সাহিত্য

মায়ায় ঘেরা

মায়ায় ঘেরা
  ১ ভোরবেলার নির্মল বাতাস আর পারিপার্শিক স্নিগ্ধতা শরীর ও মনে অবলীলায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বয়স আর অভিজ্ঞতার ভারে নুব্জ প্রায় মোমিনুল ইসলাম আজও এই স্নিগ্ধতাকে অনুভব করে প্রশান্ত হন । বয়স ৮০ হলেও মনটা তার যৌবনের গান গেয়ে যায়, এই গ্রামে তার সমবয়সী যারা ছিলো তারা সবাই মারা গেছেন। এখন তিনিই সবার চেয়ে বড় তাই সবাই বেশ সম্মানও করে, দেখা হলে সালাম দেয়া, কুশল বিনিময় করা নিত্য দিনের ব্যাপার। বাড়ির বাহির আঙ্গিনায় আরাম কেদারায় বসে আছেন তিনি, কিছুক্ষণ আগে ফজরের নামাজ পড়ে আধাঘন্টা হেঁটে এখানে এসে বসেছেন। একটু পরে চিরতা পাতা ভেজানো পানি পান করবেন তিনি। রাতের বেলা এই পাতা ভিজিয়ে রাখা হয় তার জন্য। মোমিনুল ইসলাম গলার স্বর একটু উঁচু করেন, -বড় বৌমা কই চিরতার পানি নিয়ে এসো, তাড়াতাড়ি। বড় বৌমা কাছাকাছি এসে, -এইতো বাবা এনেছি, আজ একটু দেরী হয়ে গেলো, নাস্তায় কী খাবেন? গ্লাসটা বড় বৌমা রাফিয়া আক্তারের হাত থেকে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে, -আলাদা কিছুই মনে হচ্ছেনা, তোমরা যা খাবে আমাকেও তাই দিও। -ঠিক আছে বাবা, পান্তা রেখেছি তাহলে আপনিও ওটাই খেয়ে নিয়েন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন  রাফিয়া আক্তার গ্লাস নিয়ে যাবেন বলে, মোমিনুল ইসলাম আয়েশ করে পান করছেন, যেন কতো স্বাদের (!) -বৌমা ছোট বৌমা কী উঠেছে? -না বাবা আপনার ছোট ছেলে ছোট বৌমা কেউই ওঠেনি, কেন কিছু বলবেন? -না তেমন কিছুনা, সবাইকে নিয়ে একটু বসতে চেয়েছিলাম, সবাইকে একসাথে দেখা হয়না অনেকদিন। আচ্ছা নাও গ্লাসটা। রাফিয়া আক্তার গ্লাস নিয়ে ভেতরের দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু আবারো ডাকলেন মোমিনুল ইসলাম, বিমর্ষ কন্ঠে, -বৌমা মুড়ি আছে? -হ্যা বাবা আছে। -ভিজিয়ে চিনি দিয়ে মাখিয়ে আমাকে দিও, পান্তা খাবনা । নিশাদ আর ছোট বৌমা  উঠলে বলে দিও, কথা বলব। -ঠিক আছে বাবা আমি এখন আসি। -হ্যা মা  যাও আমিও আমার ঘরে যাই। ২ বড় বৌমা রাফিয়া আক্তারকে খুব ভালোবাসেন মোমিনুল ইসলাম, বড় ছেলের অন্য কাউকে পছন্দ ছিলো। কিন্তু মোমিনুল ইসলাম অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে রাজি করিয়েছেন, তিন বছর বড় ছেলে আতিকুর রহমান নাহিদ বেশ সুখেই রাফিয়া আক্তারকে নিয়ে সংসার করেছে, একটা ছেলেও হয়েছে ওদের এখন এইটে পড়ছে। কিন্তু তার পরই ছেলে হঠাৎ করেই কোন রকম অসুখ ছাড়াই মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে যায় আর সাথে সাথে মারা যায়। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মোমিনুল ইসলামের দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন সঙ্গীছাড়া জীবন অতিবাহিত করা যে কতো কষ্টের তা তিনি বোঝেন, তিরিশ বছর হলো তিনি এভাবে একা, স্ত্রীকে হারিয়ে বড় নিঃসঙ্গ, বিড়বিড় করে বলেন, -চোখের সামনে স্ত্রী সন্তান, বাবা মা আরো কতো আপনজনকে চলে যেতে দেখলাম, আর আমি? সব কিছুর স্মৃতি বহন করে আজও বট গাছের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে সমস্ত ঘটনা, ন্যায় অন্যায়ের স্বাক্ষী হয়ে আছি ............... থেমে যান তিনি, বাইরে থেকে এক যুবক ছুটে আসছে ওনার দিকেই, সে মোমিনুল ইসলামকে ডাকতে ডাকতে ঢুকেছে, - দাদা ও দাদা! কাছে এসে ধপ করে বসে পড়ে, লুঙ্গি হাটুর উপরে জমি চাষীদের মতো করে  বেঁধে রাখা, মাথায় গামছা বাঁধা। -  কী রে রবিউল হাফাচ্ছিস কেন? - দাদাগো এমন কামডা কেডায় করলো, আমাগো গেরামে এই কাম, আল্লাহর গজব নাজিল হইলো বুঝি! মোমিনুল ইসলামের বুকটা ধড়ফড়িয়ে ওঠে, কী হলো গ্রামে?  