সাহিত্য

গোর

গোর

সামনে অদূরে একটা মসজিদ মিনার উঁচু করে দাড়িয়ে আছে সগৌরবে।পাশেই বিশাল মাদরাসার পাঠকক্ষ থেকে কুরআন হিফজ করবার শব্দ ভেসে আসছে একটানা,তালিবুল ইলমের তত্ত্বাবধান করছেন উস্তায। একটু অদূরে শানবাঁধানো ঘাটে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওযু করছে।মসজিদ সামনে পাকা সড়ক বয়ে গেছে বহুদূর,রিকশা থেকে ধীরপায়ে নেমে এলো দু'জন। তাদের গন্তব্য মসজিদের পাশেই পারিবারিক কবরস্হানে, যেখানে কিছুদিন আগেও কেউ ছিলো না।আজ চিরস্হায়ী আবাসের বাসিন্দা হয়ে অতীত হয়ে গেছেন একজন।মাহমুদ আর মুনতাহা দুজন একটু দূরে দাড়িয়ে কবরবাসীর উদ্দেশ্য দু'আ পাঠ করলো।মুনতাহা'র চোখ দিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরছে, মাহমুদ একটু পাশে এসে দাড়ায় কিন্তু চোখ মুছে কান্নায় বাধঁ সাধতে চায় না,মনখুলে কাঁদুক মেয়েটা।মুনতাহা নিজেই স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকে ঠিক গতবছর ওর নানুভাই কি বলেছিলেন সেই কথাগুলো,মসজিদের কাছে নির্ধারিত জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন, "নানুভাই এইযে আমার আসল আবাস,তিনহাত জায়গা সারাজীবনের অর্জন।"জায়গাটা পরিস্কার করতেন প্রায় ঝোপ-জঙ্গলে আবৃত হয়ে গেলেই,ঠিক যেন আপন আবাস পরিপাটি করে গোছায়ে রাখছেন।এসব কথা বলতে বলতেই মুনতাহা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় যায় এমনি অবস্হায় মাহমুদ তাঁকে ধরে ফেলে।

মানুষের চাওয়া-পাওয়া ভালোবাসার তীব্রতার পরিসীমানা স্রষ্টাই ভালো জানেন।গভীর আকুলতায় কিছু চাইলে হয়তো তিনি কবুল করে নেন কখনো কখনো।একসপ্তাহ পর ফযরের সালাতের পর সেই একই গোরের সামনে দাড়ায়ে আছে মাহমুদ।কিন্তু ছোট্ট একটা পরিবর্তন সেখানে, আজ সেখানে দু'টি কবর রয়েছে।একটি পুরাতন,আরেকটি নতুন।পুরানো কবরটির চারপাশে কেমন কার্পেটের মতো ঘাস গজিয়ে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে।মুনতাহা শৈশবে বাবা-মা হারিয়ে নানুভাইয়ের কাছে বড়ো হয়েছিলো,নানুভাই ছিলো তার কলিজার টুকরো।তার কোন অসুস্হতা কিংবা বিচ্ছেদ তার সহনীয় ক্ষমতার উর্ধ্বে ছিলো।মুনতাহা যখন ছোট্ট তখন কেউ যদি ক্ষেপাতো,তোমার নানুভাই যদি মারা যান তবে, কি হবে.... মুনতাহা শুধু বলতো,আমাকেও মাথায় একটা গুলি মেরে নানুভাইয়ের পাশেই গোর দিও।"বিয়ের পর মাহমুদ এসব শুনেছে ওর ছোটমামার কাছ থেকে,মুনতাহার অস্হিরতাও সে বুঝতে পেরেছিলো,বিয়ের প্রথম কয়েকমাসে সে কতোবার তার নানুর কাছে চলে আসবে বলে,নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে থাকতো,শেষে কক্সবাজার ট্যূর বাতিল করে একমাস নানুভাইয়ের কাছেই ছিলো ওরা।ঢাকায় চলে আসবার সময় সে যে কি অবস্হা হয়েছিলো,মুনতাহাকে সামলাতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছিলো।

হোমকোয়ারেন্টাইনের সময় মুনতাহার নানুভাই মারা যান।ওকে কিছুতেই জানাতে চাইছিলো না সে,কিন্তু মুনতাহা কি করে সব বুঝে যায়।রমজানের সেই সময়টা খাওয়াদাওয়া ভুলে সিজদায় পড়ে থাকতো,শুধু শেষ বার তার কলিজার টুকরো নানুভাইকে দেখবার জন্য।তার শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়েছিলো, সে রক্ষা হলো না। নানুভাইয়ের কাছেই চলে গেলো আদুরে মেয়েটা তাকে একদম একলা করে দিয়ে।আজ ঈদের দিন মাহমুদ দাড়িয়ে আছে নিশ্চল হয়ে সেই গোরের সামনে। হয়তো সবুজ ঘাসে একদিন এই কবরটাও সবুজ ঘাসে ঢেকে যাবে।ছোট ছোট ঘাসফুলেরা ফুটে শিশিরে স্নাত হবে রোজ।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)