ভাইকিং, পাইন ও অন্যান্য
বার্লিন দেয়ালের টপোগ্রাফি দেস টেররের কথাবার্তা রিডিং গ্লাস চোখে দিয়ে বেশ সময় নিয়ে পড়ছিল তামান্না মামী। আশেপাশের মানুষগুলোও ইতিহাস খুঁড়ছে মন দিয়ে। মামী আমাকে নীচু গলায় বলল,
-জার্মানির তো মাশাল্লাহ উথাল পাথাল হিস্ট্রি! সেই তুলনায় সুইডেনের হিস্ট্রি কমই।
আমিও আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম,
-কেমন কম?
-ভাইকিং টাইকিংই একটু হাইলাইটেড আর কি। তবে সুইডেনের একটা ম্যাজিক আছে। কলহপ্রিয় এবং জলদস্যু অ্যানসেস্টরদের দেশ থেকে অল্প সময়ের ভেতর ঠাণ্ডা চুপচাপ একটা দেশ বানিয়ে ফেলেছে সুইডিশরা।
মাথা নাড়লাম। অবশ্যই একদম কিছু না বুঝে মাথা এদিক সেদিক করিনি। কমোডোর (অবঃ) এম আতাউর রহমানের "সুইডেন শান্তির দেশ" বইটা পড়েছিলাম এমন একটা বয়সে যখন (অবঃ) কে আমি অবই পড়তাম। কিছু না বুঝলেও বুঝেছিলাম পাহাড় আর জলাভূমির সুইডেন দেশে খুব শান্তি আছে। আর দুই শিংয়ের হেলমেট মাথার নরস মিথলজির টুকটাক কানে আসতো নানা সময়ে। প্যাগান ভাইকিংদের একসময়ে আহলে কিতাবে বিশ্বাস এনে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় খ্রিষ্টের ধর্মের সম্প্রসারণ বা ওদের মিথলজির টাইর- ওডিন- ফ্রিগ থেকে ইংরেজী সপ্তাহের নামগুলো আসা এইসমস্ত।
একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম, এই নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীটির আদি নিবাস স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো হলেও জীবিকা নির্বাহ- চাষাবাদ ইত্যাদি আরও সহজে করার জন্য এদের পানিপথের সাহায্য নিয়ে ইউরোপের নানান দেশে লুটপাট, আক্রমণ চালাতে হয়েছে। তবে সুখের বিষয়, তাদের ভেতর তুলনামূলক ভাল পরিচ্ছন্নতার চর্চা ছিল। শীতের উসিলায় বাকি ইওরোপিয়ানরা যখন স্রেফ সুগন্ধী গায়ে ডলে মাসের পর মাস ঘুরে বেড়াতো তখন তারা নিয়মিত স্নান করত।
আমি তো দেখা যায় ভাইকিং ভাইকিং করতে গিয়ে ঘটনা আর তার প্রেক্ষাপট থেকে সরে গিয়েছি! ঘটনা হচ্ছে এর প্রায় দশমাস পর সুইডেনে শান্তির দেশে গিয়েছিলাম। আর প্রেক্ষাপট হচ্ছে সন্তানসম্ভবা ভাগ্নিকে দেখতে আসা মামা মামীর অনাগত নাতিকে তার আরেক নানাবাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেপ্রকাশ।
শীত এবং গ্রীষ্ম এই দুই চরিত্রের সুইডেনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। প্রথমবার ভাল শীতের ভেতর তিনমাস মাস বয়সী একটা পুতুলমানবকে ক্যারিব্যাগে ঝুলিয়ে স্টকহোম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের স্কাভাস্তা এয়ারপোর্টে নামলাম। শীতের প্রতাপ থাকলেও মিঠে কড়া রোদ আছে। আমাদের ঘুমন্ত পুতুলমানবটির কপালে রোদ এসে চুমু দিয়ে গেল। আর ফ্লিগবুসসার্না এয়ারপোর্ট কোচও এসে গিয়েছে। বাকি পথটুকু স্বস্তিতে যেতে পারব আশা রাখলাম।
আশাহত হলাম না। বরং রাস্তার দুদিকেই পেঁজা বরফের ওপর গা ঝেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়া সেনাবাহিনীর মত স্কট প্রজাতির পাইন আর ওক গাছেদের আধিক্য চমকেই দিচ্ছিল। কখনো এভাবে পাইন বা ওকের বন দেখিনি। কখনো না।
আগের সেই নরম রোদটুকু ময়লা আকাশে মিলিয়ে যাওয়ায় চনমনে ভাবটা একটু স্তিমিত হয়েছে এখন। কেমন একটু গম্ভীর লাগা শুরু হয়েছে। আর হঠাৎ হঠাৎ জালের মত এক বস্তু জড়িয়ে পাথুরে পাহাড়েরা ভ্রমণের গাম্ভীর্য বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
আমার সহযাত্রীও কো ইন্সিডেন্টলি গম্ভীর মুখে পাইনের জঙ্গল থেকে মুখ ফিরিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। তাকে প্রশ্ন করলাম,
- পাহাড়েরা সবাই মশারি গায়ে দিয়ে আছে কোন কারণে?
