সাহিত্য

তাড়া!

তাড়া!

ঘুম ভেঙে একটা কথাই আজকাল খুব মনে আসে,এতক্ষণ স্বপ্নে কতো মানুষ ছিলো আমার সাথে, এখন কেউ নেই! আমি একলাই সেই একই বাড়িতে একই ভাবে! তারপর শুরু হয় বিষন্নতার সাথে লড়াই করতে করতে সংসার যাত্রা।

স্বামীর অফিস যাবার প্রস্তুতি,বাচ্চাদের টিফিন, শ্বশুর শ্বাশুড়ির জন্য নাস্তা,বুয়া আসবে তার আগে কাজ গুলো গুছিয়ে ফেলা! এরপর বড় মেয়েকে দিয়ে এসে কোন রকম নাস্তা করে,দুপুরের রান্নার তোড়জোড় শুরু। ছেলের স্কুল এখনো বাসার কাছেই,দাদার সাথে আসা যাওয়া করছে কিন্তু এই ডিসেম্বরে ওর নাম লটারিতে দিতে হবে,আর দিলে কোথায় যাবে কে জানে,তখন আরেক প্রেশার শুরু হবে।


লাবন্যর আজকাল মনে হয়, বয়সটা কেমন জানি বেড়ে গেছে নাকি মনের বয়স বহু আগেই বেড়েছিলো এখন বুড়ি হয়ে যাচ্ছে! কোন রকম তোড়জোড় ভালো লাগে না,থাকুক যা যেভাবে আছে কি হবে অতো তাড়া নিয়ে? সেদিক থেকে দেবরের বউ মেহের এখনো অনেক তোড়জোড় এ আছে বলা যায়। পড়াশোনা শেষ করছে একটা বাচ্চা নিয়ে,তোড়জোড় করে ক্যারিয়ার সাজাতে হবে সেই সাথে সংসার। কোনদিকে তাকাবার সময় নেই বটে।
লাবন্যের সকালটা রান্নাঘরে শুরু হলেও,মেহের অবশ্য এদিকে খুব একটা আসে না। টেবিলে খাবার দেয়ার সময় এসে ধুপধাপ সব টেবিলে রেখে খেয়ে আবার নিজের রুমে চলে যায়।মাঝেমধ্যে এসে ছেলের জন্য খাবার,নিজের চা বুয়াকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম ২-১বছর এই নিয়ে শ্বাশুড়ি কথা বলতেন,এখন সবাই ই চুপ করেছে। কতো আর বলা যায়?

নুমাইরার স্কুলে যেতে দু'বার অটো চেঞ্জ করতে হয়,একটা ঝামেলা বটে! তার উপর আজকে অটো নেই বলা যায়,রাস্তায় জ্যাম। কি আর করা হাঁটতে শুরু করলো বা দৌড়ে যাচ্ছে যতোটা পারে। ৮.৩০ বাজলেই স্কুল গেট বন্ধ করে দিবে।
- এই ভাবি,আস্তে দৌড়ান সময় আছে তো।
মিশির মা এর কথা শুনে পাশে তাকালো,বেচারি সেরকম হাঁপাচ্ছেন। হেসে ফেললো লাবন্য।
- ধুর মিয়া,নিজে দৌড়াতে পারতেছেন না আবার আমাকেও দেন না,হইলো কিছু?
- আরে আজকে দেরি হয়ে গেলো,বের হতে হতে,গ্যাস থাকবে না শুনে রান্না করে আসতে হলো!
-কি বলেন ভাবি? গ্যাস থাকবে না? কখন থেকে? আঁতকে উঠলো লাবন্য।
মিশির মা এখনো হাঁপাচ্ছেই!
- গতকাল সন্ধ্যায় নাকি বলেছে,শুনেননি আপনারা? ৯টা থেকে চলে যাবে নাকি।
-ইয়া আল্লাহ! আমি তো দুপুরের রান্না করে আসেনি বাসার সব লোক কি খাবেন!" এতক্ষন দৌড়াতে পারলেও এখন আর পা চলছে না লাবন্যের। ওর হাঁটার গতি দেখে নুমাইরা তাড়া দিলো,
- আম্মু আস্তে হাঁটছো কেন?
লাবন্য খুবই দু:শ্চিন্তায় আছে। শ্বাশুড়ি প্রেশারের ঔষধ খেয়ে সেই সাতটায় নাস্তা করে ঘুমিয়েছেন,ফোন দিলে তো এখন ধরবেন না,তাহলে কাকে বলবে? অন্তত ডাল আর ডিম ভূনা করে রাখলেও হবে। মেহের কে বলবেন? অস্বস্তি লাগে লাবন্যের!

