সাহিত্য

স্বপ্নের অদলবদল

স্বপ্নের অদলবদল

স্বপ্নের অদলবদল

পশ্চিমের বারান্দায় দাড়িয়ে আতিকা, রোজ আকাশ দেখে।প্রতিদিনই মুগ্ধ হয় সে,অবাক হয় প্রভুর সৃষ্টির কথা চিন্তা করে।কোনদিন পুরো আকাশটা আবীর রংঙের রাগে গাইতে থাকে,আবার কখনো মেঘের মাঝে আলোর প্রতিফলনে নতুন এক পৃথিবী,কখনো পাখির উঁকিঝুকি দিগ্বলয় জুড়ে!মাগরিবের আজান কানে আসতেই আকাশটা যেন আরো বেশী রহস্যময় হয়ে উঠে,সে সময়টাই বেশি প্রিয় আতিকার। এমনি সময় কখনো বা আহমেদ পিছন থেকে কাঁধ ছুঁয়ে এসে দাড়ায়।কখনো বা গুনগুন করে কবিতা শোনায় কানে কানে তাকে।আতেকা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে,তার দিকে।নিরবে সে ভাবে, প্রভুর ইচ্ছা কিভাবে বদলে দেয় সবকিছুকে।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আহমেদকে দিয়ে একটা কবিতা ছু্ঁইয়ে দেখানো যেতো না,আর আজকাল তো কথায় কথায় আল-মাহমুদ,আল্লামা ইকবাল,ফররুখের কবিতা আওড়ে যায়।ইদানিং সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর বেশ কয়েকটা কবিতাগুচ্ছ ছাপা হচ্ছে!

কলেজ শেষে ফিরতে বেশ বিকেল হয় আতেকার, কর্মদক্ষতার কারনে বেশ অল্পবয়সে প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।সারাদিন কলেজের শিক্ষার্থী, পড়াশোনা,গবেষনায় মাথা তুলে তাকানোর সময় পাওয়া কঠিন তার জন্য।দু'সন্তান মুসয়াব-জয়নাব বেশ বড়ো হয়ে গেছে,তেমনি গোছানো বলে আতিকাকে চিন্তা করতে হয় না।সকালে কারী রান্না করে রেখে যায় আতিকা,দুপুরে বাপ-মেয়ে,ছেলে মিলে খেয়ে নেয়।তারপর,আহমেদ তার রিসার্চ সেন্টারে চলে যায়।নিজের পছন্দ ইখতিয়ার অনুযায়ী কাজ করবার ক্ষেত্র,বেশ নির্বিঘ্নে মন খুলে কাজ করা যায়।গত দু'মাস আগে মালয়েশিয়া কনফারেন্স এ সফর করে এসেছে আহমেদ,শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনার সুন্দর প্রযুক্তি কৌশল -যা জনবহুল শহরগুলোতে সাড়া ফেলে দিয়েছে,এরমধ্যে।এতোসব ভাবতেই আহমেদ,চায়ের কাপে ঠোঁট রেখেই আতিকাকে ফোন করে,ফোন রিসিভ হলো না,ম্যাসেজ এলো,"আমি মিটিং শেষে আসছি,তুমি ক্যাম্পাসের প্রিয় চায়ের দোকানটার সামনে এসো।"

