সাহিত্য

আমাদের গল্পগুলো...

আমাদের গল্পগুলো...
(উপন্যাসটা অনেক আগের লেখা, ক্লাস নাইনে যখন ছিলাম। অনেক এডিট করার পর এই পর্যন্ত, পড়ালোয় ফাঁকিবাজি করে এসব লিখতাম :P । নামটাও চেইন্জ করেছি, এই উপন্যাসের আগের নাম ছিলো "কালো" । ) ১৩. মায়ার এখানে সবাই এসেছে, এই আয়াজনটা করেছে ওরা। ওদের খালা ফুফু মামা চাচা সবাই আছে, মৌমিতার শশুর শাশুড়ীও এসেছেন। শুধু আরমানের বাবা মা নেই, ওনারা আমেরিকা থেকে ফেরেননি, তবে আয়োজনটা তাদের অনুমতিক্রমেই করেছে।  খাবার সবটাই বাইরে থেকে অর্ডার দেয়া। খুব এনজয় করছে সবাই। মৌমিতা সবার চেয়ে একটু বেশিই আদর পাচ্ছে, মায়াও বেশ বড় একটা সুখবর বহন করছে, তাতে ওর সমাদরটাও কম যাচ্ছেনা। কিন্তু মৌমিতার আর কোন সময় নেই এতো আনন্দে ডুবে থাকার মতো। প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় জ্ঞান হারিয়ে সবার মাঝখানটায় পড়ে যায় মেঝেতে, কেঁদে ওঠেন কামরুননাহার, মায়া, হাবীব ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দেয়, মৌমিতার ডাক্তার শশুর শাশুড়ী দুজনই চিকিৎসার সরঞ্জামাদী নিয়েই এসেছিলেন দুজন দুপাশে থেকে নিজেদের চেষ্টা চালাচ্ছেন , অক্সিজেন সেট করেন। সবাই একদম চুপ হয়ে আছে, তবে অনেকের চোখেই অশ্রু। কামরুননাহার মহান প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ জানাচ্ছেন মেয়ের প্রাণ ভিক্ষার। এখানে একটা হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। মৌমিতা হারিয়ে যেতে বসেছে। মৌমিতার অস্পষ্ট গোঙ্গানী শুনে অস্থির কন্ঠে হাবীব, -বাবা ওর জ্ঞান ফিরেছে, ওয়াহিদা বেগম ছেলের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে শান্তণা  দিলেন, মায়া মৌমিতার শিওরে বসে জাগনোর চেষ্টা করছে। ডাক্তার দম্পতির চেহরায় নিরাশার ছাপ স্পষ্ট। মৌমিতার ব্যাস্ত দৃষ্টি সবার মুখাবয়বের দিকে একবার করে তাকিয়ে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ক্লান্ত শ্রান্ত সফর শেষে  একেবারে ঘুমিয়ে পড়লো। হাবীব পারলে যেন চিৎকর করবে, কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা মেনে নেয়ার অদম্য চেষ্টা ওকে এই কাজ থেকে বিরত রেখেছে। মায়া শব্দ করে কাঁদছে, কামরুননাহার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। মৌমিতার দাফন সম্পন্ন হওয়ার আগেই কামরুননাহার বেগমও হারিয়ে গেলেন। মায়ার কাছে একসাথে এই দুটো কষ্ট মেনে নেয়া বড্ড কঠিন, কিন্তু সব অসহ্য একটা সময় মানুষের সহ্য সীমায় চলে আসে, আর এজন্যই মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে। মায়া যখন মায়ের মুখখানা শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছিলো, তখন পাগলের মতো দুহাত দিয়ে মায়ের মুখ নাড়ছিলো। দুটি লাশ একসময়েই দাফন করা হলো তবে কামরুননাহার বেগমের মায়ার বাবার পাশে আর মৌমিতাকে হাবীবদের কবরস্থানে । মায়া এখন ওর মায়ের ওখানে আছে। আত্মীয় স্বজনরাও ফিরে যাচ্ছিলো গন্তব্যের দিকে, একটা সময় সাব্বির (স্বপ্নদূত) এসে মায়াকে একটা চিরকুট দিয়ে, -আপনি এভাবে কাঁদবেননা, আপনার মৃত প্রিয়জনদের কষ্ট হবে। মায়া চিরকুটের ভাঁজ খুলে দেখতে পেলো,লেখা আছে, “ আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন” দু দিন পর। সব ধরণের কাজ সম্পন্ন হলে আরমান মায়াকে রেডি হতে বলে অফিসে চলে যাওয়ার আগে বললো, -তুমি গাড়ী নিয়ে বাড়ি যাও আমি রিকশায় অফিস যাচ্ছি, সাব্বিরও আছে। -ঠিক আছে। প্রস্তুতি নিয়েছে মায়া, ওর চাচা চাচী কাছে এসে, রাজিব আকমল মলিন কন্ঠে, -আমি জানি মা তোমার এখন আর এখানে আসতে ভালো লাগবেনা, তবুও আমাদের জন্য এসো তোমরা। -চাচা, বাবা মা মৌমিতার যে স্মৃতি এখানে আছে সেগুলো তো কোনদিন হারিয়ে যাবেনা, আর তোমরাইতো এখন আমার কাছের তোমরা ছাড়া আর কে আছে বলো, তোমাদের কাছেইতো আসবো। তোমরাও আসবে, চাচা তোমার যদিও ছয়মাস দেশের বাইরে থাকতে হয়, তবুও দেশে যখনই ফিরবে আমার বাসায় কিন্তু আসবে। গাড়ীতে উঠলো মায়া, সাব্বির ড্রাইভিং সিটে, আর মায়া পেছনে মাঝখানের সিটে, সাব্বির গাড়ী ষ্টার্ট করে বললো, -স্বজন হারানোর ব্যাথা আমি জানি মায়া, আমি দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে ধৈর্য ধারণের তৌফিক দিন, আমি আমার স্ত্রীকে বিয়ের পরদিনই হারিয়েছি। বাবা মা একই দিনে মারা যান। ছোট বোনটাও মারা যায় মাত্র ৫০ বছর বয়সে। মায়া বিস্মিত হয়, কারণ সাব্বিরকে দেখে ২৫ থেকে ৩০ বছরের যুবক মনে হয়, মায়ার চেয়ে ছোটই মনে করে মায়া অথচ কী বলছে তার ছোট বোন নাকী ৫০ বছরের। মায়া অবাক কণ্ঠে, -আপনার বয়স কতো? -১০০ বছর। -আপনি মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আপনাকেতো ভালো মানুষ জানতাম। -এখন কী খারাপ মনে হচ্ছে? গাড়ীর আয়না দিয়ে মায়াকে দেখে সাব্বির হঠাৎই সাব্বির নিজের ভুল বুঝতে পারে, কারণ এই সত্যগুলো এখনই সে মায়াকে জানাতে চায়নি, কিন্তু এখন সবটা না বললে বড্ড ভুল হয়ে যাবে। মায়া রাগান্মিত কন্ঠে, -হ্যা আপনি জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলছেন, ভালো মানুষরা কী মিথ্যা কথা বলে? সাব্বির গম্ভীর কন্ঠে, -বোন আপনি রেগে যাবেননা, আর এখন যা বলবো তাতে প্লিজ ভয় পাবেননা...... অবাক কন্ঠে মায়া, -ভয়! কেন ভয় কেন পাবো? -না আসলে আমি মানুষ নই! এবার সত্যিই ভয় পায় মায়া, -তাহলে! -আমি জ্বীন! খুব দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে মায়া, সিটের সাথে হেলান দিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। সাব্বির বুঝতে পারছেনা এখন ওর কী করা উচিত। এরপর মায়া চোখ খুলে ভীত কন্ঠে, -আপনাদের এতো বয়স হয় কেন? - কেন হয় তা জানিনা, তবে আমরা যুবক হই ৮০ বা ৯০  বছরে। আর আপনি জেনে থাকবেন আগের নবী রাসুলের উম্মতদের আয়ু অনেক বেশী ছিলো। আর জ্বীনদের সংখ্যা খুবই কম, মানুষের সংখ্যার চেয়ে। -কী!? -হ্যা তাই। -আচ্ছা! আপনারা তাহলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে বা বর্তমানে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলো জানতে পারেন। -না একটা কথা ভুল বলেছেন, ভবিষ্যত আমরা জানতে পারিনা, ভবিষ্যৎ একমাত্র আল্লাহ জানেন। তবে কিছু দুষ্ট জ্বীন আল্লাহর আরশে যাওয়ার চেষ্টা করে ভবিষ্যৎ জানার জন্য, তখন ফেরেশতারা আগুনের ফুলকী নিক্ষেপ করে ঐসব দুষ্ট জ্বীনগুলোকে তাড়িয়ে দেন। তবে হ্যা বর্তমান অর্থাৎ একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার সাথে সাথে কোন জ্বীন যদি জানতে চায় তবে সাথে সাথেই জানতে পারবে। যেমন একটা ঘটনা বলি, যেদিন আপনার মা আপনাকে আর আরমান সাহেবকে মৌমিতার বিয়ের ব্যাপারে ডেকেছিলেন, আপনারা ওখানে যাওয়ার আগেই আমি জেনে এসেছিলাম কেন ডেকেছেন। মায়া যার পর নাই বিস্মিত হয়, বলে, -ওমা তাই! -হ্যা তাই, তবে বোন একটা কথা বলে চাই, আপনি প্লিজ আমি জ্বীন একথা আর কাউকে বলবেননা। তাহলে আমি টিকতে পারবোনা, এটা আমার জিবীকা অর্জনের একটা পথ। বিস্ময় কাটেনা মায়ার, তবুও বলে, -না না কাউকে বলবোনা।   ১৪. মায়ার ভেতরের জীবন্ত স্বত্তাটি ছয় মাস অতিক্রম করেছে। তার জীবন্ত উপস্থিতি টের পায় মায়া, পুলকিত হয় তখন। কী আনন্দের এ অনুভূতি, মা হওয়া যেন পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখের অনুভুতির একটি। মায়ার শশুর শাশুড়ী দুদিন আগে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। তারা দাদা দাদী হওয়ার আনন্দ দিতে যাওয়া মায়ার জন্য প্রচুর গিফট এনেছিলেন। মায়া কিছুক্ষণ মৌমিতা আর কামরুননাহার বেগমের স্মৃতিতে ডুবে ছিলো, তাতে কখন যে এশার আজান দিয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারেনি। আজ অনেকদিন পর আরমান এশার পরও ফিরলোনা, তাছাড়া মায়ার সাথে যখন থেকে স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছে তখন থেকে গতকাল পর্যন্ত বিকালবেলাতেই বাসায় ফিরতো। মায়া মোবাইল হাতে নেয়ার সাথে সাথেই গাড়ীর আওয়াজ শুনতে পায়। আরমান এসেছে। খাবার রেডী করে মায়া, টেবিলে শশুর শাশুড়ী সহ রাতের খাবার সেরে নেয় ওরা। মায়া আর আরমান শুয়ে পড়েছে। আরমান মায়ার মাথায় হাত দেয়, -ঘুমিয়ে গেছো? -না। -আমাদের সন্তান কেমন আছে? কথাটা শেষ করে মায়ার পেটে হাত রাখে আরমান, মায়া মুচকী হেসে, -ও খুব ভালো আছে। -মায়া! তোমাকে একটা কথা বলতে চাই! -কী কথা? -মায়া আমি একজনকে...... হকচকিয়ে ওঠে মায়ার ভেতরটা, -কী আরমান? -আমি আরো একটা বিয়ে করতে চাই। মায়ার ভেতরটা হুহু করে কেঁদে ওঠে, বুকের ভেতরের রক্ত চলাচলে লাইন কেউ যেন চেপে ধরলো, ফুঁসফুসও যেন মায়াকে অসহযোগীতা করে চলেছে। দুচোখ দিয়েতো অশ্রু ঝড়ছেই। আরমান আরো বললো, -তুমি বাবা মাকে বলে রাজি করাও প্লিজ। মায়া নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা, দ্রুত খাট থেকে নেমে বাথরুমে ঢোকে, শাওয়ার ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদে। পেটের  ভেতরের সেই আগন্তুকটি একটু একটু করে নড়ছে, যেন মাকে সমবেদনা জানাচ্ছে। মায়ার ভাবলো এটা যদি একটা দুঃস্বপ্ন হতো। মায়া আরো ভাবলো আরমান হয়তো ওর সাথে দুষ্টামি করেছে, এা ভেবে খুব তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে ফিরলো, কিন্তু দেখলো আরমান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মায়া ঘুমাতে পারলোনা, মায়ে দেখেছে ওর মা কামরুননাহার যখন খুব কষ্ট পেতেন তখন গভীর রাতে উঠে নফল নামাজ পড়তেন, যে নামাজকে  তাহাজ্জুদ বলা হয়। মায়া আজ তাই করলো। ফজর পর্যন্ত জায়নামাজেই কাটিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে রান্নাঘরে ঢুকলো, সকালের নাস্তা একা একা তৈরী করলো, ও ব্যাস্ত থাকার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা ভোলার জন্য। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা রেডি করে ওখানেই বসে থাকলো মায়া। লিপি ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে রান্নাঘের দিকে যাচছিলো, মায়া বললো, -লিপি! ওখানেই দাড়িয়ে মায়ার দিকে তাকায় লিপি। মায়ার মুখমন্ডল ফুলে গেছে, অবাক কন্ঠে, -ভাবী আপনের কী পানি ধরে? -এদিকে এসো। এগিয়ে আসে লিপি, মায়া মলিন কন্ঠে, -লিপি তুমি কী নামাজ পড়ো? লজ্জা পায় লিপি, -মাঝেমাঝে। -এখন পড়ে নাও যাও। আর এখন থেকে সবগুলো নামাজ পড়বে, একজন মানুষের আল্লাহ ছাড়া আর কেউ থাকেনা জানোতো! মাথা নিচু করে মায়া, ওর কান্না চলে এসেছে। -ভাবী নাস্তা? -আমি বানিয়েছি।   নাস্তার টেবিলে সবাই। মায়াকে দেখে আনোয়ারা চৌধুরী, -এ কী! তুমি কেঁদেছো কেন? মায়া? আরমান আড়চোখে একবার মায়ার দিকে তাকায়, তারপর মায়া কিছু বলার আগেই আশরাফ চৌধুরীকে লক্ষ্য করে, -বাবা আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। -কী বিষয়ে? -আমি বিয়ে করবো। আনোয়ারা চৌধুরী অবাক হয়ে যান, রাগান্মিত কন্ঠ  আশরাফ চৌধুরীর, -মানে? -বাবা মানে খুব সোজা, আমি আবার বিয়ে করতে চাই। আশরাফ চৌধুরী মায়ার দিকে তাকালেন, মায়ার খাবারের প্লেটে চোখের অশ্রু ঝরছে অবিরাম,আশরাফ চৌধুরী খাওয়া বাদ দিয়ে উঠে দাড়ালেন, -তুমি বুঝতে শিখেছো, যদি মনে করো সবাইকে কষ্ট দিয়ে তুমি একা সুখী হবে তাহলে যা ইচ্ছে হয় করো, আমি বাধা দেবার কে? কথাটা শেষ করে হনহন করে চলে গেলেন। আনোয়ারা চৌধুরীও উঠে দাড়িয়েছেন, আরমান বললো, -মা আমি তোমাদেরকে ছাড়া কিছু করতে চাইনা তাই বলছি, খুব দ্রুত বিয়েটা করতে চাই  তোমরা ওদের ওখানে গিয়ে দিন তারিখ ঠিক করে আসবে। -ওদের ওখানে মানে? -মানে যাকে বিয়ে করছি তার বাড়িতে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আনোয়ারা চৌধুরী, -ও আগে থেকে ঠিক করা? আরমানের কথা না শুনে চলে গেলেন।   ১৫. বর যাত্রী নতুন বউ নিয়ে ফিরছে, আর আধাঘন্টা পরই নাকী আসবে। কেউ একজন ফোনে জেনে নিলো। এ সময় রাজিব আকমল মায়ার রুমে ঢুকলেন, বললেন, -মায়া তোমাদের বাড়িতে এতো লোকজন কেন মা?  নানুভাই আসবে বলে নাকী? আমারতো খুবই ভালো লাগছে। মায়া শোয়া থেকে উঠে বসে, -ছোট চাচা! মায়াকে কাঁদতে দেখে ভেবে নিলেন মা বোনের কথা মনে করে বুঝি কাঁদছে। মায়ার মাথায় হাত দিলেন বললেন, -গতকাল দুবাই থেকে এসেছি, তোমাকে দেখতে আসলাম মা, কাঁদছো কেন মায়া। মায়া ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে, -চাচা মা বোনকে হারানোর কষ্ট যখন ভুলতে চেষ্টা করছিলাম, ঠিক তখনই যে আরো একটা কষ্ট এসে আমাকে গ্রাস করলো, আমি যে সবই হারালাম। রাজিব আকমল অজানা কষ্টে কেঁপে ওঠেন, -কী হয়েছে মায়া? -আরমানের আজ বিয়ে হচ্ছে, বলে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। রাজিব আকমলও অপ্রত্যাশিত এ কষ্টে কেঁদে ফেললেন, -এ কী শুনালে মা, আমি যে তোমাকে সুখী দেখতে এসেছিলাম। মায়ার অশ্রু মুছে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, -আমি তোমার মতো দুখী মানুষ হয়তো কখনো আর কাউকে দেখিনি কাউকে নয়। চলে যাচ্ছেন রাজিব আকমল, পেছনে তাকালেননা একবারও, এক আকাশ কষ্ট নিয়ে ফিরে গেলেন তিনি। আরমানের ঘর থেকে আবার সেই আগের ঘরে ফিরতে হয়েছে মায়াকে।  বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে বরযাত্রী। চারেদিকে নতুন বউয়ের প্রশংসায় মত্ত সবাই, অন্ধকার ঘরের এককোণে মায়ার নিঃশব্দ আহাজারী। ভোরবেলা। নাস্তা তৈরীর দায়িত্ব অন্য বুয়াকে দিয়ে লিপিকে নিয়ে হাঁটতে বের হয় মায়া। ডাক্তার এখন নিয়মিত হাঁটতে বলেছে। মায়ার পাশাপাশি হাঁটছে লিপি। সারা রাতভর  আল্লাহর কাছে নিজের ধৈর্য ধারণের তৌফিক চেয়েছে। অশান্ত মনের সাথে যুদ্ধ করে ধৈর্যকে জয় করতে পেরেছে মায়া। লিপি মায়ার দিকে তাকিয়ে, -ভাবী! -বলো লিপি, -আমি কিন্তু কইলাম ঐ নতুন বউয়ের কোন কামই করুমনা। -কেন? চুপ থাকে লিপি, মায়া বললো, -সবার কাজই করতে হবে। এ কথা আর একবারও মাথায় এনোনা। লিপি মন খারাপ করে, -আপনে নতুন বউরে দ্যাখছেন? -হ্যা দেখেছি, অনেক সুন্দরী, এজন্যইতো আরমান বিয়ে করেছে তাঁর সুন্দরী বউ দরকার, পেয়েছে। লিপি ভ্রু কুঁচকিয়ে, -ফর্সা অইলেই সুন্দরী অয়না, কী আমার চেহারারে...... যে তার চেহারা তার নাম আবার পেয়ারা। লিপির এই মেলানো ছন্দ শুনে মায়ার হাসি পায়, কিন্তু লিপিকে বুঝতে না দিয়ে, গম্ভীর কন্ঠে, -এভাবে বলতে নেই লিপি, ওকে তোমার ভালো লাগছেনা তার কারণ আমাকে তুমি অত্যধিক ভালোবাসো, কিন্তু তার মানে তো এই নয় তুমি তার নামে নিন্দা করবে  সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করবেনা। চুপ হয়ে যায় লিপি। আর কোন কথা হয়না, নিঃশব্দে হাঁটাহাঁটি করে মায়া।   তিন মাস পর। চৌধুরী পরিবারে নতুন অতিথী এসেছে। তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে আজই বাড়িতে আনা হলো। পুত্র সন্তানের জননী মায়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় শিশুটি জন্মের দিন থেকে আজ পর্যন্ত আরমান অনুপস্থিত, নিজের ঔরসজাত সন্তানকে একবার দেখার জন্যও সে আসেনি, শশুর বাড়ীতে দাওয়াত খাচ্ছে দ্বিতীয় স্ত্রী মল্লিকার সাথে। আজ মায়ার শশুর বাড়ীতে অনেক আত্মীয় স্বজনও এসেছে, হাবীব, হাবীবের বাবা মা, সবাই শিশুর মুখ দেখছে বিভিন্ন গিফট দিয়ে। এই মুহূর্তে আরমান ভেতরে ঢোকে। মল্লিকা আসেনি।  আরমানকে দেখে আশরাফ চৌধুরী গম্ভীর কন্ঠে, -বৌমা আমার নাতীকে নিয়ে ঘরে চলে যাও, ঘরে ছিটকিনি সহ দরোজা লাগিয়ে দেবে। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আরমানের দিকে তাকালো। আরমান দোলনার দিকে এগুচ্ছে, দেখে আশরাফ চৌধুরী রাগান্মিত কন্ঠে, -দাঁড়াও তুমি আসবেনা এদিকে। এই শিশুকে দেখার মতো অধিকার তুমি হারিয়ে ফেলেছো। আরমান থমকে দাঁড়িয়ে যায়, উপস্থিত আত্মীয় স্বজনের সামনে লজ্জাবোধ ওকে তাড়া করে, মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায়। আনোয়ারা চৌধুরী সহ সবার দৃষ্টি এখন আশরাফ চৌধুরীর দিকে। মায়ার দৃষ্টি ছলোছলো করছে, আশরাফ চৌধুরী মায়ার মাথায় হাত দিয়ে, অপরাধের সুরে, -আমাদেরকে মাফ করে দিও বৌমা, তোমার জীবনটা আমার জন্য আজ এ ধরণের যন্ত্রণার স্বীকার। আর ছেলেকে হয়তো ভালোভাবে মানুষ করতে পারিনি বলে আজ এ দিনগুলো দেখতে হচ্ছে। তোমার ছেলের হাত ধরে তুমি একদিন আনন্দের মুখ দেখবে আমি দোয়া করছি মা। মায়া কিছু বলেনা, আসলে বলতে পারেনা, রুদ্ধ কন্ঠ নিয়ে কী আর বলা যায়। চুপচাপ কচি শিশুটির মুখ চেয়ে পরবর্তী দিনগুলোর স্বপ্ন বোনে মনের কোণে।   ১৬. তিন বছর পর। চৌধুরী পরিবরের প্রদীপ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। আশরাফ চৌধুরী নাতী বলতে পাগল, অর্থনীতির চাকা ঘুরছে উন্নতির দিকে। আশরাফ চৌধুরী এখন যা কিনছেন সবটাই নাতীর নামে, একপ্রকার জেদের বশবর্তী হয়ে একাজ করছেন ব্যাপারটা সবার জানা। আর এ দিকে মল্লিকার সুন্দর  চেহারার আড়ালে মনের কদর্যতা বেরিয়ে আসছে দিন দিন, শিশুটি তার কাছে যেন অহেতুক এক বোঝা স্বরুপ। মায়া ছেলের নাম রেখেছে সামী ইউসুফ। ওর খুব প্রিয় এক শিল্পির নামে নামটি। সামী বড় হয়েছে। হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে।  আরমান ছেলের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে, আদর করে কারণ, এক হলো অপরাধবোধ, ছেলের জন্মের সময় সে ছিলোনা, আর দুই মল্লিকা অশান্তি করবে। মায়া অফিস যাওয়ার জন্য রেডী হয়েছে, সামী খেলতে খেলতে নিয়ে মায়ার সামনে এসে, -মা আমিও যাব। মায়া ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করে, -ওলে আমার বাবাটা, আদর বাবু। কী বলছে সে আমার সাথে অফিস যাবে? আদর পেয়ে খুশি হয় সামী, মায়ের বুকের সাথে জড়িয়ে থাকে, -হ্যা যাবো। আনোয়ারা চৌধুরী ভেতরে ঢোকেন, -দাদু ভাই আমার কাছে এসো। -দাদী আমি অফিস যাবো। হেসে ফেলেন আনোয়ারা চৌধুরী, -ওরেববাবা এটা কী কথা, দেখি আসোতো দাদু আমরা অফিস অফিস খেলবো ঠিক আছে? মা অফিসে যাক। এবার উৎসুক হয়ে দাদীর কাছে আসে সামী।   