মউন্নয়নের পথে যাত্রা শুরুর। প্রতি বছরই রামাদান উপলক্ষ্যে স্পেশাল প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা থাকে প্রত্যেকের। অভিজ্ঞতা হচ্ছে সবার বেশীর ভাগ পরিকল্পনাই অসমাপ্ত থেকে যায়, কিছু মোটামুটি বাস্তবায়ন করা হয় আর দু’একটা শুধু পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। গত দুইবছর আগে রামাদান শেষে সবার রিপোর্ট দেখে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এসেছিল ভেতর থেকে। মনে হয়েছিল টিচার বা গাইড হিসেবে আমি হয়তো ভালো না তাই আমার স্টুডেন্টদের অগ্রগতি শুধু পরিকল্পনা আর প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ বাস্তবায়নে নয়। আমার ভাইবোনদের সাথে কথা বলার পর জানলাম তাদের স্টুডেন্টদেরও প্রায় একই অবস্থা।
হতাশ হয়ে যখন সবকিছু ছেড়ে দেবো কিনা ভাবছিলাম বড়ভাইয়া বুঝিয়ে বললেন, ছেড়ে দেবার আগে একবার তোমার স্টুডেন্টদের অবস্থানে নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করে দেখো। ভেবে দেখো দশ-বারো ঘন্টা করে ডিউটি করে সবাই। এই প্রচন্ড গরমে সতেরো-আঠারো ঘন্টা ঘরে এসির মধ্যে বসে সিয়াম পালন করা তোমার জন্য যতটা সহজ অন্যের চাকরি করা তোমার স্টুডেন্টদের জন্য ততটাই কঠিন। তুমি চাইলে কাজ থেকে একমাস ছুটি নিয়ে নেক আমলের মৌসুমকে কাজে লাগাতে পারো। কিন্তু এখান থেকে টাকা পাঠালে দেশে পরিবারের ঈদ হবে এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে ইচ্ছে থাকা স্বর্ত্বেও সম্ভব না নেক আমলের এই মৌসুমকে পরিপূর্ণ কাজে লাগানো। প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে সমাধান কি?
ভাইয়া জবাবে বলেছিলেন, সমাধান একটাই প্রত্যেকে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেবে নিজ নিজ যোগ্যতা, সুযোগ-সুবিধা এবং প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে। যেমন ধরো, যে ব্যক্তি কুরআন পড়তে জানে না সে যদি কুরআন খতমের পরিকল্পনা নেয় তাহলে সেটা বাস্তবায়িত হবে না এটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক তেমনি নারীদের ও পুরুষদের রামাদানের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা একরকম হবে না। একজন ব্যবসায়ী ও একজন চাকরিজীবীর প্রস্তুতি ও পরিকল্পনাও ভিন্ন হতে হবে। চাকরিজীবী নারী ও গৃহিনীদের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনাও আলাদা হবে। যে মায়ের সন্তান ছোট আর যার সন্তান মোটামুটি বড় হয়ে গিয়েছে তাদের মাঝেও থাকতে হবে ব্যতিক্রম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। বয়স্ক ও শিশুদের ক্ষেত্রেও এই একই নিয়ম। সবাই যদি নিজ নিজ জীবনযাপনের সাথে ভাসসাম্য রেখে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেয় তাহলে সেটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কেননা একজন মানুষকে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি পেড়োতে বললে সে এক লাফে তিন বা চার ধাপ করে পেড়িয়ে গেলেও অনাভ্যাস আর অতি পরিশ্রমের কারণে খুব বেশি দূর এগোতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক।
এরপর থেকে আর রামাদানের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার উপর বিশাল নোট রেডি করে দেইনি কখনোই আমার স্টুডেন্টদেরকে। রামাদান মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত নিয়ে আলোচনা করার পর সবাইকে বলেছি নিজ নিজ জীবনযাপনের সাথে ভারসাম্য রেখে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা তৈরি করে নিতে। আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই আসলে সঠিক পদ্ধতি। একগাদা পরিকল্পনা নিয়ে কোনটাই ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে না পারার চাইতে এমন পরিকল্পনা নেয়া যার দ্বারা নিজের আমলের পাল্লা ভারী করার সাথে সাথে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পথে কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
ভুল-ত্রুটিতে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন। একসাথে সবকিছুকে পরিশুদ্ধ করে ফেলা কিংবা একসাথে সব আমল করার ইচ্ছেটা আসলে অনেকটা ট্রাক ভর্তি করে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করার মতোই। এতে পরিবর্তনের ছোঁয়া হয়তো লাগে কিন্তু পরিবর্তন সাধিত হয় না বেশির ভাগ সময়ই।তাই যাকাতের সমূদয় টাকা দিয়ে একজন বা দুইজনকে স্বাবলম্বী করে দেবার মতোই যদি জীবনে আসা প্রতিটা রামাদানে পরিকল্পনা করে নিজের একটা’দুটা করে ঘাটতি দূর করার চেষ্টা করা যায় তাহলে আমলের পাল্লা ভারী করার সাথে সাথে আত্মউন্নয়নের পথে চলাটাও জারি থাকে ধীরে হলেও...
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)