বাড়িতে গত ৩বছরে যতো রকন ঝড় তুফান ই আসুক,মেহের কে উনি কখনো ডেকে কাজের জন্য বলেননি। এদিকে এতো কিছু হয়,এক ছাদের নিচে থেকেও যখন কেউ রুমের বাইরে আসতে পারে না তখন তাকে ডেকে ডেকে কাজ করানোর কি আছে? সংসার তো তার নিজেরও। কিন্তু আজকে আর উপায় নেই মনে হচ্ছে!
ইগো ঝেড়ে ফোন দিলেন। ঘুম ঘুম গলায় ফোন ধরলো,মেহের। সব কথা বললেন৷ কোন কিছু পালটা জিজ্ঞেস না করে "আচ্ছা দেখছি কি করা যায়" বলে কল কেটে দিলো। এবার মনে হচ্ছে টেনশন আরও বেড়ে গেলো! একটা ম্যাসেজ দিলো নুমাইরার বাবা কে।
দৌড়ে বাসায় ফিরে বোরকা না খুলেই সোজা কিচেনে ঢুকলেন,ওমা! কিচেনে তো কিছুই দুপুরের জন্য করা হয়নি,যেভাবে রেখে গেছেন সেভাবেই আছে! বাজে ৯.১০।

হঠাৎ খুব কান্না করতে ইচ্ছে করলো লাবন্যের। আজকাল এতো স্ট্রেস লাগে কেন? সবার চিন্তা কি কেবল ওর ই? একদিন খাওয়ার কষ্ট করলে করবে,কি হবে ওতে? মরে যাবে না তো! আজব রকমের পাগল আসলে সে,নিজেকে বকতে বকতে চূলা জ্বালালো, গ্যাসের উত্তাপ কমে আসছে। দ্রুত ডিম ডাল দিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসলো। নাশিফ কে স্কুলে দিয়ে শ্বশুর ঘরে ঢুকে হাঁক ছাড়লেন,
-এই লাবন্য,আসছো বাসায়? আজ নাকি চূলায় গ্যাস থাকবে না,গতকাল নাকি বলেছে,কিছুই তো শুনলাম না মসজিদে কি একটা অবস্থা! বলতে বলতে কিচেনে শব্দ টের পেয়ে নিজের ঘরে গেলেন। কিন্তু তার গলার আওয়াজ শুনে অলরেডি নাসিমার ঘুম ভেঙে গেছে,উনার ঘুম হাল্কা নাকি কান খাড়া থাকে সব সময় কে জানে!
শ্বাশুড়ি কে রান্নাঘরে দেখে হেসে ফেললো লাবণ্য।
-মা ঘুম ভেঙে গেলো না? আহারে।
- কি করতেছো তুমি? চূলা জ্বলে? ব্যস্ত ভংগিতে তাকালেন ছেলের বউ এর দিকে।
- এখনো আছে কিছু! দেখি কি হয়। স্কুলের ওদিকে যেয়ে জানলাম আজকের এই অবস্থা! অর্ধেক পথে নুমাইরা কে মিশির মা এর সাথে দিয়ে দৌড়ে এসেছি,আজকে অটোও নাই কোন। কি যে অবস্থা।
নাসিমা এতক্ষণে খেয়াল করলেন,লাবণ্য এখনো বোরকা খুলেনি,ভিজে একাকার হয়ে আছে। খেয়েছিলো সকালে কিছু?