স্ক্রিন থেকে মুখ না সরিয়েই পাথরের টুকরা যেন আমার গায়ে না পড়ে জাতীয় মুখস্ত উত্তর দিল। উত্তর জেনে আশ্বস্ত লাগা দরকার। সুইডেনের পাহাড়গুলোও আমার দেখা গতানুগতিক পাহাড়ের চেয়ে সামান্য আলাদা। একটু বেশী প্রস্তরাবৃত, একটু রাগী রাগী। সে কারণেই কিনা জানিনা বেশ ভীতি নিয়েই দেখছিলাম ওদের।
স্টকহোম সেন্ট্রাল ষ্টেশনে এসে বাস থামল। একটা নাল্লে আর একটা ডুকতিগ ফ্লিককার বাসায় পৌঁছাতে খুব বেশী সময় লাগলো না। "নাল্লে" সেঝমামার "টেডিবিয়ারপুত্র" সাহিল, আর "ডুকতিগ ফ্লিক্কা" হচ্ছে নিদা নামের আমার খুব "ভাল" একটা বোন। পুতুলমানবকে নিদা উৎসাহ নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেও সাহিল একটু সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। সে মূলত তার নাল্লেপনায় টান পড়ার আশংকা উড়িয়ে দিতে পারছিল না ।
দেত কম এন লিতেন মুস
যম ফিলে লেনা হুয
ইনতে হার
ইনতে দার
মেন দার
পিপ!
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শীতের সাথে আমার পরিচয় নতুন। প্রথম পরিচয়েই হাড় ফুটো হয়ে গিয়েছিল। নবাগত হিসেবে মার্চের শীতও এখানে তীব্র লেগেছে। জানালার বাইরে হালকা তুষারপাত আছে। সামনের খেলার মাঠে নিদা সাহিল এস্কিমো সেজে গড়াগড়ি করছে।
কোলে পুতুলমানব মোচড়া মোচড়ি করছিল। মামী দেখলাম একটা ছোট্ট ইঁদুরের গল্প বলছিল সুরে সুরে, যে কিনা পছন্দমত কোথাও বাসা ভাড়া না পেয়ে চিঁচিঁ করছিল।
আবার এই যে নানু, এদিকে তাঁকাও নানু বলে কথোপকথনের উদ্যোগ নিচ্ছিল। যদিও তরুণীদর্শন মামীর মুখে নানু ডাক বড় বেমানান লাগছিল। কথাটা জানাতেই মামীও জানিয়ে দিল যে আপু- ভাইয়া ওগুলো ডাকতে পারবেনা। মাঝে মধ্যে একটু মুরুব্বি হতে ভাল লাগে।
সম্বোধনের ব্যপারে আমি উদারনীতি অবলম্বন করি। যার যা ভাল লাগে সে তাই ডাকবে।
জানালায় দৃষ্টি দিতেই দেখলাম ছোট এস্কিমোটা তুষারের মোটা জাজিমের ওপর বসে হা করে কাঁদছে। আর বড়জন কাঁদছে ঠোঁট উল্টে ফুঁপিয়ে। দুই স্তর বিশিষ্ট কাঁচের শার্সি হওয়ায় দ্বৈত কান্নাকাটি ছিল মিউট করা। শুধু দেখাই যাচ্ছিল, শোনা যাচ্ছিল না।
সেঝ মামা দরজার চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে বলছিল,
- নিশ্চয়ই ছোটটা ব্যথা পাইছে আর বড়টা ভাইয়ের দুঃখে কানতেছে! বুঝছস! সারাদিন এইই চলে।
ভাঙলো দেয়াল সিসিমপুর