আতেকার কলেজ থেকে ক্যাম্পাসে আসতে,ঘন্টাখানেক সময় তো লাগবেই।এইফাঁকে আহমেদ পুস্পবিতানে গিয়ে দোলনচাঁপার গুচ্ছ,বেলীফুলের মালা কিনে ফেলে জটফট,সাথে আল মাহমুদের
সোনালী কাবিন থেকে আওড়াতে থাকে আনমনে,
"হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
প্রবল ছোবলে তুমি যতটুকু ঢালো অন্ধকার
তার চেয়ে নীল আমি অহরহ দংশনের ভয়ে।
এ কোন কলার ছলে ধরে আছো নীলাম্বর শাড়ি
দরবিগলিত হয়ে ছলকে যায় রাত্রির বরণ,
মনে হয় ডাক দিলে সে-তিমিরে ঝাঁপ দিতে পারি
আচঁল বিছিয়ে যদি তুলে নাও আমার মরণ।
বুকের ওপরে মৃদু কম্পমান নখবিলেখনে
লিখতে কি দেবে নাম অনুজ্জ্বল উপাধিবিহীন ?...."আতেকাকে শোনাবে বলে, যদিও আতেকার মতো দরাজ কন্ঠে আবৃত্তি করতে, খুব কমই শুনেছে আহমেদ।এতো সুন্দর,তীব্র শব্দরাজী তার,তবুও কোথাও কোন অনুরোধে সে আবৃত্তি করেনি,কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে প্রিয় ছাত্রীরা অনুযোগ করেছিলো খুব,সেদিন ফররুখ থেকে পাঠ করেছিলো সে।বাসায় অবশ্য মুসয়াবকে শুনাতে হয় রোজ,কবিতার সাথে বসতি যেন,আহমদের সাথে গলা মেলায় জয়নাব-মুসায়বও
"তোমার শিল্পী করে নাও আমারে,
করে নাও তোমার কবি,
করে নাও অবিকল রাসূলের কবিদের,
করে নাও অবিকল রাসূলের কবিদের, প্রতিচ্ছবি
তোমার শিল্পী করে নাও আমারে...."পিচ্চি মুসায়ব তার আম্মুর জন্য দোয়া করে,আল্লাহ যেন তাকে রাসূলের কবি করে নেন।এসব ভাবতে ভাবতেই আতেকা এসে হাজির,হাতে দু'কাপ চা নিয়ে সামনের বেঞ্চিতে বসে,দু'জন মুখোমুখি।
প্রিয় ক্যাম্পাসে দু'জনের সেই রঙিন আবার বিষাদময় দিনগুলোর স্মৃতির ফানুস উড়িয়ে অনেকটা সময় হাটে ওরা,সন্ধ্যা হতেই একটু হালকা বৃষ্টি আবার নেই।স্মৃতি রোমন্থনে ওরা আজ ব্যাকুল।

আতেকা -আহমেদ দু'জনই একই ক্যাম্পাসে একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলো।আতেকা পড়ে থাকতো বই নিয়ে,রিসার্চ এ তার দারুন আগ্রহ,কবিতা -গল্পও লিখতো সাময়িকীতে টুকটাক।আহমেদ পরিবারের বড় ছেলে,চাকুরীর পড়াশোনা,কোচিং নিয়ে দিন পার হয়।রেজাল্ট বেশ ভাল,কিন্তু কোন কাজে লেগে থাকাটা যেন ওর ধাতে সয় না।আত্মবিশ্বাসে একটু কমতি ছিল,চারপাশে হতাশা-ব্যর্থতার গ্লানি ঝরছে যে,আশার আলো দেখা দুস্কর।সহপাঠী,শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা আহমেদকে নতুন পথ দেখিয়েছিল।প্রোজেক্ট পেপার জমা দেওয়া,বাইরে স্কলারশিপে অ্যাপ্লাই করায় আতেকা সহযোগিতা করেছে এক কল্যাণকামী শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে,আহমেদ খেয়াল করেছে,আতেকা এক অন্যরকম নারী,মানুষের কষ্টগুলোকে সম্ভাবনার চোখে দেখতে,ব্যথাভরা হৃদয় বিশ্বাসে ভরিয়ে দিতে পারার, এক অসাধারন ক্ষমতা তার আছে।আহমেদ তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে,এমন জীবনসঙ্গী,পথের সাথী দরকার তার।যে কিনা পথ চলতে ভয় পায় না,পরম নির্ভয়ে ছায়া দিয়ে, অভয় দিয়ে আগলে রাখে।আহমদ সরাসরিই কথাটি বলে আতেকাকে, সাথে নিজের পরিবার-আর্থিক অবস্হা..সবকিছুই,সোজাসাপটা।আতেকার মতামত জানতে চায় সে।মাস্টার্স শেষ ওদের, আহমদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার মাসচারেক সময় আছে,আতেকাও কলেজে অ্যাপ্লাই করেছে।আহমেদ মনের অজান্তেই আতেকার ব্যক্তিত্ব,গুনমুগ্ধতায়, নিজের মধ্যে বিচ্ছেদ, শূন্যতা অনুভব করছিলো।বাইরে পড়তে চলে গেলে,সেখানে হয়তো আরো শূন্যতা ছেয়ে ধরবে তাকে।আতেকা সাতদিনের সময় নিয়েছিলো।সাত-সাতটা দিন পেরিয়ে গেলেও, আতেকার খবর নেই,ফোনও বন্ধ,আহমেদের অস্হিরতা বাড়ে,দুশ্চিন্তায় কি করবে,ভেবে পায় না।আতেকা কি কষ্ট পেয়েছে,কল্যাণকামী বন্ধুর কাছে তার আচরণ কি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে,নাকি অন্যকিছু।সেতো সত্যটাই বলেছে,মনের কথা লুকোয়নি।অবশেষে,ভেবেচিন্তে সে ঠিক করে,আতেকার বাসায় গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসবে।

