ধর্ম ও গবেষনা

নীল আকাশের স্বপ্ন- কূপমন্ডুকের চোখে!

নীল আকাশের স্বপ্ন- কূপমন্ডুকের চোখে!
-আসবো? টেবিলের স্তূপ হয়ে থাকা কাগজের মধ্য থেকে মুখ তুলে সাজ্জাদ অতিথিকে দেখলো। চোখ নামিয়ে রিসিপশনিস্টের কথা মনে করে অসহায় বোধ করলো। ছেলেটা প্রতিটা ইন্সট্রাকশন দুইবার না পেলে কাজ করতে পারে না। -জি, আসুন। -তোমার রিসিপশনিস্টের দোষ নেই, তাকে বকতে হবে না। আমিই জোর করে ঢুকে গেছি। আর ওকে বলেছি তোমাকে না জানাতে। আমি জানি এই সময়ে তুমি নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকো, ভিজিটর থাকে না। মেয়েটার সম্বোধনে তড়িতাহত সাজ্জাদ সব ভুলে চোখ তাক করলো, একরাশ স্মৃতি স্রোতের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো মনের পর্দায়।  -তুমি তমা? - এতোক্ষণে? অবশ্য তুমি তো আবার মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাও না। আমি খুব বদলে গেছি? -ইয়ে... নাহ! মানে খুব না। চেনা যায়। -আমার সৌভাগ্য! সাজ্জাদ ঠিক করলো, তমাকে সে বলবে না যে শুধু কন্ঠেই ওকে চিনেছে সে, কারণ তমা আগে মার্জিত কাপড় পরলেও মাথায় কাপড় দিতো না। আর এই এক টুকরা কাপড় যে মেয়েদের কিভাবে এতো বদলে দেয় কে জানে! -কি খবর তোমার বল, আছো কেমন? বিয়েশাদী? -এহ! চান্স পেয়ে সব জিগেস করছো। কোনদিন একবার খবর নিয়েছো? কাজ নিয়ে এতো ব্যস্ত, ফেসবুকেও তো যাও না!  -তা ঠিক। -সেই স্বীকার করে নেয়ার স্বভাব! আমার একটা বাচ্চা আছে সাজ্জাদ, আর ওর বাবা কলেজে পড়ান, আমি একটা এনজিওতে কাজ করি। এখন জিগেস কর, তোমাকে খুঁজে পেলাম কিভাবে? - কিভাবে? আগ্রহী হয়ে উঠলো সাজ্জাদ। একটা চাপা অপরাধবোধ সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকাতে বাঁধা দিচ্ছিলো এতোক্ষণ। কৌতুহল সেটাকে ঢেকে দিলো।  -আমার এক্স কলিগ একজন তোমার এখানে কাজ করে, ওর সাথে খেতে এসেছিলাম একদিন মৌরিতে। তোমার কথা ওর কাছেই শুনলাম। আর কোন ক্লাসমেট হলে হয়ত এতোটা ডিটেল জানতে চাইতাম না। তোমার ব্যপারে এত কিছু জানতে চেয়েছি দেখে বেচারী আমাকে পাগলই ভেবে বসেছে। -কি খাবে? কফি? -তুমি সঅব ভুলে গেছো, আমি চা খাই। এখনও। উঠে গিয়ে অর্ডার দিয়ে এসে আবার চেয়ারে বসে দেখলো, তমা ওর টেবিলের ডেস্ক ক্যলেন্ডার উলটে দেখছে, মুখে একটু বাঁকা হাসি।  - কি দেখো? -তোমার এখনও যোগাযোগ আছে এদের সাথে, দেখছি। -হুম, আছে। -এতো জোরে মাথা ঝাঁকিও না, আজকে তোমার সাথে একটা বোঝাপড়া শেষ করতে এসেছি। অফিস ছুটি নিয়ে ছেলেকে ওর নানুর বাসায় দিয়ে তারপর। -বাহ! নিজে এতো প্রস্তুতি নিলে, আমি একটু জানলে কি হত? -জানলে তুমি অফিস ছেড়ে পালিয়ে যেতে। চিনি না তোমাকে? মাথা নিচু করে ফেললো সাজ্জাদ। মেয়েরা কি এইরকমই, নাকি শুধুই তমাই