আজ শুক্রবার। মায়া ফজরের নামাজ পড়ে ছেলের পাশে শুয়ে আছে। মায়ার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে এই ভেবে যে ছেলেটি বাবা মাকে একসাথে কখনো পায়নি। আরমান বিয়ে করার পর থেকে এ ঘরে একবার উঁকি দিয়েও দেখেনি। বেশ দেরীতে সামী ঘুম থেকে উঠলো। মায়া ওকে ব্রাশ করিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হলো নিজেও। নাস্তার টেবিলে মা ছেলে এসে বসলো। সামী খেয়াল করলো টেবিলে পুডিং কিন্তু ওটা অন্য কাউকে দেয়া হচ্ছেনা, শুধু মল্লিকা খাচ্ছে। সামী বললো, -ছোট মা আমাকেও পুডিং দাও। মল্লিকা দৃঢ় কন্ঠে, -এটাতো তোমার জন্য না সামী। সামীর কচি মনটা ভেঙ্গে গেলো, ও খুব ছোট কিন্তু কেউ কিছু না দিলে কখনোই জেদ করেনা  এমনী মায়ার কাছেও জেদ করেনি। ও শুধু একটা ব্যাপার ভেবে পায়না, ও দেখেছে ওর বন্ধু তালহা ওর আব্বু আম্মু দুজনের সাথেই খুব মজা করে বেড়াতে যায়, বাইরে খায়, কতো খেলনা নিয়ে আসে তালহার আব্বু। কিন্তু ওর আব্বু ওর কাছেও আসেনা। বাবার মুখের দিকে একবার তাকায় সামী।  মায়া অবাক হয়ে মল্লিকার দিকে তাকায়, মানুষ কী এতো খারাপও হতে পারে? আরমান বিব্রত কন্ঠে মল্লিকাকে, -ছোট বাচ্চা, এক পিচ দাও। মল্লিকার শক্ত কন্ঠ, -না। ছেলেকে জড়িয়ে নিয়ে মায়া, -আমি এখনই তোমাকে বানিয়ে দিচ্ছি, ওগুলো নিওনা পচা। -ঠিক আছে মা। আশরাফ চৌধুরী খুব রেগে গেছেন কিন্তু কিছু বলছেননা, আনোয়ারা চৌধুরী রাগান্মিত কন্ঠে, -মল্লিকা তুমি জীবনে পুডিং খাওনি? এতো ছোট মন তোমার? ছিঃ ছোট বাচ্চা...... রেগে যায় মল্লিকা, -থামেন, ছোট বাচ্চাতে সমস্যা নেই, সমস্যা হলো ও ঐ কালসিটে ভুতনীর ছেলে, তাতেও সমস্যা ছিলোনা, সমস্যা হলো ঐ কালসিটে আরমানের বউ...... মায়া কিছু না বলে সামীকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। খুব ছোট বেলা থেকেই মায়ার অভ্যাস কারো সাথে কখনো কথা কাটাকাটি করেনি।   আশরাফ চৌধুরী এবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে, -বেয়াদপ! সব জেনেশুনেইতো এসেছো? এখন এতো হিংসা কেন তোমার? আমার নপুংশক সন্তানটাওতো তোমার দখলে। আর একটা কথা বললে এবাড়ী থেকে বের করে দেব। নাস্তা না করে উঠে চলে যান, পিছু পিছু আনোয়ারা চৌধুরীও। আরমান এবার বললো, -এ ধরণের কাজ না করলেও পারতে মল্লিকা। তুমিও মা হতে যাচ্ছ তোমার সন্তানকে কেউ এমন করলে তোমার কেমন লাগবে বলো। মল্লিকা এবার নাকি কান্না কেঁদে, -শেষ পর্যন্ত তুমিও...... আরমান আর কিছু বলেনা, মাথা নিচু করে অহেতুক এই অশান্তির জন্য নিজেকেই দায়ী করলো। গভীর রাত,বারোটার মতো হবে। মায়া আর আরমানের বিয়ের সাত বছর পূর্ণ হবে আজ। মায়র মনে পড়ে সেই দিনটির কথা।  মায়া সামীর কাছে শুয়ে আছে, ডিম লাইটের আলোয় ছেলের মুখ দেখছে সে। শিশুদের নিষ্পাপ মুখ ঘুমালে আরো সুন্দর দেখায়। আর সামী মায়ার মতো কালো হয়নি, আরমানের রং পেয়েছে। হঠাৎ দরোজায় টোকা দেয়ার শব্দ পেলো মায়া। অবাকই হল, এত রাতে কে আবার? দরজা খুলে দিয়ে আরমানকে দেখে অবাক কন্ঠে, -তুমি এতো রাতে? আরমান ঘরের ভেতরে ঢোকে, সোজা সামীর কাছে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসে, মায়ার দিকে না তাকিয়ে, -ওকে পুডিং বানিয়ে দিয়েছিলে মায়া? মায়া ভাবলেশহীন কন্ঠে, -হ্যা। -ও খেয়েছে, তো না? -হ্যা। আরমান ছেলের কপালে চুমু দেয় কয়েকবার। এরপর উঠে দাঁড়ায়, এবারও তাকায়না মায়ার দিকে, -আসছি। মায়াও কেন জানি আরমানের দিকে তাকায়না, খুব অপরিচিত যেন ওরা দুজন দুজনের কাছে  মায়া বললো, -আরমান! চলে যেতে উদ্যত আরমান থমকে দাঁড়ায়, -বলো। -আজকের ডেট মনে আছে তোমার? -কী আজ? -আজ আঠারোই সেপ্টেম্বর। পিছু ফিরে মায়ার দিকে তাকায় আরমান, কিন্তু মায়া তাকায়না। আরমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় নিজের রুমের দিকে।   ১৭. পরদিন বিকেল বেলা। মায়া আশরাফ চৌধুরীর পাশে বসে কফি পান করছে, আর গল্পের পশরা সাজিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করছেন আশরাফ চৌধুরী। সামী সাব্বিরের সাথে খেলতে গেছে। মায়া আর আশরাফ চৌধুরী কথা প্রসঙ্গে হাসছিলেন, মায়া হঠাৎই খুব চমকে হাসি থামিয়ে দেয়, কারণ ও সাব্বিরকে উড়ে এসে বল নিতে আবার খুব দ্রুত চলে যেতেও দেখেছে। আশরাফ চৌধুরী হাসি থামিয়ে, -কী হয়েছে বৌমা? নিজেকে সামলে নেয় মায়া, -না বাবা কিছুনা। মা কোথায় দেখছিনা যে, লিপি এসে হাস্সোজ্জল কন্ঠে, -আম্মায় সিনেমা দ্যাকতাছে। -ও। বাবা আপনার শরীর ঠিক আছেতো, দুদিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেননা...... -কী জানি বৌমা, শরীরে ঠিক বল পাচ্ছিনা, আর বুকের বাম পাশটা ব্যাথা করছে। -কী বলছেন বাবা? তাহলেতো ডাক্তার দেখাতে হবে। -হ্যা বৌমা দেখাবো, আমার বন্ধু ঐ যে মনে আছে, ডঃ নাজমুল ও গতকাল ঢাকা থেকে এসেছে।আমি ভেবেছি ওকে ডাকবো আর  কী সমস্যা সেটা জেনে নেবো। মায়া কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়, কারণ আরমান আর মল্লিকা বেশ গর্জিয়াস পোশাক পরে বাইরে যাবার জন্য বের হয়েছে। আশরাফ চৌধুরী আরমানকে লক্ষ্য করে, -কোথায় যাওয়া হচ্ছে? -বন্ধুর বাড়ি, রাতে খাওয়ার দাওয়াত। -আজকের দিনের কথা মনে আছে? মায়া অবাক হয়ে শশুরের দিকে তাকায়, উনি বলে চলেছেন, -আজকের দিনে তোমার মায়ার সাথে বিয়ে হয়েছিলো মল্লিকার সাথে নয়, আজ তোমার মায়াকে নিয়ে ঘুরতে যাবার কথা, তাই নয় কী? মল্লিকা মাঝখানে কথা বলে ওঠে, -বাবা আপনি সবসময় ওর হয়ে কথা বলেন...... আশরাফ চৌধুরী ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন, -থামো, আমি তোমার সাথে কথা বলছিনা, কারো কথার মাঝখানে কথা বলতে নেই এটা কী এখন তোমাকে শেখাতে হবে? আরমান মাথা তুলে বাবার দিকে তাকায় কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, আশরাফ চৌধুরী রাগ যেন মাথায় উঠে গেছে, চোখ দুটো অসম্ভব লাল, মায়া তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, আনোয়ারা চৌধুরী টিভি দেখতে দেখতে ছুটে এসেছেন, কিন্তু কিছু বলছেননা, কারণ তিনি জানেন আশরাফ চৌধুরী আজ অনেক বেশী রেগে গেছেন, খুব রেগে গেলে তাকে সামলানো দায়, বললেন, -বলো আমার প্রশ্নের জবাব দাও আরমান! তুমি ওকে ভালোবাসোনা, কিন্তু আইনত ও তোমার স্ত্রী তো নাকী, সাধারণ যে অধিকারগুলো আছে সেগুলো তো এটলিষ্ট পুরণ করবে? সামী এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে, দাদুকে এতো রাগতে দেখেনি কখনো, ভয়ে চুপসে গেছে, মায়া ওকে কাছে টেনে নেয়, আশরাফ চৌধুরী সামীকে টেনে নিয়ে, -আরে এতোটুকু শিশু পর্যন্ত তোমার মনে ঠাঁই করে নিতে পারলোনা, নাকী তোমার ছানি পড়ে যাওয়া দৃষ্টিতে ওকেও কালো আর কুৎসিত মনে হয়? আর আমি কী ভেবে নেবো তোমার মতো সন্তানকে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি? জবাব দাও আরমান! আরমান কিছু না বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়, আশরাফ চৌধুরী আরো উত্তেজিত হয়ে, -দেখেছো কতো বড় স্পর্ধা, আমার কথার উত্তর না দিয়ে............ প্রচন্ড বুকের ব্যাথায় ককিয়ে উঠেন আশরাফ চৌধুরী, বাম হাত দিয়ে চেপে ধরেন ব্যাথা করা জায়গাটিতে। মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন কোথা থেকে সাব্বিরের উদয় হয় আর ও এসেই আশরাফ চৌধরী কে পাজাকোলা করে উঠিয়ে নিয়ে যায় ওনার রুমে। আনোয়ারা চৌধুরী কাঁদছেন, মায়া ওর শাশুড়ীকে লক্ষ্য করে অস্থির কন্ঠে, -মা, মা আপনি দ্রুত ডাক্তার চাচার নাম্বারটা দিন, ডাঃ নাজমুল। কান্নাজড়িত কন্ঠে আনোয়ারা চৌধুরী, -টেলিফোনের কাছে রাখা ডায়েরীতে আছে বৌমা। মায়া কথা বলে ওনার সাথে।   ১৮. বিগত হয়েছেন আশরাফ চৌধুরী। পনেরো দিন হতে চললো। আনোয়ারা চৌধুরী সেদিন থেকে নির্বাক, নিস্তব্ধ। নিজের ইচ্ছে হলে কথা বলেন না হলে নয়। বার্ধক্যে এসে যাকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, অবশ্য স্বামী স্ত্রীর এই বন্ধটা সবসময়ের জন্যই বড্ড প্রয়োজন।  কিন্তু মৃত্যু নামক এই শেষ বিদায়ের নিয়মটাতে অদম্য নির্মমতা এই। কিন্তু বিশ্বজাহানের রবের অসংখ্য, বর্ণনাতীত, অগণিত দয়ার কাছে এই নিষ্ঠুরতা ক্ষুদ্র বালুকণার চেয়েও ছোট। বিরহ বেদনায় কাতর আনোয়ারা চৌধুরী স্মৃতির পশরা সাজিয়ে বসেছেন। ভাবছেন, বিয়ের পর অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও বাচ্চা হচ্ছিলোনা, আনোয়ারা চৌধুরীর সমস্যা ছিলো বলে। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী আশরাফ চৌধুরীকে আবারও বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলো, কিন্তু তিনি সবসময় ব্যাপারটাকে নিজের অবস্থান থেকে শক্তভাবে দমন করেছিলেন, আর আনোয়ারা চৌধুরীকে শান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, -এতে আমার কোন কষ্ট নেই আনোয়ারা, সত্যি বলছি। আল্লাহ চাইলে আমাদের সন্তান হবে না চাইলে হবেনা। আর বড় কথা কী জানো, আমার পাশে তুমি থাকলে আমার আর কিছু লাগবেনা। অথচ আনোয়ারা চৌধুরী আহামরি সুন্দরী ছিলেননা, আসলে ভালোবাসা থাকলে সেখানে সৌন্দর্যের কী প্রয়োজন!  ভালোবাসার মানুষ কুৎসিত হলেও তাকেই পৃথিবীর সেরা সুন্দর মনে হয়। নিজের ছেলের ব্যাপারটা মনে করে, মায়ার জন্য কষ্ট হয় আনোয়ারা চৌধুরীর। মায়া রাতের খাবারের ট্রে নিয়ে আনোয়ারা চৌধুরীর রুমে ঢোকে, ভাত, মুরগীর মাংস, শাকভাজী, আর ডাল। টি টেবিলে ট্রে রেখে লিপিকে লক্ষ্য করে মায়া, -ওপাশটা ধরো লিপি। -হ্যা ভাবী। খাটের পাশে রাখলো। আনোয়ারা চৌধুরী চোখ বন্ধ করে ছিলেন, ওনার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুর ফোঁটাগুলো পড়ে গেলো। মায়া ওনার পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিলো, তবুও চোখ না খুলে পা জড়িয়ে নিলেন, মায়া কাছে এগিয়ে গিয়ে অশ্রু মুছে দিয়ে, -খেয়ে নিন মা। এবার চোখ খুললেন মিসেস চৌধুরী, মায়ার দিকে তাকালেন,দৃষ্টিতে মমতা জড়ানো, কিন্তু কিছুই বললেননা। খাবারের দিকেও তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন মলিন কন্ঠে, -সামী খেয়েছে? -হ্যা মা ও ঘুমিয়েও গেছে, আরমান মল্লিকা ওরাও খেয়েছে। -কিন্তু তুমিতো খাওনি বৌমা, লিপি মায়ার প্লেট নিয়ে আয়তো মা। -হ আম্মা আনতাছি।   সকালবেলা। আজ সরকারী ছুটির দিন। মায়া সামীকে নিয়ে হাটতে বের হয়েছে। মায়া সামীকে বললো, -জানুয়ারীতে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো সামী। -সত্যি বলছো মা? মায়া ছেলের উৎফুল্ল মুখমন্ডল দেখে খুশি হলো, হেসে বললো, -হ্যা তো। সামী সামনে ওর বন্ধু তালহাকে দেখে পেলো, মায়াকে বললো, -আম্মু তালহাও এসেছে ওর আব্বুর সাথে, আমি ওর কাছে যাই? -ঠিক আছে তুমি যাও আমি এদিকটায় আছি হ্যা, তাড়তাড়ি আসবে। -আচ্ছা মা। সামী গিয়ে তালহার আব্বুকে সালাম দিয়ে তালহাকে বললো, -কেমন আছো? -ভালো, তোমাকে সালাম দিতে কে শিখিয়েছে? -সাব্বির মামা। -বিকেলে যার সাথে খেল? -হ্যা। তালহার আব্বু হেসে বললেন, -সামী কার সাথে এসেছো? -আম্মুর সাথে, ঐ দিকে গেছে, - তালহা তুমি সামীর সাথে  কথা বলো, আমি তোমার আংকেলদের সাথে দেখা করে আসি। -ঠিক আছে বাবা।   নাস্তার টেবিলে সবাই। মায়া অনেকদিন পর আজ শাড়ী পড়েছে, অবশ্য আনোয়ারা চৌধুরী বলেছিলেন অনেক দিন আগে, কিন্তু মায়ার পড়তে ইচ্ছে করেনি।  শাশুড়ী মায়ের মন ভালো করতেই আজ পড়েছে। সামী উৎফুল্ল কন্ঠে, -মা তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আনোয়ারা চৌধুরীও হাস্সোজ্জল কন্ঠে, -দেখেছো মায়া আমার দাদু ভাই পর্যর্ন্ত বুঝতে পেরেছে, সত্যিই সুন্দর লাগছে মা। আরমান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে। মল্লিকা মুখ ভংচি দিয়ে, -কাক কোনদিন ময়ুর হতে পারেনা, হাজার পেখম লাগালেও না। সামী খুব মন খারাপ করে, -ছোট মা তুমি আমর মাকে এভাবে কেন বলো? আর এখন তো তুমি মিথ্যা কথা বলছো। মল্লিকা রাগান্মিত কন্ঠে, -দেখেছো আরমান ঐ কাকের বাচ্চার মুখ ফুটে গেছে......... আরমানের কন্ঠে বিরক্ত, -আহ থামোতো মল্লিকা, ও তো  তোমাকে কিছু বলতে যায়নি তাইনা?   ১৯. রাত গভীর হতে চলেছে। মায়া ইদানিং তাহাজ্জুদ নামাজটা রেগুলার পড়ছে। এতে মনে মনে বেশ প্রশান্ত সে। মায়া হঠাৎই আরমান আর মল্লিকার কথা কাটাকাটির শব্দ শুনতে পায়, ভাবলো এতো রাতে? এভাবে...... আরমান মল্লিকাকে থামানের চেষ্টা করছে, আর মল্লিকা বলছে, -তুমি আমাকে ঐ ভুতনী, কাকের নাম ধরে ডাকো না? ঐ কালসিটেকে কালই যদি বাড়ী থেকে তাড়িয়ে না দাও তাহলে আমি পেটের ওটাকে মেরে ফেলবো। এখন বলো তুমি ওকে তাড়াবে কিনা, আরমান অধৈর্য্য কন্ঠে, -আমি আর পারছিনা মল্লিকা, একটু শান্তিতে থাকতে দাও প্লিজ, তোমাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাবাকে আমি মেরেই ফেললাম, ওটা মেরে ফেলায়, আমার অবাধ্যতার কারণেই বাবা সেদিন হার্ট ফেল করলেন। মল্লিকা কঠোর কন্ঠে, -আমি তিন গুনবো এর মধ্যে যদি ওকে তাড়ানোর প্রতিজ্ঞা