সেদিন সন্ধ্যায়, আতেকার বাসায় যায় আহমেদ।ওর বাবা দরজা খুলে ভিতরে বসতে বলেন,কিছুটা রাশভারী মানুষ,আতেকা বলতো,অনেক রাগীও,তবে ভিতরটা নরম।পর্দার আড়াল থেকে মিষ্টি,পানীয় আসে,আহমেদ চিন্তায় অস্হির হয়ে আছে।আতেকার বাবা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বললেন,আতেকা দিনপনেরো দিন ধরে অসুস্হ,তোমার কথা আমাকে বলেছে..." একথাগুলো শুনতে শুনতেই জড়তায় পা-ছেয়ে গেলো তার,কি কঠিন সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেন তিনি আবার...।তিনি তখনো বলেই চলেছেন,একমাত্র মেয়ে আমার আতেকা,আমার সব ধন দিয়ে ওকে বড় করেছি,বিশ্ববিদ্যালয়ে সবোর্চ্চ পড়াশোনা করিয়েছি।সেও আর ছোট নেই,আগলে রাখার বয়স আমারও নেই,এতোদিন আগলে রেখেছি।তুমি যে প্রস্তাব দিয়েছো,ওয়াদা করেছো তার পুরোপুরি রাখতে পারবে তো?"আমার সবোর্চ্চ চেষ্টা করব,ওয়াদা করলাম,বাবা।একথা বলতেই,তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,বাহুডোর আবদ্ধ দু'জনই কাঁদছি।তিনি হয়ত কন্যার শূন্যতায়,আর আমি আতেকাকে পাওয়ার পূর্নতায়!সেদিনের বিকেলে আতেকা একটা কবিতা পাঠিয়েছিল,
"হাতের মুঠোয় আঙ্গুলের ভাজে
মায়াবী রঙিন স্বপ্নের কারুকাজে,
আলুথালু কেশে,প্রিয় চেনাবেশে
পথের শেষে পাশাপাশি হেসে
নিরন্তর নিভৃত কুটিরে ভালবেসে।

ডানা ঝাপটানো পাখি,
উড়ে চলুক,না ভেসে বেড়াক
হলদে শাড়ি মায়া ভারী,
জড়িয়ে আছো,না রঙে ভেজাক

না-পাওয়ার অনুসঙ্গে ব্যথার তরঙ্গে
একচিমটি দূরে তবু মিছে রঙ্গে।
চপলতায় খেলে যায় খেয়ালি,
তৃপ্তির আশে গুনগুনিয়ে কাওয়ালী।
ব্যথা পায়,তবু আরো ব্যথা চায়,
নেশা নয়,তবু মোহে তাঁকে ছায়।

অনুরোধে ছুঁই পথের যতো ধূলো,
অনুরাগে গাই বেসুরো পদ্যগুলো।
মান-অভিমান সেতো বড়ো বেমানান,
চায়ের কাপে ধোয়ায় মিলায় সে অভিমান।
তবু,আমি কি জানি,এখনো?
চাই,সত্যিই কি চাই!"

আজ পড়ন্ত বিকেলে একটা পান্ডুলিপি খুলে সামনে ধরে আহমেদ, সেখানে আতেকার ইউনি' জীবনের শেষদিকের কিছু কবিতা আর আহমেদ যখন বিদেশে ছিলো,তখনকার পাঠানো সমস্ত কবিতা সাজানো।মুসয়াব আসার পর ব্যস্ততা, আর অধ্যাপনা সামলে আর কবিতা লেখায় সময় দিতে পারেনি।আহমেদের হাতে পান্ডুলিপি দেখে তার চোখ ছলছল করে ওঠে,আহমেদ আতেকাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে,প্রশান্তিময় হাসি তার মুখে,বলে,"আমার জীবনের কবি,বলুন,আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কার স্মরণে...."আতেকা সশব্দে হেসে ফেললো,এতোদূর তুমি কখন করলে,উস্তায!আলহামদুলিল্লাহ। জাযাকাল্লাহু খাইরান।আমার কবিতা বইয়ে যার স্মরণে,তিনি হলেন প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক,অনবরত বৃক্ষের গানের কবি....।আহমেদ হেসে বলে,কবি,বইয়ের প্রথম অটোগ্রাফটা কিন্তু আমার চাই...!


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)