এমন? -আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে? প্লীজ? -কি? -তুমি আমাকে কেন ‘না’ বলেছিলে? সত্যিই কি তোমার আদর্শের জন্য? নাকি আমাকে অপছন্দ ছিলো কোন কারণে? -খুব জানা দরকার? -দেখো, আমি কালো মেয়ে সে আমি জানি। না না নিষেধ কোর না, আমি শেষ করি। আমার বাবা মা কিংবা ভাইবোনের মধ্যে এ নিয়ে কোনদিন কোন অসুবিধায় পড়িনি, এজন্য আমি এই বিচারের মুখোমুখি কখনও হইনি। তোমার কাছ থেকে ‘না’ শোনার পর আমার প্রথমে এইটাই মনে হয়েছিলো, হয়ত তুমি কোন সফেদ সুন্দরীর আশায় আছো। আসলেই কি?  -নাহ! -তাহলে? -তুমি এইগুলা বলতে এসেছো, তমা? -না, কথা আরও আছে। এইটা এপেটাইজার! -কি বলবো? আমার মাথায় কারও গায়ের রঙ বিষয়টা অনেক পরে আসে। পরিচিত কারুর কথা জিগেস কর, তার গায়ের রঙ কিরকম এইটা আমি চট করে বলতে পারবো না। -তাহলে ওই আদর্শ? আসলেই? কি বলবে সাজ্জাদ? মাস্টার্সের শেষ দিনগুলোতে এতো মানুষের মধ্য থেকে কেন তমা ওকেই একদিন ধরে বসেছিলো কে জানে? স্পষ্টবাদী মেয়েটাকে দূর থেকেই চিনতো ও। হঠাত ওকে ক্যফেতে ডেকেছিলো তমা। কাক ডাকা মন্থর একটা দুপুরে। ভণিতা ছাড়াই বলেছিলো, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে। তুমি কি একটু ভেবে দেখবে? আমার বাসায় বিয়ের কথা হচ্ছে। তুমি চাইলে আমি জানাতে পারি।’ সাজ্জাদ চিরাচরিত অভ্যাসের জন্য জবাব না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়েই বসেছিলো। ‘তুমি ভেবে দেখো, আর কালকে এই সময়ে এখানেই একটু এসো?’ সাজ্জাদ আর যায়নি, রুমমেটকে দিয়ে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলো। -জানো তোমার সেই চিরকুট আমি এতোবার পড়েছি যে মুখস্থ হয়ে গেছিলো। ‘তুমি আমাকে কি ভাবো আমি জানিনা, আমি খুব সাধারণ। কিন্তু আমার জীবনের একটা অসাধারণ লক্ষ্য আছে। আমি একটা আদর্শের পতাকাবাহী, এই আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করাই আমার জীবনের লক্ষ্য। কোন মেয়ের সাথে নিজেকে জড়ানোর মত সময় এখনও হয়নি আমার। হলেও আমার আদর্শবাহী আর সাধারণ কাউকেই খুঁজে নেবো আমি। তুমি ভালো থাকো।’ কি অদ্ভুত একটা চিঠি, না? জবাব দিলো না সাজ্জাদ। ওর কাছে জবাব নেই। চা এসেছে। চায়ের কাপটা ঢেকে নাশতা এগিয়ে দিলো তমার দিকে। -জানো, আমি একটু আহত হয়েছিলাম, কিন্তু একটা অদ্ভুত আত্নঅহংকারে সেটা চাপা পড়ে যায়। আমি শিওর হয়েছিলাম, তুমি আসলেই অনেক ভালো, একদিনও তোমার সাথে না মিশে আমি সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। চা খাও, ঠান্ডা হলে আবার খেতে পারবে না। -কিভাবে জানো? -মাত্র তো আট বছর, না? সেদিন ক্যফের চা খেতে পারোনি তুমি, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো দেখে। -বাব্বাহ! অনেক মনে রাখতে পারো। -ঠিক উল্টোটা! আসলে সেদিনের কথা মনে রাখতে