পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )
আমাদের ঈদগুলো

ঈদের গল্পগুলো প্রতিবছর একই। তবু আলাদা। ছোটবেলায় ঈদের দিনের অপেক্ষা ছিলো অসহ্য আনন্দের, এখন সে অপেক্ষার উত্তেজনাটুকু অন্য জায়গায়। সবার জন্য কেনা পিচ্চি পিচ্চি উপহারগুলো দিতে ভালো লাগে, ঈদের দিন কাউকে কল দিয়ে কথা বলি সেটা ভালো লাগে, কি রান্না করবো সেটার প্ল্যান করতে ভালো লাগে, বাচ্চারা চেয়ে খায় তাও ভালো লাগে, আর রাতে সব শেষ প্লেটটা ধুয়ে চা নিয়ে বসে সারাটা দিন ভাবতে সবচে ভালো লাগে।
কি ভাবতে ভালো লাগেনা? এই তো, সকালে আম্মু কি করছেন ভাবতে ভালো লাগেনা। দুপুরের পর, রুটিন মেহমানেরা এসে চলে যাবার পর, আব্বু আম্মু কি করছেন এইটা ভাবতে ভালো লাগে না। কারণ, জানিই, দুইজন পাশাপাশি লম্বা হয়ে শুয়ে কি কি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছেন হয়ত, শুনশান ঘর। ছোট ভাইটা অন্য ঘরে, একা কিছু ভাবছে হয়ত, মূর্তির মতো বসে।
সারাবছর মাত্র ৪০ ফুট উপরের বাসায় থাকি, আমি ঈদে আব্বু আম্মুর থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে চলে আসি। আর একজন মায়ের কাছে। স্থির, নিষ্কম্প চোখে আমার আসার অপেক্ষায় থাকেন যিনি। ছেলেকে দেখেন, ছেলের সন্তানদের মধ্যে ছেলেকে খুঁজেন। বাচ্চারা খেলছে দেখলে চেয়ার টেনে বসে ওদের দেখেন। সে চোখে আমি দুয়া দেখি, ভালোবাসা দেখি। আমি জানি, এই দুয়া এই বাচ্চাদের ঘিরে আছে, থাকবে সারাক্ষণ।
আচ্ছা, সারাবছর যদি অন্য কোথাও থাকতাম? যেখানে বাচ্চাদের দাদু নানুরা কেউই নাই? তখন ভাগাভাগি করে থাকতাম হয়ত ঈদে। কোন ঈদ নানুবাড়ি, কোন ঈদ দাদুবাড়িতে করতো বাচ্চারা। উদ্দেশ্য একটাই। বন্ধন দৃঢ় করা। দুয়া নেওয়া। তিন দশক বয়স পেরিয়ে আমি আজও আমার মাথার ওপরে আমার নাম ধরে করে যাওয়া দুয়া টের পাই, মুরুব্বীরা করে গেছেন। আমার বাচ্চাদের সে ঝুলি ভরে নিতে হবে তো।
এখানে একটা মোটাদাগের পার্থক্য আছে। অধিকাংশ সময় গ্রাম এলাকায় মেয়েদের বিয়ে এত অল্প বয়সে হয়, শশুরবাড়িতে এসেই সমস্ত স্মৃতি তৈরী হয়। বরংচ নিজের বাবামায়ের সাথেই সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় নিয়মরক্ষার। এমনকি অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী মারা গেছেন। ভিটা নামক স্মৃতির দোহাই দিয়ে শশুরঘর ত্যাগও করেন নি। কিন্তু শহর বা মফস্বলে বড় হওয়া শিক্ষিত মেয়েরা পরিবারের সাথে মানসিকভাবে অনেক বেশি সম্পৃক্ত থাকে। শিক্ষা আত্মসচেতনতা শেখায় মানুষকে। এজন্য বিয়ে বা বাচ্চা হবার পরও সে সম্পৃক্ততা কমতি হতে দিতে এরা নারাজ থাকে। সুতরাং দুই ধরণের মেয়েদের জন্য ‘ঈদ কোথায় করা হবে’ প্রশ্নের উত্তর, উত্তরের যৌক্তিকতা আলাদা হবে। এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে সমাজ? এ এক অদ্ভুত মানদন্ড। ভাবতে গেলে অবাক হই। যে বাড়ীতে এক বউ অনুমতি না নিয়ে পাশের ঘরেও যায়নি কখনও, প্রতিবেলার খাবার চুলায় গরম হতে হবে, এমন কড়া নিয়ম। সে বাড়ির মেজো বউ চাকুরি করে আর সপ্তাহে একদিন রান্না করে। এবং সবাই দুজনের ওপর একই রকম সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট। এরই নাম সমাজ। যে এলাকায় বোরখা পরা আপাদমস্তক ঢাকা মেয়ে আছে, সে এলাকায় আস্তে আস্তে একেবারে অন্য সাজের পোশাক পরা মেয়ে মহিলারা আসে, চলাফেরা করে, সমাজ তাকিয়ে থেকে অন্য কাজে মন দেয়। যে এলাকায় পুরুষের পেছনে বাইকে মহিলারা বসলেই লোকে চোখ ছানাবড়া করে তাকায়, কালের