ধীর পায়ে ডায়নিং টেবিলে এসে বসলেন। হটপটে রুটি-ভাজি রাখা আছে,ফ্লাস্কে চা। ছোট ছেলের ঘরের দরজা এখনো বন্ধ। তারমানে মেহের ঘুমাচ্ছে। বাচ্চা রাত জাগে প্রায়ই, এজন্য সকালে দেরি করে উঠে। কিন্তু আজকে রাগ লাগছে বটে! এরকম প্রায় ই লাগে আসলে,যখন দেখে বড় বউটা পাগলের মতো কাজ করেই যাচ্ছে ওদিকে আরেকজন দরজা বন্ধ করে আছে। তখন নিজেকে অপরাধী মনে হয়৷
প্রথম বউ হিসেবে লাবণ্য কে যতোটা সংসারের কাজ করাতে পেরেছেন তার সিঁকি ভাগ ও মেহের কে গত সাড়ে তিন বছরে পারেননি। অথচ অনার্সে ভর্তি হবার পরের মাসেই লাবন্য বউ হয়ে এসেছিলো,স্কুলে থাকতে ওর মা মারা যান,ছোট ভাই বাবা আর সৎ মা এর সংসারে লাবণ্য কাজ করা ছাড়া বড় হয়নি,খুবই পরিশ্রমী আর আন্তরিক। মা না থাকায়,সবার কাছেই আদর খুজে মেয়েটা! গত ১১বছরে সে আন্তরিকতায় এতটুকু ভাটা আসেনি,তার সাথে তো পেটের সন্তানের মতোই আবদার অভিমান করে,প্রথম দিকে শ্বাশুড়ি ভাবটা ধরে রাখলেও ধীরে ধীরে সেসব ছেড়ে দিয়েছেন,সবার সাথে সব কিছু ধরে রাখার দরকার নেই। তাই লাবণ্য তার নিজের আরেক সন্তান। এই সংসার এই মানুষদের কাউকেই কখনোই লাবন্য শ্বশুর বাড়ি ভাবেনি,কতোজনের কতো কথা কিন্তু সেগুলো কানেও তুলেনি।


নাসিমা ও তাই পারেন না লাবণ্য কে ছেলের বউ ভাবতে। মাঝেমধ্যে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানানোর ভাষা খুঁজে পান না। নিজে শ্বশুর বাড়ি কতো কষ্ট করেছেন কিন্তু আল্লাহ তাকে লাবণ্য এর মতো বউ দিয়েছেন। মেহের যদি কিছুটা হলেও অমন হতো,তাহলে কতো ভালো হতো! মেহেরের এমন স্বার্থপর আচরণ যে লাবণ্য কে ও কষ্ট দেয়,উনি বুঝেন। কিন্তু মেহের ই বুঝে না,'এটা আমার নিজের সংসার না' এই মানুসিকতা ওর নিজের জন্য ই ক্ষতিকর।
১০টার দিকে চুলা একেবারেই বন্ধ হলো বলা যায়। লাবণ্য হাফ ছাড়ে,ডিম ভূনা আর ডাল রান্না হয়েছে,সাথে কপি ভাজি। রাইস কুকারে ভাত করলেই হবে। আলহামদুলিল্লাহ বলে নিজের ঘরের দিকে যায়। ডায়নিং টেবিলে মাথা রেখে মা কে ঘুমাতে দেখলো,বেচারি! সংসারের পেরেশানি রেখে বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমানো যায় না আসলে,যদিও শরীর কাজ করতে দেয় না কিন্তু মনের অস্থিরতা তো থাকেই। কলিং বেলের শব্দে লাবণ্য দ্রুত দরজায় গেলো,বুয়া এসেছে। নাসিমাও টের পেলেন।
- লাবণ্য, নাস্তা করতে বসো,কয়টা বাজে? আবার তো বের হতে হবে। বুয়ার কাজ আমি দেখছি।
প্লেটে নাস্তা নিয়ে বসলো ওদিকে মেহের বের হয়ে এসেছে। ওর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করতেছে না আজকে লাবণ্যের। কিন্তু ঝামেলা তৈরি করতে চায় না। হাল্কা করে হাসলো।
-ভাবি তুমি কি সকালে আমাকে ফোন দিয়েছিলে? আমি কিছুই মনে করতে পারছি না,ঘুমের তালে কি শুনেছি!
রাগে গা টা জ্বলে গেলেও কন্ঠে কিছু প্রকাশ করতে চাইলো না।
-না তেমন কিছু না। গ্যাস থাকবে না,আমি তো স্কুলে যাচ্ছিলাম তখন,আসতে আসতে দেরি হয়ে যেতে পারে এজন্য একটু রান্না করতে বলেছিলাম।
- গ্যাস নাই আজকে? হায় আল্লাহ! মিহানের খিচুড়ি তো রান্না করলাম না কি খাবে ছেলেটা? রাতে তো কিছু জানালেন না আমাকে! কেমন কথা ভাবি? আমার বাচ্চাটা তো ছোট! ধুর
লাবণ্য রাগ চেপে কিছু বলার আগেই শ্বাশুড়ি আসলেন। শান্ত কিন্তু শক্ত গলায় বললেন,
- গ্যাস যে আজকে থাকবে না এটা আমরা কেউ ই জানতাম না। লাবণ্য স্কুলে যাবার পথে জেনেছিলো,এজন্যই তোমাকে ফোণ দিয়েছিলো আমাদের জন্য দরকার না হোক,নিজের বাচ্চার জন্য রান্না করতেও তো উঠতে পারতে? এখন এতো অস্থির না হয়ে খেয়ে নিয়ে,রাইস কুকারে সব রেডি করে বসিয়ে দাও। কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না কেবল ব্যবহার টা ই মনে থাকে।
রাগে অপমানে মুখ লাল হয়ে গেলো মেহেরের। সুযোগ পেয়ে এরকম দুর্ব্যবহার এরা দুইজন আজকে করলো?কি অবস্থা! 