চেয়েছিলাম, এজন্য মনে আছে। আয়েশার কাছ থেকে তোমার কথা জানতে পেরে শুধু এই চিরকুটের কথাগুলো বাজিয়ে দেখার জন্য ওকে প্রশ্ন করছিলাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তুমি তোমার প্রতিটা কথাই রেখেছো। অন্তত তুমি যদ্দুর বুঝেছো আর কি! -মানে? -ভাগ্য কি অদ্ভুত দেখো। এমন একজনের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, যে আরেক পাগল। অসম্ভব পড়ার নেশা মুকুলের। আমিও পড়ি। কিন্তু এরকম গোগ্রাসে না। সেই লোক পড়তে পড়তে একদিন কোত্থেকে কিই এক বই পেয়েছে, কুরআন পড়তে অস্থির হয়ে গেলো। আমি বাঁধা দিই নাই, শুধু একটা সুন্দর র‍্যকস্যাক কিনে দিয়েছি। পিঠে বই ঝুলিয়ে কলেজে যায় আর আসে, রাস্তায়ও পড়ে। প্রতিদিন ভালো লাগা জায়গাগুলো শুনিয়ে আমাকেও কিভাবে মোহগ্রস্ত করে ফেললো জানিনা। এটা একটা অদ্ভুত আনন্দ, না? আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে আবিষ্কার করছিলাম, আমরা কত ভাগ্যবান। ইসলামকে পাড়ার হুজুরদের কাছে না জেনে কুরআন থেকে জানা যে কি তৃপ্তির! নেশার মত কুরআন পড়তাম। আস্তে আস্তে মুকুলের আরও একটা বৈশিষ্ট্য জানলাম, ও নিজেকে বদলাতে পারে। আমাকে কিচ্ছু বলতো না। ক্লীনশেভড ছেলেটা চাপদাড়ি রেখে দিলো, সব প্যন্ট নিচে দিয়ে কাটিয়ে আনলো। আমি বরাবরই একটু রয়ে সয়ে এগোই। দেখো না, চারবছরে শুধু স্কার্ফ পরেছি, তা-ও অনেক পড়ার পর। কুরআন পড়তে পড়তে আমার শুধু তোমার কথা মনে হত। কেন জানিনা, মনে মনে তোমাকে একজন আইডিয়াল হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজেকে তুলনা করে দেখতাম। আহা, তুমি মাথা নিচু করে ফেলছো কেন? তাতে তোমার দোষ নাই তো! আমারই কল্পনার কারসাজি। যা হোক, কিন্তু সেদিন আয়েশা মানে তোমাদের সেলসের এক্সিকিউটিভ, ও আমাকে এমন কিছু কথা বললো আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। ও বারবার বলছিলো, আমি এতো জানতে চাইছি কেন? আচ্ছা, তুমি কি আবার ওকে সাইজ করে দিবে নাকি? -না না। মেয়েটার ডাক নাম আয়েশা তা-ই তো জানি না। -আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই বলবে। জানো , ও আগের চাকরীটা ছেড়েছে শুধু একটা ভালো অফিস এনভায়রনমেন্টের আশায়। আচ্ছা বল দেখি, যে আদর্শের কথা তুমি বলতে সেটা কি কাজীর গরু শুধু? -তুমি এতো এরোগেন্ট হয়ে গেছো, আমি না কিছুই বুঝলাম না! -সরি। আমার বিরক্তিটা একটু বেশীই অবশ্য। নতুন মুসল্লী তো! তমার হাসিতে কী যেন ছিলো, সাজ্জাদ হাসতে গিয়েও আটকে গেলো। -আমাদের একটা কমন আত্নম্ভরীতা আছে। আমরা যারা কুরআন পড়ি তাদের কথা বলছি। আমরা জেনেছি, ইসলাম সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। ব্যাস, এইই জেনে আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকি। কোথাও কোন