সাহিত্য

প্রচেষ্টা

প্রচেষ্টা

দিনের শুরুটা ভীষণ ব্যস্ততায় চলে গেলেও দিনের শেষাংশে কেন জানি অতো তাড়া অনুভব হয় না কিন্তু তখনো আসলে ব্যস্ততা ই থাকে। এক সন্ধ্যে আরেকটা রাত্রী এরপর আসবে সকাল। চক্রাকারে চলতে থাকা ব্যস্ততা থেকে অবসর এলেই বা কি? জীবন ওসবে অভ্যস্ত হতেই পারে না!


আজকাল তুলির মেজাজ খুবই খিটখিটে হয়ে থাকছে! সারাক্ষণ সব চিন্তা করা যায়? সংসারের সব কাজ কখন কিভাবে হবে কার কি লাগবে সবই একা করতে হচ্ছে,কয়দিন ভালো লাগে? উফ! অন্যদিকে বাচ্চাদের দাদী গেছেন তার মেয়ের বাসায়৷ উনি থাকলে যথেষ্ট কম চিন্তা ই করা লাগে বলা যায়। বিয়ের পর থেকে সংসারে সব সময় ই শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ছিলেন,বছর ৪ হলো শ্বশুর মারা গেছেন। দুই দেবর বিদেশেই সংসারী।
নিজের দুই বাচ্চাকে স্কুলে দেয়ার পর থেকে তুলির ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। দুইজনের দুই সময় এ স্কুল শুরু এবং ছুটি, দুইজনের স্কুল ও দুই দিকে। একজন দিয়ে এসে আরেকজন কে নিয়ে যায় আবার এভাবে ই আসা। এরমধ্যে সংসার কিভাবে সামলাবে,তাই শ্বাশুড়ি ই ভরসা। বুয়াকে দিয়ে কাজ করানো, রান্না সবই উনি করে রাখেন।


এজন্যই উনি মেয়ের বাসায় গেলে বিশাল ঝামেলায় পরে যায় তুলি। আজকাল তো বলা যায়,প্রচন্ড রাগ উঠে যায় যদি মা বলেন,আমি ক'টা দিন দিপাদের বাসা থেকে ঘুরে আসি৷ উনি ভালো করেই জানেন,সংসারে উনার কতোটা প্রয়োজন তবুও কেন প্রতি মাসেই এরকম মেয়ের বাসায় যেতেই হবে? সব ঠেকা কি শুধু আমার? নাতি-নাতনিদের জন্য উনার কোন ভাবনা নেই? অথচ এক জীবনে,এই শ্বশুর শ্বাশুড়ি কে ই সহ্য করতে পারতো না তুলি! সব কিছুতেই উনাদের কে বাঁধা মনে করতো,সময়ে কতো কিছুই বদলে যায়,সবচেয়ে বেশি বদলায় মানুষ!
ছোট বাচ্চার স্কুল ছুটির আগে,স্কুলের সামনে এক পাশে বসে আনমনে এসব ই ভাবছিলো তুলি। ইনানের বাবার সাথে গতকাল রাতে ঝগড়া হয়েছে! প্রতিদিন বুয়াকে দুপুরে আসতে বলা যায় না,তার সাথে সকালে কাজের চুক্তি, মা কে যেনো তাড়াতাড়ি আসতে বলে। কিন্তু ইমরান বিরক্ত হয়ে যায়,
-বুয়া চেঞ্জ করে দুপুরের দিকে এসে কাজ করবে এমন কাউকে দেখো।
- ওরকম বুয়া পাচ্ছিনা,আর দুপুরে এসে কাজ করলে সকালের নাস্তা কে করবে? আমার সময় হয় না দেখো না?
- তুমি ভালো করেই জানো,মা রাতে ঘুমাতে পারেন না,সকালে উনার ঘুমানো জরুরি কিন্তু তুমি চলে যাও আমিও চলে যাই তখন এই বুয়ার কাজ দেখার জন্য মা কে জেগে থাকতে হয়,না ঘুমাতে ঘুমাতে তো মা অসূস্থ হয়ে যান,এজন্য ই আপুর বাসায় যেয়ে ক'দিন রেস্ট নিয়ে আসেন।
তুলির রাগ বেড়ে যায়।
- উনার স্বাস্থ্য দেখবো ঘুম দেখবো তোমার টাইমলি তিন বেলার খাওয়া তাও একদম ই ঘরে তৈরী,বাচ্চাদের ভালো স্কুল,ভালো রেজাল্ট,কোচিং ক্লাস  আর একদম ফিটফাট বাসা। সব আমাকেই কেন দেখতে হবে? তোমাদের মা-ছেলের কোন ভূমিকা নাই? আমি পারবো না এতো!
মোটামুটি কথা বাড়তে বাড়তে ঝগড়া বেশ ভালো ভাবেই হয়৷ সকালে নাস্তা না করেই বের হয়েছে আজকে।