ধমক দেন রবিউলকে, -কী হয়েছে সেটা বল, ঘুরাচ্ছিস কেন? নিজেকে সামলে নেয় রবিউল, -দাদা উত্তর পাড়ার সেলিনা আপা আছেনা? ঐযে মা আর মেয়ে থাকতো একসাথে, সেলিনা আপার দাদাতো তোমার বন্ধু আছিলো............ খুব রেগে যান মোমিনুল ইসলাম, -আরে এতো ব্যাখ্যার কী আছে, চিনিতো কী হয়েছে তাই বল্! ধমক খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে যায় রবিউের মুখ, -সেলিনা আপারে কে জানি খু... করছে দাদা! কেঁদে ফেলে রবিউল। আর  বসে থাকা মোমিনুল ইসলাম অকস্মাত  দাঁড়িয়ে যান, তার হাত পা কাঁপছে, কম্পিত ঠোঁট দুটো দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, -খু...?! -হ দাদা মইরা গেছেগা, তুমি কী যাইবা? -হ্যা যাবো চল্। লাঠিতে ভর দিয়ে চলতে থাকেন মোমিনুল ইসলাম। ওখানে গিয়ে লাশ রাখার খাটিয়াটা দেখেই কেমন আৎকে ওঠেন মোমিনুল ইসলাম, ওখানে এখনও কোন লাশ রাখা হয়নি, কিন্তু মোমিনুল ইসলাম নিজেকেই যেন ঐ খাটিয়ায় আবিষ্কার করলেন। কিছুক্ষণ পরে দুরের বারান্দায় একটা মুখ ঢাকা লাশ দেখে নিশ্চিন্ত হলেন! ৩ খু...ীর সন্ধান পাওয়া গেছে, এটা একটা ডাকাতির ঘটনা। সেলিনার বাবা সেলিনার জন্য একজোড়া কানের সোনার কানের দুল বানিয়ে রেখেছিলেন, মেয়ের বিয়ে শাদীতে লাগবে এই ভেবে। আর ঐ সামান্য কানের দুল নি এসে সেলিনার বাধার মুখে সেলিনাকে খু... করে পালিয়ে যায়। মোমিনুল ইসলামের মনটা সেদিন থেকেই যৌবনের গান গাওয়া বাদ দিয়েছে, ধীরে ধীরে মনোবল হারিয়ে ফেলছেন তিনি। আফসুস আর শংকা তাকে পেয়ে বসেছে। নিজের ঘরে বসে আছেন। এই মুহুর্তে এ বাড়ীর সব সদস্য তাঁর ঘরে ঢোকে। বড় নাতী আলিফ দাদুর পাশে গিয়ে বসলো, ছোট ছেলে চেয়ার টেনে নিয়ে একপাশে বসলো। ছেলে নিশাদ মলিন কন্ঠে, -বাবা ভাবী বললো তুমি সেদিন সবাইকে নিয়ে বসতে চেয়েছিলে, কিন্তু গ্রামে একটা অঘটন ঘটে গেলো, তাই আর বসা হলোনা...... একটু থেমে, বাবা তোমার শরীর ঠিক আছেতো? -আছে আল্লাহ যেমন রাখছে...... -কোন বিশেষ ব্যাপারে ডেকেছ? -সেদিন বিশেষ ব্যাপার ছিলোনা, এমনিতেই সবাইকে একসাথে দেখার জন্য ডেকেছিলাম, কিন্তু আজ বিশেষ একটা ব্যাপার আছে। বড় বৌমা তুমি বলো। রাফিয়া আক্তার একটু নড়ে বসলেন, -নিশাদ, বাবা সেলিনার মায়ের কথা বলছিলেন,  মানুষটা পুরোপুরি একা, অনেক আগেই স্বামী মারা গেছে, মেয়েটা টুকিটাকি হাতের কাজ করে রোজগার করতো, কিন্তু এখন তাও বন্ধ। তার বেঁচে থাকা অব্দি........................ নিশাদ কথার মাঝখানে কথা বলে, -ভাবী কিছু মনে করোনা, মাঝখানে কথা বললাম, আমরা তাতের জন্য কিছু করতে পারি কিনা সেই ব্যাপার কী? মোমিনুল ইসলাম গম্ভীর কন্ঠে, -তোমাদের কোন আপত্তি আছে? -না না বাবা সেটা বলছিনা, তবে এ ব্যাপার গ্রামের আরও যরা আছেন তারাও অংশ নিলে ভালো হয়না? -না! আমি কী করবো সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, আর আশা করবো আমি মারা গেলেও তোমরা তার বেঁচে থাকা অব্দি সে দায়িত্ব পালন করবে। কঠিন কন্ঠ মোমিনুল ইসলামের। মলিন হয়ে যায় নিশাদের মুখমন্ডল, -বাবা দায়িত্ব নেয়া তো খুব সহজ, কিন্তু......... আচ্ছা বলো তুমি কি সিদ্ধান্ত নিলে...... -মাসিক হাতখরচের একটা পরিমান নির্ধারণ করে তার হাতে দেয়া, আর বাজার করে দেয়া। -বাবা বাজার কে করে দেবে? -তোমার সংসারের বাজার যেভাবে হয়! আপত্তি স্বত্বেও সকলেই তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। আর স্বস্তিতে ভরে ওঠে মোমিনুল ইসলামের বুক!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)