নিদা সাহিলের সাথে আমার দু বছর আগেও বাংলাদেশে দেখা হয়েছে। ছোট্ট নিদা ওর শ্রুতিমধুর বাংলায় স্মৃতিচারণ করছিল টুকটাক।
-জুম্মি আপু, বাংলাদেশের বারান্দায় গেলে মানুষ এই মুরগীইইইই, এইই তেরকারিইই বলত। ছোট বুয়া বলত, আইতাছিইই আর সাহিলের ছিল ফ্যুরা বছর, ও বলত বেন মানে হাড্ডি(কী হাসি!)।
সাহিলের আড়চোখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা তখনো চলছে। তবু সে মোটা গলায় তার মত প্রকাশ করল একটু। "আর সাহিল শুধু বাইসা বলত।"
তারপর শুরু করল খিক খিক হাসা।
একটা বয়সে ছোট ছেলেপেলে বর্জ্যপদার্থ নিয়ে আলোচনা করতে আনন্দ পায়। সেই বয়স তার চলছে।
- তোমার কি আমার কথা মনে আছে?
চোখ নীচু করে মাথা ওপর নীচ করল। মাথা না উঠিয়েই তারপর আঙ্গুল দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলো,
-ঐটা কে?
ওখানে তো দুইজন। একজন হচ্ছে দুলাভাই। ওর নাম আদনান। তুমি আদনান ভাইও ডাকতে পারবে। আরেকজন যে আছে একটু ছোট, ও তোমার ভাগ্নে। নিদার কাছ থেকে ভাগ্নের সুইডিশ জিজ্ঞেস করব এমন সময় সাহিল ঐরকম নতমুখী হয়েই বোনকে গুট গুট করে বলল যে সাহিলই হল এই বাসার সবচেয়ে ছোটবেবী। এই এইটুক। দুইটা আঙ্গুল দিয়ে ওকে ধরা যায় আসলে। নিদার অনুবাদ শুনে হাসি চেপে ওকে আশ্বস্ত করলাম।
তোমার চেয়ে ছোট বেবী এই বাসা কেন বাছা, পৃথিবীতেই নাই! খুশী?
মাঝখানে ইন্টারপ্রেটার হিসেবে নিদা থাকায় সাহিলের সাথে আমার সম্পর্কের কাঁচের দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলতে সুবিধা হচ্ছিল। নিদার কানে কানে বলে, বাংলাদেশের সিসিমপুরের কথা একটুখানি মনে পড়ছে ওর। আমি সিসিমপুর দেখা বিষয়ে ওকে সাহায্য করতে রাজী কিনা।
এরপর সারাদিন একটু পরপর টুকটুকি শিকু হালুমেরা মিলে একটা দাঁত মাজার গান অনবরত গাইতে লাগলো। ব্রাশে পেস্ট দিয়া কিভাবে হেলিয়া দুলিয়া দাঁত মাজা লাগে তার চিত্তাকর্ষক বর্ণনা এই গানে পাওয়া যাবে।
প্রথম আলোর আর্কাইভ থেকে
জীবনচর্চা