অসঙ্গতি দেখলে নিজের কাছে কৈফিয়ত দিই, যেহেতু ইসলাম প্রতিষ্ঠিত নাই সমাজে, এজন্যই এমন হচ্ছে। থাকলে হত না। সুতরাং এই দুরবস্থার দায়ভার আমার না। এই মনে করে নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁটা দিই। না? -এরকম চিন্তা অনেকসময় করি, কিন্তু সেটাতে সমস্যা কি? -সব সমস্যাই কি সমাধানের অযোগ্য? আমরা কি আমাদের হাতের সীমায় থাকা ছোট ছোট সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারি না? -যেমন? -তুমিই বল, তোমার অফিসে কয়টা মেয়ে? -চারজন। -তাদের আলাদা বসার জায়গা আর ওয়াশরুম আছে? -ব্যবস্থা হবে, এইটা আমরা চিন্তা করছি... -আট মাসেও সবচে পরে জয়েন করা মেয়েটা যখন এই সুবিধা পায়নি, আর চিন্তা করে কি করবে? একটা পারসোনাল কথা জিগেস করি, কিচ্ছু মনে কোর না? -না না, বল। -তোমার স্ত্রী কি করেন? -ও তো একটা স্কুলে পড়াতো, এখন আসলে কিছু করে না... -কেন? বাচ্চা আছে? -না ... -বাসায় কাউকে দেখাশোনা করতে হয়? -না, কেন? -চাকরী ছেড়ে দিলেন কেন? তোমার অমতের জন্য? -সেইটাও না, আসলে আমার অনেক সাপোর্ট লাগে, এতো ব্যস্ত থাকি। ও অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে এখন। -বাহ! বাহ!! মাথা নাড়ছিলো তমা, পেন্ডুলামের মত এদিক ওদিক। আর সবার কাছে লুকিয়ে রাখা একটা সংকীর্ণতা ক্লাসমেটের সামনে কেন যেন নিজের অজান্তেই প্রকাশ করে দিলো সাজ্জাদ। -আমারই আসলে এলার্জী আছে, আমি মেয়েদের কাজ করা পছন্দ করি না। -আমি তোমাকে যতদূর জানি, এটাই যে কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তুমি স্বীকার করে ফেলবে ভাবিনি। যে সমাজের স্বপ্ন তুমি দেখেছো সাজ্জাদ, তাকে প্রতিষ্ঠার সাহস তোমার ছিলো মানলাম। কিন্তু সে যোগ্যতা তোমার নাই বা তুমি নিজের মধ্যে তৈরী করোনি। তোমার স্বপ্ন আজকের, কিন্তু তুমি আটকে আছো একশ বছর আগের জ্ঞানে। তোমার স্বপ্নে দেখা রাজ্য আছে, তাতে রাজকন্যারা নাই, না? সাত সমুদ্র পাড়ি দেয়ার ভয়ে সে রাজকন্যাদের তুমি আটকে রেখেছো ... -দেখো তমা... -ব্যস। কৈফিয়ত আমার দুচোখের বিষ! আমাকে কোন কৈফিয়ত দিও না। -উঠছো কেন? বসো না। আর চা-ও নাওনি। -আহা, তাইতো! বসে চাটা একটানে চুমক দিয়ে আবার উঠলো তমা। -তোমাকে দুইটা কথা বলে যাই, যা-ই ভাবো তুমি। তোমার মেয়ে বা মেয়েস্থানীয় কাউকে যদি তুমি আর কিছু না হোক, একজন সোশ্যাল ওয়ার্কারই বানাতে চাও, তার সামনে আদর্শ হিসেবে কাকে দেখাবে তুমি? কোন অধিকারে দেখাবে? আর একটা কথা হল, আমি অনেকদিন পর রিলিভড ফীল করছি... কেন যেন! ভালো থাকো। ঝড়ের মত তমা চলে গেলেও সাজ্জাদ থামাতে চাইলো না। শূণ্য দৃষ্টি জোর করে ফেরত এনে ফাইলে চোখ রাখলো। অনেক কাজ, বাসায় যেতে কখন হবে কে জানে?

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)