বিবিধ

মেঘের দেশে রোদের বাড়ি পাহাড় কিনারায়…

মেঘের দেশে রোদের বাড়ি পাহাড় কিনারায়…
মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেলো সেমিস্টার ফাইনালের ঝড়। এখন বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক, নইলে যে কোন মুহুর্তে শক্ত ব্যামো হতেই পারে। মানুষটা আমি ভ্রমণপিপাসু বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভ্রমণের খেরোখাতাটা সীমিতই বলা চলে। বিবাহ পূর্ববতী জীবনে একটা বড় সময় বন্ধুরা মিলে শুধু ট্যুর পরিকল্পনাই এঁটেছি, বিভিন্ন কারণে তা খুব বেশী বাস্তবায়ন হয়ে উঠেনি। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই ভুল আর করা যাবেনা, ভেবেছি একটু সময় পেলেই ব্যাকপ্যাক নিয়ে দেবো দৌড়। তাছাড়া সাদিক সাহেবও ঘুরাঘুরির ইচ্ছেগুলোকে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে, তার জীবনের অসংখ্য গোলের অন্যতম একটি হলো-মুসাফিরের মতো পৃথিবীর আদ্যোপান্ত ঘুরে ঘুরে দেখা। সুতরাং চললো দুই মুসাফির, সমুদ্র সৈকতে অথবা পাহাড়ের দেশে… কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের গপ্পোটা আপাতত তোলা থাক, লেখার কলেবর বৃদ্ধি করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি করতে চাইনা! আজ তবে বলি পাহাড়ীকন্যার রূপের কথা! কক্সবাজারে হোটেল শাহজাদীতে উঠেছিলাম আমরা। তার সাথেই লাগোয়া মার্কেটের একটা এজেন্সিতে বান্দরবান ভ্রমণের দুটো টিকেট বুকিং করে রেখেছিলাম আমরা। ট্যুর গাইড একদিনে পাঁচটা জায়গা দেখাবেন। শুক্রবার সকাল ছটায় আমাদের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা, আমরা দুজনেই মোটামুটি সময় সচেতন মানুষ, ঠিক ছটায় ডলফিন মোড়ে গাড়ির অপেক্ষায় রইলাম আমরা। কিন্তু বাংলাদেশ বলে কথা, প্রহর গণনাই যে সৌন্দর্য এখানে! এর ফাঁকে টংয়ের দোকানে চা আর আটার তৈরি একটা পিঠা খেয়ে নিলাম। অবশেষে প্রায় সাতটায় রওয়ানা হলাম, ছোট্ট একটা ছিমছাম বাস, সাথে আরো গুটিকয়েক ফ্যামিলি। পথিমধ্যে বেশিরভাগ সময় ঝিমুনী, ঘুম, নাশতা অথবা ঠুনকো আলাপচারিতায় কেটে গেলো সময়... ঢুকে গেলাম সৌন্দর্যের রাণীর বাড়িতে... প্রথম গন্তব্য মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র। শহরের প্রবেশদ্বারেই এর অবস্থান, জনপ্রতি ৫০ টাকা মূল্যের টিকেট কেটে ভেতরে যেতে হয়। গাইড সময় বেঁধে দিলো ত্রিশ মিনিট। তিনটা দুজনের ফ্যামিলি আরেক বাবুর আব্বুম্মু ফ্যামিলি মিলে প্রায় একই পথে হাঁটছিলাম গ্রুপিং করে। খানিক পরে যে যার মতো ঘুরলাম। নৌকা ভ্রমণ, চিড়িয়াখানা, আঁকাবাঁকা সিড়ি আর ঝুলন্ত সেতুর সমন্বয়ে বেশ সুন্দর জায়গা টা। ঝুলন্ত সেতুতে উঠে সাহেবের সাথে একটু অভিমানের ইচ্ছে জাগলো, ওমা! সে কি! এক্কেবারে কাঁদো কাঁদো চেহারায় বেচারীর মুড খারাপ মতো অবস্থা হয়ে গেলো যে! হাসি চেপে মান ভাঙাতে হলো। দ্বিগুণ উৎসাহে সিড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘুরে দেখলাম আদিবাসীদের জনপদ। প্রখর রোদে ডাব আর ওয়েফার খেয়ে বের হলাম মেঘলা থেকে। দ্বিতীয় গন্তব্য বৌদ্ধদের ধাতু জাদি বা স্বর্ণমন্দির। ত্রিশ টাকা মূল্যমানের টিকেট কেটে বিশাল সিড়ি ভেঙে পাহাড়চূড়ার উপরে উঠে মন্দিরে যেতে হয়। এখানে কিছু নিয়ম কানুন আছে। জুতো জমা রেখে খালি পায়ে উঠতে হয়। প্রতি জোড়া জুতো জমা রাখানোতে পাঁচ টাকা দিতে হয়। এছাড়া মন্দিরে ভিডিও ধারণ, ধূমপান নিষেধ। থাইল্যান্ডের মন্দিরসমূহের আদলে তৈরি মন্দির টি বেশ দৃষ্টিনন্দনীয়। তীব্র রোদে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না এখান টায়। রওয়ানা হলাম নীলগিরির পথে… খোলা জীপ বা চান্দের গাড়ি চেপে পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে শুরু করলাম। দুটো ঠান্ডা প্যাকেটজাত দুধের প্যাকেট আর স্ট্র নিয়ে নিলাম সাথে। খানিক অবসাদ চেপেছিলো, মেঘ আর পাহাড়ের মিতালী দেখে ক্লান্তি কোথায় ছুটে পালালো! চান্দের গাড়ির প্রথম সারিতে বসা বাবুর আম্মু বাবুকে বাবার কোলে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো অসীম আনন্দে। এবার আমি খানিক বাদে সাদিক একে একে অধিকাংশই দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম স্রষ্টার অপার নিদর্শন। সমতল থেকে প্রায় ২২০০ ফুট উঁচুতে চলছি আমরা। সাদিক সাহেব পাহাড় সংক্রান্ত আয়াত গুলো মনে করার চেষ্টা করলেন-
আর আমি জমিনের উপর সুদৃঢ় পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে তাদের নিয়ে জমিন ঝুঁকে না পড়ে ; এবং আমি সেখানে প্রশস্ত প্রশস্ত রাস্তা সৃষ্টি করেছি যেন তারা গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারে। (কোরআন, ২১ : ৩১) আমি কি জমিনকে করিনি বিছানা সদৃশ ? এবং পাহাড়সমূহকে পেরেকস্বরূপ ? (কোরআন ৭৮ : ৬৭) আর তুমি পর্বতসমূহকে দেখে অটল -অচল মনে কর , অথচ এগুলো সেদিন মেঘরাশির ন্যায় চলমান হবে। এ হল আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য , যিনি সবকিছুকে করেছেন সুষম -সুসংহত। তোমরা যা কিছু করছ, তিনি তা সম্যক অবগত আছেন। (কোরআন , ২৭ : ৮৮)
কৃতজ্ঞতায় নুয়ে যেতে ইচ্ছে হলো, সুবহানআল্লাহ! আমার প্রভুর প্রতিটি কথা সত্য! গান উঁকি দিলো মনে-
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে নেয়ামত পাই আমি, বিশ্বাসে তাই আমি না দেখে তোমায় মানি সে মানা সামান্য, কত ত্রুটিপূর্ণ তোমার মিজানে মেপোনা আমায়, প্রভু!
ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম মেঘের দেশে। পাহাড় ঘেঁষা একটা ক্যফেতে মোরগ মোলাও খেলাম। আমার মোবাইলে চার্জ ফুরিয়ে গেলো। দোকানী বললাম, কি করি? তিনি ফ্যান বন্ধ করে গরমে ঘেমে সে প্লাগে চার্জার লাগিয়ে চার্জ করে দিলো। এই ছোট্ট একটা আচরণে বান্দরবানের প্রকৃতির মতো মানুষ গুলোকেও এত যে ভালো লেগে গেলো আমার! অথচ কিছুক্ষণ আগে বাবু দম্পতি ফ্যামিলি টা মাত্র দুশো টাকার জন্য প্রতারণা শুরু করেছিলেন গাইডের সাথে। আহারে একই মেরুতে কত বৈচিত্র্যের মানুষ। কত ছোট্ট ছোট্ট আচরণে মানুষের নৈতিকতা প্রকাশ পেয়ে যায়! এদিকে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে সাদিক সাহেব নামাজের জায়গা খুঁজায় লেগে গেলেন। সেনাবাহিনীর ছোট্ট একটা বারান্দায় নামাজের জায়গা আছে বটে কিন্তু পানির তীব্র সংকট। নামাজ শেষে নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তোলা হলো। বসার জায়গা করা আছে লোহা আর পাথরের বেঞ্চি দিয়ে। বসে বসে তুলোর মতো মেঘগুলোর ভেসে যাওয়া দেখলাম। পাখির পালকের মতো মেঘগুলোকে মুঠোবন্দী করে নিয়ে আসতে পারতাম যদি! মনে হলো নেপালের কোনো জায়গা এটা, অথবা ছবির দেখা দার্জিলিং! আমি পাহাড় মেঘ সংক্রান্ত কবিতা গানে আক্রান্ত হয়েছি চান্দের গাড়িতে উঠেই। সাদিক সাহেব ভালো শ্রোতা, আমি হাবিজাবি বলি। ভালো লাগুক আর নাই লাগুক তিনি শোনেন। আমি বলতেই থাকি...
একটু যদি তাকাও তুমি মেঘগুলো হয় সোনা, আকাশ খুলে বসে আছি তাও কেনো দেখছোনা?
সুনীলকে মনে হলো ভীষণ-
অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ। কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না। যদি তার দেখা পেতাম, দামের জন্য আটকাতো না। আমার নিজস্ব একটা নদী আছে, সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।
আচ্ছা মেঘবালিকা নিয়ে জয় গোস্বামীর একটা কবিতা আছে না? খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার মেঘের মাঠে গিয়েই দেখি, চেনা মুখ তো একটিও নেই এ তল্লাটে একজনকে মনে হল ওরই মধ্যে অন্যরকম এগিয়ে গিয়ে বলি তাকেই তুমি কি সেই মেঘবালিকা, তুমি কি সেই? ধুর! ভ্রমণকাহিনীতে কবিতার আসর বসালাম নাকি আমি? দুটো আইস্ক্রিম নিয়ে আসলেন তিনি। বেশ মজার চকবার আইস্ক্রিম! নীলগিরি থেকে ফিরতে মন চাইছিলো না, তবু ফিরতে হবে। বৃষ্টি নামলো হঠাত, গ্রুপের মেয়েরা অধিকাংশই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, একজনের হ্যাজবেন্ড মেয়েদের নিয়ে জার্নির সমস্যার বয়ান দিচ্ছিলেন আর আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। সাদিক সাহেব ফিসফিস করে বললো- ‘তুমি ছাড়া সবার অবস্থা দেখো একটু!’ আমার এনার্জি মিস করবেন তিনি! ঐ লোকের সাথে বিতর্ক এড়িয়ে হেসে ফেললাম। তাদের অসুস্থতার দরুন চিম্বুকে আর যাওয়া হলোনা! ফেরার পথে শৈলপ্রপাতে আসলাম। স্বচ্ছ ঝরনার পানিতে নামাটা বিপজ্জনক। উপর থেকেই পাহাড়ী কলা খেতে খেতে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ দেখলাম। সেনাবাহিনীর আরেক টি মসজিদে দুজনে নামাজ আদায় করে কমলা কিনলাম। এবার মেঘের দেশ থেকে ফেরার পালা। মন খারাপ হচ্ছিলো কেনো জানি! এক রাশ মুগ্ধতা, কৃতজ্ঞতা আর প্রকৃতির বিশুদ্ধ বাতাস গায়ে মেখে সরু পথে ফিরতি বাসে উঠে পড়লাম। বিদায় বান্দরবান... ভালো থেকো মেঘ, পাহাড় আর সবুজের রাণী!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
লেখকের অন্যান্য ব্লগ সবগুলো দেখুন