বৈদেশে বাঙ্গালিয়ানা সহজ বিষয় নয়। বিশেষত খাবার বিষয়ে। নিজের তখন দেড় বছরের প্রবাসজীবন। আমি পার্থক্য করতে পারি আস্ত মাছের (সব জায়গায় পিস হিসেবে মাছ পাওয়া যায়না) আঁশ ছাড়িয়ে, কেটে, কষিয়ে, তরকারী ছেড়ে, মাখো মাখো ঝোল রাঁধতে কত সময়- কত শ্রম যায়! এর চেয়ে হোয়াইট সসে স্যামন ফিলে, সাথে স্যঁতে করা কিছু সবজি, আলু সেদ্ধ অনেক শ্রমবান্ধব। বাঙ্গালী মশলার ঘ্রাণ আর তেলতেলে রসায়ন রান্নাঘর থেকে তাড়াতেও সময়ের হিসেব সামনে আসে। আর ঠিকমত জানালা না খুলে রাঁধলে তো বলাই বাহুল্য। রাস্তায় বেরুলে কাপড়ের ভাঁজে ঘাপটি মেরে থাকা রাঙা মূলা আর শুঁটকীর গন্ধেরা পথচারীদের সাথে না চাইতেই কুশল বিনিময় করবে।
তবু আমরা যত্ন করে বাঙ্গালিয়ানা দূর দুরান্ত থেকে যোগাড় করি, কাটি- বাছি, শিলপাটায় বেটে ফেলি তারপর তৃপ্তি নিয়ে খাই।
স্টকহোমের দেশী বাসাগুলোতে এই চর্চা অবশ্যই আছে। আমার মামী যদিও বেড়ে উঠেছেন ওখানেই তবু দেখি চমৎকার গুছিয়ে চচ্চড়ি করছে, ভুনা করছে। মামাও দক্ষ হাতে কেটে ধুয়ে দিচ্ছে। এমন না যে ঘরে বাঙ্গালী অতিথি এসেছে বলে। এভাবেই ছেলেপুলেসুদ্ধ অভ্যস্ত তারা।
আমরা হাত লাগাতে চাইলে নিদা সাহিলের কাছে পাঠিয়ে দিল। ওরা হাতে বানানো আপেল পাইয়ের ওপর ইচ্ছেমত নকশা বসাচ্ছে। আমাদের ওরা দলে নিল।
একটু নির্মোহ স্তুতি করলে কি স্বজনপ্রীতি হয়ে যাবে? চারিদিক নিখুঁত পরিষ্কার। মাঝখানে চলছে দেশী বিদেশী ফিউশন। সবাই সবার মত করে নিজের কাজকে উপভোগ করছে, খাবারের চাহিদা পূরণ করছে এবং অবশ্যই রান্নাবাটির পেছনে সারাদিন ব্যয় করছেনা। দেশ বিদেশের কিছু চিরন্তন বিতর্কের চাইতে অনুশীলন এবং সবার অংশগ্রহণমূলক কাজের পদ্ধতি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
পাথরের প্রহরী
এতগুলো প্রস্থ কাপড় বছরের এই সময়ে লাগবে ভাবিনি। শীতে জবুথুবু। বাতাস কি চায়, কেন চায় বোঝা যাচ্ছেনা। হঠাৎ হঠাৎ দাঁত বিঁধিয়ে চলে যাচ্ছে। বহিরাগত অথবা নতুন মা বলে আমার শীত ভাবনা প্রবল হতে পারে। কারণ বাকিরা স্বাভাবিকভাবে হাত পা নাড়াচ্ছে। শুধু আমার মনে হচ্ছে শীতে আমি অ্যাসট্রোনাট হয়ে গেছি। হাত পা ফেলতে অসুবিধা হচ্ছে।
বাস এসে গেছে। যাচ্ছি একটা ইনভাইটেশনে। ফাঁকতালে শহরতলী দেখা হবে। মার্চ এসে গিয়েছে তবু ন্যাড়া মাথার গাছগুলো যেন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে পাতার যাদুর জন্য। একটু একটু করে প্রস্ফুটিত হাজার ফুলের সৌন্দর্যে শহরবাসীকে চমকে দিতে হবে না!
সাহিল মাথা নীচু করে "দুলাল-ভাইয়ের" পাশে বসে খিক খিক করে হাসছে। কাজিন সিস্টারের হাজবেন্ডকে অবশেষে সে যে ঐটা-র বদলে দুলাল-ভাই ডাকছে তাই বা কম কী?
