সাহিত্য

নিষন্ন প্রহর

নিষন্ন প্রহর

একটানা বৃষ্টির ঝরঝর ঐকতান।ছন্দপতন নেই যেন। আজকাল বিকেল হতেই সারা আকাশ ঢেকে যায় তুলো তুলো মেঘে,ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসে চারপাশে।এই বিদ্যুত চমকানো বাদলার সময়টা কেমন অপার্থিব মোহময়তায় নিমগ্ন। ঘরবন্দী সময়ে আতিকা বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়,বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগে তার।মনটা কেমন প্রচন্ড আকুপাকু করতে থাকে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে গোসল করতে।গায়ের পুকুরে সাতরে বেড়ানো,মাথার উপর বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোটা এসে ঝরতো। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গুনগুনিয়ে গাইতো রবীঠাকুরের " আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে,জানিনে আমি জানিনে,কিছুতে কেমন যেন লাগে না......
গাছের শাখাভর্তি কদম ফুটতে শুরু করেছে হয়তো,তখন গাইতো,"বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল...."পুকুরপাড়ের ঝোপে উঁকিঝুঁকি দেয় শুভ্র বেলীফুলের দল,কিংবা লাল রক্তজবা।পানিতে ভিজতে ভিজতে হাতপা যখন থিতু হয়ে আসতো,তখন শুকনো গামছায় গা মুছে বাড়ির সামনে বেঞ্চিতে এককাপ লেবু চা,বৃষ্টির পানিতে চায়ের রং হয় বেশ প্রগাড় লাল!বেশ জমিদারী  কায়দায় আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে,মনটা ফুরফুর করে উঠতো।বৈঠকখানার চারপাশে ঝুলিয়ে দেওয়া মাধবীকুঞ্জে ফুটি ফুটি করে একরাশ মাধবীলতার ফুল, কেমন গোলাপের সুরভি একটু কাঠগোলাপের কম্মিনেশন এ,বিমুগ্ধতায় চিত্ত বিগলিত হয় উঠেতো।এসব ভাবতেই ভাবতেই আতিকা কেমন বিষন্ন বেদনা অনুভব করে।

পৃথিবীর সব কর্মচঞ্চলতা একনিমিষে কেমন থমকে গেছে!যুদ্ধ থেমে গেছে,অর্থনীতির চাকা হেলে পড়েছে,ইঁদুর-বেড়াল দৌড় ভুলে সবাই নিজেকে বন্ধ রেখেছে গৃহকোণে!সারাদিন বইয়ের পাতা উল্টে,পায়চারী করে,ঘর থেকে বারান্দায় এমন করে আতিকার হাঁশফাস করে।আজকাল খুব মায়ের কথা মনে হয় তার,সেই হাইস্কুলে পড়বার সময় তাঁকে হারিয়েছে সে।তারপর,নানুভাই তাকে আগলে এতোদূর বড়ো করেছেন।বৃষ্টির ফোটা ফোটা কনায় জানালার কাচ অস্বচ্ছ করে দিয়েছে।একটা ন্যাকড়া এনপ জানালার কাচটা মোছে আতিকা,তারপর আবার বাইরে তাকায়ে থাকে।খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয় তার,প্রিয় মানুষদের সাথে একসাথে প্রাণভরে বাঁচতে ইচ্ছে হয়!
রমজানের মাসের প্রথমদিন কেমন যেন শূন্যতায় এসে কড়া নাড়লো। ইফতারের টেবিলে চারজোড়া হাতশুধু মোনাজাত ধরে,টপটপ অশ্রু ফেললো অলক্ষ্যে। আতিকা এক গ্লাস পানি খেয়ে আর খেতে পারে না।অভুক্ত মানুষের ত্রাণের আর্তির কথা মনে পড়ে ওর,এই উপলব্ধি নিয়ে কতোটুকুই বা বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়াতে পারে সে!নিজের অক্ষমতায় সান্তনা খুঁজে পায় না।তখন প্রিয় রবের কথা মনে আসে তার,
" অসংখ্য জীব এমন রয়েছে যারা নিজেদের রিয্কের ভান্ডার বহন করে বেড়ায় না।আল্লাহই তাদেরকে রিয্ক দেন এবং তোমাদের রিয্কও তিনিই দেন।"-সূরা আল আনকাবূত:৬০
আতিকা জানে আল্লাহ কারো সাধ্যাতীত কিছুর জন্য জবাবদিহি করবেন না,কাউকে পাকড়াও করবেন না।সামনে পরীক্ষার দিনগুলোতে যেন দিশেহারা না হয় সেই দু'আই করে সে।কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
"এবং আমি অবশ্যই তোমাদেরকে ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি, অনাহার এবং অর্থসম্পদ,জীবন ও ফলফসলের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো।আর সবর অবলম্বনকারীদের সুসংবাদ দাও।"-সূরা বাকারা:১৫৫
প্রথম রামাদান সন্ধ্যায় বৃষ্টির ফোটায় ফোটায় দু'আরা পৌছে যায় আসমানে, সবর আর প্রশান্তিময় বার্তা নিয়ে।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)