কেমন যেনো সব খুব এলোমেলো লাগে। জীবনটা কি আসলে এমন ই হবার কথা? এক সময় নিজেকে নিয়ে এরপর সংসার এরপর সন্তান এবং সব ভাবনা কেবল এক দিকেই চলে যায়? কি করবে বুঝতে পারছে না তুলি! শ্বাশুড়ির বয়স হচ্ছে,অসূস্থতা আছে এদিকটাও তো ভাবা দরকার। কিন্তু ইমরান কি পারে না একটু ব্যালেন্স করতে? পদে পদে ওর কাছ থেকে জবাবদিহি না নিয়ে কিছু দায়িত্ব ভাগ করতে। তুলির সাথে আর কিছু না হোক,মনের কথা গুলোই একটু শুনুক। একটা সময় সংসার আর বয়স মিলিয়ে কথা বলার মানুষ খুঁজে পাওয়া দায় অথচ তখন কথা বললেই অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়৷
-এই যে তুলি ভাবি? কি অবস্থা? 
মাহিবের মায়ের ডাকে মুখ তুললো,
- এই তো ভাবি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনার কি অবস্থা?
-২দিন ধরে বুয়া নাই,কি অবস্থা বুঝে নেন!
হেসে ফেললো দু'জনেই। এক ঢোক পানি খেয়ে আবার বললেন,
-সাফার মায়ের অবস্থা দেখেছেন?
দূরে একপাশে তাকালো তুলি৷ ওর বাচ্চার সাথেই পড়ে সাফা,আবার বাবু হবে এই ভাবিটার। 
-হুম,সময় হয়ে এসেছে মনে হচ্ছে,এই মাসেই ডেট না? 
-এই মাসে না আগামী সপ্তাহেই। বাপের বাড়ি যেতে পারছেন না,সাফার দাদী দিবে না। সে চলে গেলে সংসার দেখবে কে? হসপিটাল থেকে বাপের বাড়ি যেতে বলেছে।
তুলি অবাক হয়ে যায়,সাফার মায়ের হাই প্রেশার,এক্লেম্পশিয়া রিস্ক আছে উনার,এই অবস্থাতেও বাসার কাজের চিন্তা নিয়ে থাকতে হচ্ছে! এটা কোন কথা?
- কি বলেন ভাবি! বেচারির হাঁটতেই তো কষ্ট,এই ভারি শরীর নিয়ে পাঁচ তলার সিঁড়ি বেয়ে যাচ্ছেন এখনো!বাসায় তো কাজের লোক আছে,আরেকটা বউ আছে।
- সেই বউ চাকরি করেন না? আর বুয়ার কাজ কে দেখবে? সাফার বাপ তার মায়ের বকা,চিৎকারের সাথে পারেন না নাকি। কি আর করা?
এবার মেজাজটাই খারাপ লাগতে শুরু করলো। এগুলো কি মানুষরে ভাই! সময় বুঝে না,মন বুঝে না খালি নিজেদের প্রয়োজন টা নিয়েই থাকে।

বাসায় ফিরে কিচেনে গেলো,সাধারণত এ সময় টা তে ইজাফা কে খাইয়ে কার্টুন দেখতে দিয়ে নিজে এক কাপ চা খায়। এরপর বুয়া আসলে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রান্নাটা সেরে ইনান কে আনার জন্য বের হয়৷ বুয়া থাকতে থাকতেই বাসায় ফিরে আসে আবার।
ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে গতকালের কাটা বাড়তি কিছু সব্জি নামায়। একটু একটু করে দুপুরের রান্না বসিয়ে দিলো নিজেই। এখন থেকে বুয়া আসলে কিছু সব্জি কাটিয়ে রেখে দিবে আগামীকাল এর জন্য। সকালের নাস্তায় সহজে কি করা যায় এরকম কিছু ভাবতে লাগলো।
জানলার মানি প্ল্যান্টের দিকে তাকিয়ে সানিয়া ভাবির কথা মনে পরলো। চাচাতো ভাইয়ের বউ,দুই বাচ্চা সংসার চাকরি একাই সামলান,সব কিছু রুটিন করা তার,সারাক্ষণ ছুটে বেড়ান,টিপটপ আর পরিপাটি নিজেও থাকেন,সংসারকেও রাখেন। ওদিকে নিজের বড় বোন,সেও সব করছে।

