সাহিত্য

মিস্টার প্ল্যানিং এর খপ্পরে

মিস্টার প্ল্যানিং এর খপ্পরে

মাইশা ও নোশিন দুজনই রামাদান নিয়ে বেশ উৎফুল্ল, আশান্বিত হয়ে অপেক্ষা করছে।এবারের রামাদান অন্যবারের তুলনায় বেশীই আলাদা।পুরো পৃথিবী কোয়ারেন্টাইনে বন্দী, চারপাশ স্তব্ধ, মৃত্যুর মিছিল কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।পড়াশোনা,স্কুল-কলেজ সব অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ,রুটিনমাফিক টিউশন,ক্লাস কোচিংয়ের চাপ থেকে দু'বোনই মুক্ত।মাইশা ও নোশিন দুই চাচাত বোন।একই বাসার দুই ফ্লাটে থাকে তাদের পরিবার।মাইশা ক্লাস টেন এ উঠেছে এবার,নোশিন ক্লাস ফাইভ এ।দু'বোনের তাই সারাক্ষণ কাটে একসাথে গল্প করে,বই পড়ে,শখের রান্না শিখে।রমজানের মাত্র চার-পাঁচ দিন দেরী,এসময় আব্বু-চাচ্চু সবাই মিলে বসেন পরিবারের পিচ্চি-পাচ্চাদের নিয়ে।কি করে সুন্দর করে রমজানকে মহিমান্বিত করা যায়।আজকের বিকেলে সেরকমই একটা আসর রয়েছে,মাইশাদের বারান্দায়।

মাইশার মামনি বাগান করতে ভালোবাসেন তিনি বারান্দায় শখের অনেক গাছ বুনেছেন,হরেকরকম ক্যাকটাস, ফুলের গাছ,ছোট্ট ওষুধী গাছও রয়েছে কয়েকটা। এর মধ্যে একধারে একটা গোলটেবিলের চারধারে কিছু চেয়ার পাতা।মাইশা-নোশিন, ওদের দুই পিচকু ভাইও এসে বসেছে ওদের দুজনের মাঝেই।মাহমুদ ও আহমদ।বড়ো আদরের ওদের।মাহমুদের বয়স চার, আহমদের সাড়ে চার, দুজনই এখন মামনিদের হোমস্কুলিং এর আওতায় আছে সার্বক্ষণিক। আবদুল আলিম সাহেব এসে বসতেই সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন মিষ্টি হেসে,এরপর রমজানের প্রাক-প্রস্তুতি নিয়ে কথা বললেন।অফিসে থেকে দু'ভাই ভলান্টিয়ার হয়ে নানা উদ্যোগের কথাও জানালেন ওদের,দু'বোনেরই ভীষণ ভালো লাগে তাদের বাবা-চাচু'র সহযোগিতার মানসিকতা, বিপদে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এগিয়ে আসার দৃঢ় মনোবল। তারপর,আবদুল আলিম সাহেব মাইশা ও নোশিনকে বললেন,রমজানে তাদের কি পরিকল্পনা সেটা গুছিয়ে নোট করে দেখাতে।উনি কাজে সবসময় মাসের সব কাজের আউটলাইন তৈরি করে রাখেন,ইউনি' লাইফ থেকেই এমন নীতি তাঁর।

সন্ধ্যা বেলা দু'বোন ডায়েরী, পেনসিল নিয়ে বসে রামাদান টু-ডু-লিষ্ট তৈরি করতে।নোশিন গতবছর সবগুলো রোজা রাখতে পারেনি,এবার সে মাইশা আপুর মতো সুন্দর করে রোজা রাখতে চায়।মাইশা বেশ বুদ্ধিমতি,হাসিখুশি মিষ্টি মেয়ে।নোশিনকে নিজের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে,নিজের অন্তরের একজন ভাবে।ছোট্ট বেলা থেকেই সুন্দর করে তুলতে চায়।মাইশা জানতে চাইলো নোশিনের কাছে, গতবছরের রামাদানের নোটবুকটা কই তার?নোশিন কোল থেকে নীল নোটবুকটা আপুকে দেখায়।মাইশাই গতবছর তাকে নোটবুকটা উপহার দিয়েছিলো,নোটবুক অর্গানাইজ করা,টুকলিস্ট করা,প্ল্যানিং করা এসব শিখিয়েছিলো।মাইশা গত চারবছর ধরে রমজানের নোটবুক মেইনটেন করে আসছে। সুন্দর যতো চিন্তা এসেছে, লিখে রেখেছে কিংবা সুন্দর বইয়ের কোন কোটেশন এমন অনেককিছুই।নোশিনের নোট দেখতে দেখতে মাইশা দেখলো অনেক প্ল্যানিং অধরা রয়ে গেছে।যেমন -সিরাতসমগ্র পড়ার কথা ছিলো,কিন্তু একটা খন্ডও শেষ হয়নি,পড়াশোনার ঘরেও ফাঁকি, সূরা মুখস্ত করবার বেলায় পুরো লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।নোশিনকে বলতেই সে বললো,এতো প্ল্যানিং এর ভীড়ে তার সবকিছু গুবলেট হয়ে গিয়েছিলো, কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলে।মাইশা হাসিমুখে বলে,এবার আবার নোটবুকটা দেখো....নোশিন পাতা মেলে দেখে অবাক হয়,খুউব ছোট্ট ছোট্ট প্ল্যানিং তবে নিয়মিত করার ফলে মাস শেষে বিশাল কিছুতে পরিণত হয়েছে।এবার মাইশা নোশিনকে আরেকটু কাছে টেনে আদর করে বলে,প্রতিবছর আমরা কতোশতো পরিকল্পনা করি,কিন্তু সবকিছু সামলে উঠতে পারি না, তাই না!কিন্তু,কেন এমন হয় জানো!আমিও প্রথম প্রথম এমন সমস্যায় পড়তাম,অনেককিছু করবার চিন্তা করতাম,এলোমেলো করে অনেক কিছু করে শেষ পর্যন্ত পুরো করা হয়নি।নোশিন উৎসুক হয়ে জানতে চায়,আপুমনি আমাদের তবে কি করা উচিত?নোশিন বলে,আমাদের ছোট এ জীবনে অনেক কাজই আছে,যেমন লাইব্রেরি ভর্তি বই কিন্তু সববই আমরা শেষ করতে পারি না,তেমনি অনেক কাজ করার থাকা সত্ত্বেও সবকিছু কখনোই আমরা করে উঠতে পারি না।এজন্য সবসময় আমাদের প্রধান একটা লক্ষ্যকে নিয়ে আগানো উচিত।সেই কাজের পিছনে সর্বোচ্চ ফোকাস থাকা উচিত।এমনি করে রমজানে আমাদের কতো কি প্ল্যানিং ইফতার পার্টি,সাদাকা করা, দুআ মাহফিল করাই কি লক্ষ্য আসল লক্ষ্য আমাদের?আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়াই লক্ষ্য।নোশিন জিজ্ঞেস করে, কি করে আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়,আপু?মাইশা তখন ডায়েরীর পাতা খুলে একটা হাদীস পড়ে শুনায় নোশিনকে,জানো আমাদের উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ) বলেছেন,           নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার তাঁর নিকট আসেন, তাঁর নিকট তখন এক মহিলা ছিলেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘ইনি কে?’ ‘আয়িশা (রাঃ) উত্তর দিলেন, অমুক মহিলা, এ বলে তিনি তাঁর সলাতের উল্লেখ করলেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘থাম, তোমরা যতটুকু সামর্থ্য রাখ, ততটুকুই তোমাদের করা উচিত। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ তা‘আলা ততক্ষণ পর্যন্ত (সওয়াব দিতে) বিরত হন না, যতক্ষন না তোমরা নিজেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়। আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল সেটাই, যা আমলকারী নিয়মিত করে থাকে।...এ হাদিস থেকে আমরা কি বুঝতে পারি,ছোট ছোট কাজ যদি নিয়মিত করা হয়, সেটার বরকতও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বহুগুনে বাড়িয়ে দিতে পারেন।এ হাদিস'টির কথা চিন্তা করে,আমি ছোট্ট ছোট্র প্ল্যান হাতে নেই,অল্প সেগমেন্ট এ করে ফেলি।যেমন ধরো,গতবছর অর্থসহ বুঝে অর্ধেক কুরআন শেষ করেছিলাম,কিছু সূরা মুখস্ত করেছি,আর রাসূল সা.এর জীবনী শেষ করেছিলাম,আলহামদুলিল্লাহ। তার পাশাপাশি, ক্লাসের পড়াশোনা, বাসার কাজে সহযোগিতা করেছি।এভাবে সাধ্যের মতো যদি সুন্দর করে আগানো যায় তাহলে অবশ্যই আমরা অসাধারন কিছু করতে পারবো,ইনশাআল্লাহ। মাইশা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বড়বোনের কথা শুনছিলো, এবার সেও রামাদানে সুন্দর করে পালন করবে বলে নিয়্যাত করে।নীল নেটবুকে লিখতে শুরু করে তার আল্লাহর প্রিয় হয়ে ওঠার পরিকল্পনার খসড়াগুলো.....।


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)