লাবন্যের মতো ওকে কেন হতে হবে? ওর যোগ্যতা কি লাবন্যের মতো? এই শহরে বাবার নিজের ৬তলা বাড়ি আছে,একমাত্র মেয়ে দেখতে সুন্দরী জামাই লাখ টাকা বেতনের চাকুরী করে,লেখাপড়া করে নিজের ক্যারিয়ার না গুছালেও সমস্যা নেই,ওর জন্য সব ই রেডি আছে। কিন্তু লাবন্য ভাবির এই সংসার ছাড়া আর কি আছে? বাপের বাড়িতে সৎ মা,নিজে দেখতেও অতো ভালো না,স্মার্ট তো না ই,সরকারি ভার্সিটিতে পড়েও কিছুই করতে পারেনি। তো সংসারে সারাদিন কাজ না করে করবে কি? কিন্তু বাড়ির বাকিদের কি মেন্টালিটি! সব কিছুতেই ওকে লাবন্যের সাথে তুলনা! ফালতু মানুসিকতা! এতো কাজ করা বউ লাগলে ওকে আনলো কেন? লাবন্যের মতো কাউকে আনতো! যত্তসব।
বাচ্চাকে নিয়ে মেহের কে বের হতে দেখে লাবন্য জিজ্ঞেস করলো,কোথাও যাচ্ছ?
-আম্মুর বাসায়। এখানে আমার ছেলের খাবারের খেয়াল রাখার কেউ নেই।বিকেলে চলে আসবো,মা কে বলো নাইলে তার ছেলেকে ফোন দিবে আবার!" লাবন্য একটা নি:শ্বাস ফেললো। যাক তাও ভালো মায়ের বাসা আছে,রাগ করে হলেও যেতে পারে। ভেতরটা আবার ফাঁকা লাগতে শুরু করলো।

১২.০৩টায় নুমাইরার ছুটি হবে। নাশিফ কে হোমওয়ার্ক নিয়ে দাদার কাছে দিয়ে ও বের হলো। অটো একবার পাল্টে আর নিতে ইচ্ছে করলো না,আপন মনে হাঁটতে লাগলো,চারপাশে কতো মানুষ কিন্তু ও কি ভীষণ একলা!

মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছে, কেমন চুপ করে চলে গিয়েছিলো,সদ্য কৈশোরে পা দেয়া মেয়েকে রেখে। এতো মানুষের ভীড়েও ছেলে মেয়েরা তার কতো একলা বড় হবে এটা কি জানতেন? মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা সিগারেট ধরলো,ওদের কে এড়িয়ে চলতেন,একলা জীবনটা আরোও দুর্বিষহ হয়েছিলো,বাবা এখন ক্যান্সারের সাথে লড়ছেন। তাও ভালো ভাইটা কোন রকমে ইউএস যেতে পেরেছে। অন্তত বাবার জন্য চিন্তা কমেছে।

স্কুল গেটে নুমাইরা মা কে দেখে হাসছে,যদিও সাথে বান্ধবিরা আছে।গল্প করতে করতে আস্তে আস্তে আসছে এদিকে কিন্তু মেয়েটার হাসি দেখতে খুব ভালো লাগছে। লাবন্যের চোখ ভিজে উঠছে বারবার,তার মেয়েটাও কি তারমতো বয়সেই মা হারাবে? বুকটা ভারী লাগে খুব।
এই যে সংসার এই যে টানাপোড়েনের গল্পটা রোজকার। এরমাঝেও লাবন্য কে তাড়া করে ফেরে আতংক! এইটা কার সংসার? আমার না শ্বাশুড়ির তারচেয়ে বেশি ভয় লাগে,ছেড়ে যাবার কষ্ট! জিবনে যা ই যখন এসেছে তাকেই আপন ভেবেছেন,যদি না আবার হারিয়ে যায় এই ভয়ে! কিন্তু সবার কি সে ভয় থাকে? থাকতে নেই। এই ভয় কখনো নুমাইরার জীবনে না আসুক কখনো মেহেরের জীবনেও না আসুক,সেই দুয়াই করেন লাবণ্য।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