তিন বোনের মধ্যে কেবল নিজেকেই কেমন বেমানাম লাগে তুলির! সব সময় ই সব কাজে কাউকে সাথে চাই আবার অন্যের ভুলটাও বেশিই চোখে পরে। সেই ছোট থেকেই এরকম বলে,কলেজ পর্যন্ত মা থাকতেন সাথে অথবা আপু,ভার্সিটিতে বান্ধবি ছিলো।  সংসারেও শ্বাশুড়ি।তবুও অল্পেই বিরক্তি লাগে তুলির,কিছুই যেনো হয়নি,সব কেন ওকেই করতে হবে এরকম একটা চিন্তা সারাক্ষণ ই থাকে। 
আদতে কি সব সময় কারও উপর নির্ভরশীল থাকা যায়? কেউ কি কাউকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করতে পারে?
ছোট বোন মলি তার অনার্সের সেমিস্টার ব্রেক নিয়েছিলো,কারণ ইনান কে রেখে ও মাস্টার্সের ক্লাস করতে পারে না,শ্বাশুড়ির কাছে রাখবে না তাই,উনার উপর ভরসা ছিলো না তখন মোটেও। অথচ আজকে সেই মলিই ওর বাচ্চাকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে পড়াশোনা শেষ করেছে,সংসার-চাকরি সামলাচ্ছে।


একটা সময় পর্যন্ত এই স্বভাব গুলোর জন্য নিজেকে আলাদা এবং দামী ই মনে হতো কিন্তু আজকাল আর মনে হয় না। বরং সবার বিরক্ত আর সংসারের এই এলোমেলো অবস্থা নিতে ইচ্ছে করে না,কখনো নিজেকেই দায়ী মনে হয়। সব একাই গুছিয়ে করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অভ্যাসে অথবা ইগোতে আটকে যায় বারবার। 
প্রতিবার বুয়া নিয়ে ঝামেলা হলেই,স্বামী -শ্বাশুড়ি বলেন,
-একটু নিজে এবার কাজ গুলোর দিকে মনোযোগ দাও তোমার কাজ তোমার মনের মতো করে কেউ করতে পারবে না,করলে তুমিও বুঝবে আসলে কিভাবে করতে কেমন লাগে।
কিন্তু এসব বিষাক্ত লাগতো শুনতে। কাজ কেন এতো করতে হবে,তাহলে বাকিরা কেন আছে? এতো রুটিন ধরে স্ট্রেস নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। হইলে হবে না হলে নাই।
মোবাইল বেজে উঠে। বুয়ার বাচ্চার জ্বর,আসতে পারবে না আজকে। অন্যদিন হলে মেজাজের আগুনে সব জ্বলে উঠতো কিন্তু আজকে ইচ্ছে করছে না। বরং কিভাবে কোন কাজ ম্যানেজ করা যায় সেসব মাথায় আসছে। অদ্ভুদ!
ইজাফা কে ওর টেবিল আর ঘরের খেলনা ঘুছাতে বললো। ৭বছরের মেয়েটা অবাক হয়ে তাকালো! ওকে গুছাতে বলছে মা?!! রান্নাঘরের কাজ শেষ করতে করতে ১২.৩০টা প্রায় বাজে,মেয়েকে নিয়ে ছুটলো ছেলের স্কুলে।
ইনান কে যখন বললো,রান্নাঘর থেকে খাবার প্লেটে নিয়ে এসে খেতে, সে বেচারাও অবাক! অন্যদিন সে এসেই ড্রেস চেঞ্জ না করেই টিভি অন করে।
বিকেলের নাস্তাটা আজ অনেকদিন পর বাসায় তৈরী ছিলো,বাচ্চারা খেয়ে প্রশংসা করলো খুব। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তুলি! ওরা খেলতে চলে গেলে নিজের জন্য চা নিয়ে বসলো। পুরিটা ভালোই লাগছে খেতে।


ইজাফা ডায়নিং রুমে এসে মা কে কান্না করতে দেখে অবাক হয়! চুপ করে মায়ের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে। তুলিও মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়,
"তুমিও সব করতে পারো তুলি,তুমিও পারো।না হয় সানিয়া ভাবির মতো হবে না কিন্তু তোমার টা তোমার মতোই ভালো হবে।অনেক ভালো করছো,এই তো আস্তে আস্তে আরোও ভালো করবে ইনশাআল্লাহ। ইজাফা তোমার মতো হবে না সে ও আত্ননির্ভরশীল হবে,নিজের জন্য কাউকে অতো কষ্ট দিবে না,ইনশাআল্লাহ।"


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন