মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ

"একটা রাতের আত্নকাহিনী"

"একটা রাতের আত্নকাহিনী"
আমি একটা খুব সাধারণ রাত, খুব একঘেয়ে। নীলজোসনার জানালার পাশে প্রতিদিন আসি, নীলজোসনার ক্লান্তিতে ক্লান্ত হয়ে ওর জানালার বাইরে ঘুমিয়ে পড়ি। সুর্যটা এসে গেলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিই, আবার আসার আগে পর্যন্ত নীলজোসনার শুভকামনা করে... মানুষটা মনে হয় আমাকেও বেশ পছন্দ করে, না? নইলে এমন নাম রাখবে কেন নিজের? ও শুধু আমাকেই না, ওর ঘরটাকেও মনে হয় বেশ ভালোবাসে। সারাদিনের ক্লান্ত নীলটা যখন ঘরে ফেরে, তখন সূর্য বেশ হেলে গেছে পশ্চিমে। কপালে অনেকগুলো ভাঁজ, কাজের, চিন্তার! কেন যেন গুনগুন গাইতে গাইতে আস্তে আস্তে ভাঁজগুলোকে মুছে ফেলে মানুষটা। আর সূর্য চলে গিয়ে আমার দেখা পেলে তো কথাই নেই। সব কাজের শেষে চায়ের মগ হাতে কখনও একা, কখনও ভালবাসার মানুষটিকে নিয়ে আমার কাছে এসে বসে। আমি যতই পূর্ণ হতে থাকি, বাচাল মানুষটা নিরব থেকে নিরব হতে থাকে। আমিও সারা পৃথিবীকে নিশ্চুপ করে দিয়ে নীলজোসনার জানালার বাইরে এসে বসি। কখনও সসংকোচে আবিষ্কার করি, কফির মগ হাতে সে-ও এসে আমার পাশটিতে ঘেঁষে ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে দুর্বোধ্য ভাষা। নীলজোসনাকে কাঁদতে দেখেছি আমি। কখনও ছলছল চোখে, কখনও ডুকরে ডুকরে, কখনও চাপা জান্তব চিৎকারে আমার নিরবতাকে খানখান করে দিতে দেখেছি। মাথায় হাত রাখার ক্ষমতা যে নেই আমার, পারলে আমার ভালোবাসাও টের পাইয়ে দিতাম ওকে। একদিন কোথাকার কোন এক বুড়োর গান শুনছিলো, সেই থেকে বুড়োকে আমি দেখতে পারি না। বুড়োটা ‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার’ বলে বলে মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো ওর, নীলজোসনা দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে টেবিলে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলো। আর একদিন অই বুড়োরই ‘স্বাধীনতা কি দুঃখিনী নারীর জরাজীর্ণ বস্ত্র’ গেয়ে গেয়ে চায়ের কাপ উলটে কেঁদে দিয়েছে। আহহ... সে কী কষ্ট! আরও আগে... ওই যে, যেদিন চাঁদটা মেঘের জন্য উঁকি দিতে পারছিলো না, আমিও যখন ভাবছিলাম এইবারে বিদায় নিই। হঠাত নীলজোসনাকে দেখতে এসে দেখি দুইচোখে বন্যা ভাসিয়ে একটা নদীর ছবি দেখছে। নীরব, অসহ্য, ধারালো সে কান্না, আমাকে চিরে দিচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর ‘হায় তিতাস, হায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস রে!’ বলে হাহাকার করে উঠলো। আহারে!! নীলজোসনাকে ক্ষেপে যেতেও দেখেছিলাম। ওই যে সেদিন, ওর ল্যপটপে কি একটা দেখে নাকের পাটা ফুলিয়ে ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে ফেলেছিলো। পরের একটি ঘন্টা কী-বোর্ডে ঝড়ের মত উঠানামা করেছে ওর আঙ্গুলগুলো। ঘুম ঘুম ভাব আসছিলো কয়েকবার, ততবারই দেখছিলো ভিডিওটা। এক ফাঁকে আমিও একটু উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম কী দেখে... একটা হাড় জিরজিরে ছেলে তাকে আরও কয়েকজন মিলে পেটাচ্ছে। কাপড় খুলে নিয়ে ছেলেটার পায়ের তলায় মেরেই যাচ্ছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে ভাবছিলাম, এরাও মানুষ? কিন্তু কি করবো? আমি নিরুপায়... শুধু পেরেছিলাম এক ঝলক শীতল বাতাস দিয়ে একটু পর পর ওকে ছুঁইয়ে যেতে। আর একদিন বাকহারা নীলজোসনা তাকিয়ে ছিলো, কোনদিকে? জানিনা। হাতে একটা কাঁটাতারের বেড়ার ছবি। ভালো করে দেখতে গিয়ে দেখি কী বীভৎস ব্যপার, একটা লাল জামা উলটো করে কে যেন ঝুলিয়ে রেখেছে সেখানে। পৃথিবীর উল্টোপাশে, টেক্সাসের মরুভূমিতেও এই শীতলতা দেখি না আমি, যে শীতলতা সেদিন ওর চোখে দেখেছি। নীলজোসনা তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সাথে থাকতে আমার ভীষন ভালো লাগে- এই কথাটা কোনদিন তোমাকে বলা হয়নি। আজকে তুমি কি যেন একটা গান শুনছিলে না? আমি সে-ই থেকে ভাবছি, তুমি আমাকে নিয়েই শুনছো... //এখন অনেক রাত, তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস , আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায় ! তোমার গানের সুর আমার পকেট ভরা সত্যি মিথ্যে রেখে দিলাম তোমার ব্যাগ-এর নীলে | জানি তর্কে বহুদূর, তাও আমায় তুমি আঁকড়ে ধরো, আমার ভেতর বাড়ছো তিলে তিলে !// নীলজোসনা, আমার খুব ইচ্ছা করে তোমাকে বুঝতে। নীলজোসনা, আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে রাতে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনে কেন তুমি শিউরে উঠো? কেন তোমাদের কাছে আসা মানুষগুলোও তোমাদের মত সাধারণ? পরিপাটি কাপড়জামা পরে আসা মানুষগুলো কেন কথার নেশায় তোমার ছাদের মেঝেতে বসে পড়ে? কেন তোমার হাঁড়ির মনভুলে যাওয়া নরম ভাত খেয়ে পেটে হাত বুলিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে? কি ভাবো তোমরা এতো এই সবুজ দেশটা নিয়ে? নীলজোসনা, আমি প্রতিদিন সারাটা পৃথিবী ঘুরে আসি। কত রঙের মানুষ দেখি, কত বিচিত্র তাদের আবেগ, দেখি। নীলজোসনা, তোমার দেশের জন্য যখন তুমি কাঁদো, তোমার দেশটাকে আমার ভারি হিংসা হয়। আমার প্রতিদিনের চলার পথে যত দেশ দেখেছি, তার  মধ্যে এতো দুঃখশোকে ভরা কিন্তু এত আবেগপ্রবণ মানুষ আমি আর দেখি না। প্রতিদিনের স্বপ্নভঙ্গের পরও তোমরা আবার এই বিদঘুটে আকৃতির সবুজ ছোট্ট দেশটাকে নিয়ে আবার স্বপ্ন বাঁধো। আমাকে শিখাবে নীলজোসনা? আমিও যেন নিজে রাত হয়ে থেকেও ভোরটাকে আরও আগেই জাগিয়ে তুলতে পারি? নীলজোসনা, আমি যেন একটা ঝকঝকে ভোরের কোলে তোমাকে ঘুমিয়ে পড়তে দেখতে দেখতে চলে যেতে পারি। নীল, তুমি ভালো থাকো, তোমার ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে...

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)