পরিক্রমায় সে এলাকায় মেয়েরা স্কুটি চালায়, এমনকি বাইকও। লোকের চোখে আস্তে আস্তে সয়ে যায়। কেন বলছি এসব? বলছি এজন্য যে, সমাজ আসলে কোন মানদন্ড নয়। কে কি বলছে, বলবে, এসবই হয়ে এসেছে এতোদিন, এ দিয়ে কখনও কোন মানুষের কার্যক্রম, পরিকল্পনা নির্ধারিত হওয়া উচিৎ নয়। কোন মুসলমানের তো নয়ই। কারণ মুসলমানের সকল কাজের কেন্দবিন্দুতে আছেন, থাকেন, আল্লাহ। তাঁর সন্তুষ্টি। সুতরাং যে কাজে ইসলাম কোন বিধিনিষেধ আরোপ করেনি, তাতে স্বেচ্ছায় নিজেরা বা সমাজকে দিয়ে নিয়ম বানিয়ে নিলে একসময় নিজের নিয়মের ফাঁদে নিজেরই পড়তে হয়।
আগের কথায় ফেরত যাই। মেয়েরা ঈদে বাবার বাড়ি যাবেন না শশুর বাড়ি যাবেন, এ ব্যপারটা আজকাল বেশ স্পর্শকাতর ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখে পানি আসে এমন টেলিভিশন কমার্শিয়াল বানানো হচ্ছে,সামাজিক গণমাধ্যমে অনেকে বেশ সোচ্চার এ নিয়ে। কারো বাবামা একা আছেন, মেয়ে হয়ত ঈদে চাঁদে দেখতে আসতে পারেন না। আবার কারো বাবা মা ছেলেকেও দেখতে পারছেন না বছরে একবারও, ছেলে পরিবার নিয়ে প্রবাসী। এক্ষেত্রে যদি মেয়ে হয়, তাহলেও কিন্তু একই কথা। ‘শশুরবাড়িতে ঈদ করছে বলে আসতে পারছে না’ এই আফসোস কারোরই আসে না। আবার অনেক সময়, অনেক ছেলের বাবামায়েরও একা ঈদ করতে হয়, ছেলে একই দেশে থেকেও। ছুটিছাটার ঝামেলা হলে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে পরিবারগুলোরই ভাবা উচিৎ কে কাকে ইহসান করবে, আর কে কার জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে। লোকলজ্জা নয়, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি অহেতুক মাথা নুইয়ে নয়, বরং নিজেরা নিজেদের সম্পর্কগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, এবং কর্তব্যের কথা মাথায় রাখা উচিৎ। একটা ছেলের জন্য বাবামা যেমন কর্তব্য এবং রহমত পাওয়ার দরজা, ঠিক একটা মেয়ের জন্যও তাই। এবং অবশ্যই বিয়ের পর এ কর্তব্য শিথিল হয়ে যায়না।
তাহলে, একটা নতুন তৈরী হওয়া পরিবারে স্বামী স্ত্রী নিজেরা ঠান্ডা মাথায় বসেই হিসেব কষা উচিৎ, কে কার বাবামা’কে কবে কখন কিভাবে সেবা করবেন। বাচ্চাদেরকে কি করে নিজেদের পূর্বপুরুষদের চেনাবেন, তাঁদের প্রতি কি কি দায়িত্ব আছে তা জানাবেন। এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে হলে তাই দেখানোর সাহস কি করে ধারণ করবেন নিজেদের মধ্যে। মনে রাখবেন, আপনার প্রতি আপনার সন্তানের আচরণ নির্ধারিত হবে এইসব অভিজ্ঞতা থেকেই। বাচ্চারা কান দিয়ে নয়, বরং চোখ দিয়েই শোনে আর দেখে। যে স্বামী সারাজীবন স্ত্রীকে তার বাবার বাড়ি থেকে দূরে রেখেছেন, তিনি বাবা হিসেবে নিজের মেয়ের কাছে সেটুকুর বেশি চাইতে পারবেন না। সমাজ কিন্তু সে বেলায় চুপ। আবার নিজের জেদ রাখতে গিয়ে শশুরবাড়ি যান নি যে বউ, তিনিও পুত্রবধুর কাছে ওইটুকুর আবদার করতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় ব্যপার হল, আল্লাহ যেহেতু জানেনই আমাদের কার মনে কোন ইচ্ছা চেপে আমরা মুখে হাসি, কোন জেদ বা দুষ্টুমি লুকিয়ে রেখে কাউকে কষ্ট দিই, আল্লাহই সেসবের জবাব খুব সুন্দর করে আমাদেরই সামনে সাজিয়ে দেন।
আমাদের সকল কাজের উদ্দেশ্য হোক আল্লাহকে খুশি করা। কেবল তাঁর দেয়া সীমানাতেই দুনিয়ার জান্নাত বানিয়ে নিই। সংযমের রোজা আর কুরবানীর খুশী থেকে শেখা শিক্ষাগুলো কাজে লাগাই প্রতিদিনের জীবনে।
ঈদ মুবারাক।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)