আবার সেই রাগী পাথরের ছোট ছোট পাহাড়দের দেখা পেলাম। পাহাড় বললে ভুল হবে, ঢিবি বলাই ভাল। জালের বুনোট করা চাদর জড়িয়ে মুরুব্বীদের মত ব্যস্ত রাস্তার পাশে যেন দাঁড়িয়ে আছেন। পাড়ার ছেলেপেলে কতটুকু সীমা ছাড়ালো নজর রাখছেন তাই।
আমাদের গন্তব্যের বাসাটা শুনলাম কঠিন শীলার পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে বোতাম চাপ দিলে লিফট আসবে। লিফটে করে আমরা পাথর কেটে তৈরি করা পথ দিয়ে একটা পাহাড়ি বাসায় পৌঁছব। আগে কখনো আমাদের চট্টগ্রাম রাঙামাটিরও কোন নিরেট পাহাড়ি বসতিতে আমার যাওয়া হয়নি। অন্যদের তুলনায় আমিই রোমাঞ্চিত বেশী। মানুষের কৌশলী বুদ্ধি, সৃষ্টিকর্তার দেয়া মেধার বিনিয়োগ এত চমৎকার হতে পারে ভেবে বিস্মিত হচ্ছিলাম।
পাহাড়ের ওপর বসত বাড়ি
মামা মামীদের কমন ফ্রেন্ড সার্কেলের একটা পটলাক পার্টি ছিল। খুব ছিমছাম গোছানো পার্টি। অনেকদিন পর আমাকে কেউ ভাবী ভাবী ডাকলো না। নাম ধরে ডাকছিল। বঙ্গভাষায় ভাবী শব্দটি বিশেষ ভার বহন করে। নিজেকে একটু ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল তাই।
এখানেই ছয় বছর বয়সী এক অভিমানী কন্যার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। পরিচয়ের শুরুতে কিন্তু কন্যা অভিমানী ছিল না। খুব উৎসাহ নিয়ে একটা ফুল তোলা মোড়ানো উপহার এনে আমার হাতে দিয়ে বলল,
-তোমার ব্যেবিসের এটা।
প্যাকেট খুলে, জামা বের করে, খুব সুন্দর হয়েছে বলা পর্যন্ত মুচকী হেসে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমিও নতুন জামা পরিয়ে মডেলকে সামনে আনলাম। দেখি মুচকী হাসি ভেদ করে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
একটু পর সবাই যখন গল্প করছে- খেলছে আর আমি আহমাদকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম, তখন অন্ধকার ঘরটায় এসেছিল অহনা। আমার পিঠ ঘেঁষে বসে ফোঁস ফোঁস করছিল। আমি তো সুইডিশ জানিনা। ওকে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করেছি,
-তুমি কি খুব রেগে আছো?
- ইয়!
- কার ওপর রেগে আছো? আম্মু আব্বু না বন্ধু?
এবার দিল ফিচির ফিচির করে কেঁদে। সুরেলা সুইডিশে জোর দিয়ে দিয়ে একগাদা কথা বলে গেল। শুধু বুঝলাম সাহিলের সাথে মনে হয় কিছু নিয়ে বনিবনা হয়নি।
সাহিলকে পরে জিজ্ঞেস করব ঘটনা। আপাতত ঘুমন্ত শিশুর বুকে কাথা টেনে দিয়ে অভিমানী বাচ্চাটার হাত ধরতে চাইলাম। হাত ধরতে দিল। অন্ধকার ঘরে আমরা দু জনই কতক্ষণ হাত ধরে বসে থাকলাম।
একটু পর সাহিল এসে ফ্লামিংগোসের ছবি আঁকা একটা বই স্বভাবজাত নতমুখে দিয়ে গেল। অহনা চোখ মুছে সুর করে বলে,
-থাক্ক (ধন্যবাদ)।
এভাবেই সমাপ্তি হল বিরাট অভিমানের।
পরেরবার স্টকহোমের গ্রীষ্মপর্বে আমি আর অহনাকে পাইনি। এই না পাওয়ার কারণ অন্যরা যখন বলছিল, তখন আমার মনে পড়ল অহনার মাথায় কোন চুল ছিলনা। সুন্দর একটা রিবনের ব্যান্ড ছিল শুধু।
অহনার স্নায়ুগুলোকে যখন শেষবারের মত অবশ করা হচ্ছিল, ওর বাবা তখন পাশে বসে কি একটা গল্প অর্ধেকটা মাত্র পড়ে শোনাতে পেরেছিল। গল্পটা কি কোন দুঃখী রাজার ছিল?
গল্পের পড়ে থাকা অংশটি একটি ছোট্ট মেয়ের এলোমেলো হয়ে যাওয়া বাবা, সেরকমই ছোট্ট পাথরের এপিটাফের পাশে বসে শেষ করেছিল।
(চলবে)
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক: https://bit.ly/2MzlnVf
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)