না করো তাহলে এখনই ......... -না মল্লিকা এমনটা করোনা, দেখো, এটাতো আমাদের ভালোবাসার...... -তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথায় আর আমি ভুলছিনা, এক...... -আচ্ছা ঠিক আছে কালই বের হয়ে যেতে বলবো। যখন চারেদিকে অন্ধকার নেমে আসে তখন কোন আলোকেই আলো মনে হয়না। মায়ার জীবনের পুরো অংশে স্মামীর ভালোবাসার চ্যাপ্টারটা বড্ড ফ্যাকাশে রঙ্গের। পরের দিনই নাস্তার টেবিলে আরমান কিছু বলার আগেই মায়া বললো, -আমাকে দশ পনেরো দিন সময় দিতে হবে আরমান, এর মধ্যে ব্যাংক থেকে ট্রান্সফারের কাজ কমপ্লিট করে সব গোছগাছ, আর বাসা ঠিক করার কাজটাও করতে হবে। আরমান অবাক হয়ে তাকায়, সাথে মিসেস আনোয়ারা চৌধুরীও, আরমান চঞ্চল কন্ঠে, -কীসের কথা বলছো? -সেটা তুমি খুব ভালো করে জানো। আর হ্যা আমি মাকেও নিয়ে যেতে চাই। আনোয়ারা চৌধুরী হতবাক কন্ঠে, -মায়া আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, কি বলছো? -মা আমি, সামী আর আপনি আমরা ঢাকায় চলে যাবো।   সত্যিকার অর্থে এখানে থাকার কোন কারণই দেখছিনা, আর সামীকে আমি অনেক অনেক বড় করতে চাই ওকে খুব ভলো স্কুলে ভর্তি করাবো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন আনোয়ারা চৌধুরী, মাথা নিচু করে আরমান মল্লিকার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। আনোয়ারা চৌধুরী মলিন কন্ঠে, -এই বাড়ি কী আমি ছাড়তে পারি বৌমা। তোমার বাবার সমস্ত স্মৃতিতো এখানে, এটা ছাড়া আর কোথাও গিয়ে শান্তি পাবোনা। মায়া আমি যতোদিন বেঁচে আছি ততদিন কোথাও যেওনা মা। মায়ার মনোবল আগের মতোই শক্ত, দৃঢ় কন্ঠে, -মা আমি খুব ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সামী খুব ছোট। দুদিন পর বাড়িতে আরও একজন নতুন শিশু আসবে। সামী যখন সেই দেখবে ওর বাবা ঐ শিশুটাকে আদর করছে, ওর জন্য ...... তখন মনটা ভেঙ্গে যাবে ওর। মা ওতো অনেক ছোট। আমি যা কষ্ট পাওয়ার পেয়েছি, বাচ্চাটাকে আর কষ্ট পেতে দেবনা। রুদ্ধ হয়ে আসে মায়ার কন্ঠ, সামী কী বলে জানেন মা? বলে মা  তালহার বাবাতো তালহাকে খুব আদর করে, ওর জন্য খেলনা নিয়ে আসে, আমার বাবা কেন তা করেনা? এর জবাব তো আমার কাছে নেই মা। আমরা যাচ্ছি এটাই ফাইনাল। আনোয়ারা চৌধুরী আরমানের দিকে তাকান, তিনি এই প্রথম ছেলের দৃষ্টি ছলোছলো দেখতে পান। মল্লিকার মুখে কোন কথা নেই, নিঃশব্দে নাস্তা করে যাচ্ছে।   ২০. সামী রেডি হয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। মায়া আনোয়ারা চৌধুরীকে ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করছে। আরমান সামীর কাে এসে ওকে কোলে তুলে নেয়, রুমের দরোজায় মল্লিকা ভ্রু কুঁচকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামী খুশি হয়ে, -বাবা তুমি যাবে আমাদের সাথে? আরমান ছেলেকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিই শব্দ করে কেঁদে ওঠে, সবার অবাক দৃষ্টি সেদিকেই যায়। সাব্বির হুট করে উড়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আনোয়ারা চৌধুরীকে, -খালাম্মা আমি সামী মামার সাথে যাচ্ছি। আপনি কষ্ট করে অন্য ড্রাইভার রাখবেন, এসো মামা। বলে সামীকে কোলে নেয়ার জন্য হাত বাড়ায়। সামী বাবার কান্না দেখে মন খারাপ করে সাব্বিরের কাছে যায় বাবাকে কেঁদে কেঁদে বলে, -ঠিক আছে বাবা তোমাকে আমার সাথে যেতে হবেনা, তবুও কেঁদনা। মায়া একথা শুনে কেঁদে ফেলে। লিপি, আনোয়ারা চৌধুরী আগে থেকেই কাঁদছে। আরমান একটু পরে স্বাভাবিক কন্ঠে, -সাব্বির আমার যে গাড়ীটা আছে ওটা আমার সামীর জন্, তুমি গাড়ীতে করে ওদেরকে নিয়ে যাও। মায়ার পাশে এগিয়ে আসে আরমান, -বাসা ঠিক করা হয়েছ? -হ্যা। -কে করেছে? হাবীবকে বলে রেখেছিলাম। আচ্ছা ঠিক আছে আসছি, ভালো থেকো আরমান। আরমান মায়ার দিকে তাকায় এবার। কোমল সে দৃষ্টি, চলে যাবার জন্য পা বাড়ায় মায়া, সাব্বির আগে আগে সামীকে নিয়ে আর পিছু পিছু মায়া, শাশুড়ী মায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে, -সামী কে দেখতে ইচ্ছে করলে বলবেন, আমি সাব্বিরকে পাঠিয়ে দেব, আপনাকে নিয়ে যাবে। গাড়ীতে ওঠে ওরা। বিদায় নেয় মায়া। আর এ বাড়িতে পা না রাখার শক্ত সিদ্ধান্তে সামনে এগিয়ে যায় ছেলের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। (সমাপ্ত)

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)