বিবিধ

আমস্ট্যল ডাম থেকে আমস্টারডাম (শেষ পর্ব)

আমস্ট্যল ডাম থেকে আমস্টারডাম (শেষ পর্ব)

বাঁধের শহরে বসতি, প্রার্থনা

আমস্টারডামের বেশ অনেক বাসার ছাদগুলো, স্পেসিফিকলি পুরনো বাসার ছাদ ইউরোপের গতানুগতিক ছাদের মত না। একটু  তিনকোণা কিন্তু কোণের প্রান্তবিন্দু আবার অর্ধবৃত্তাকার। এগুলোকে বলা হয় ত্রিকোণ গেবল বা চুড়ো। আমস্টারডামেই শুধু এমন চুড়াওয়ালা বাসা দেখলাম। বাড়িগুলো হোমোজিনিয়াস আর দুই দালানের মাঝখানে কোন তফাৎ নেই।

একে তো বাঁধের শহর, স্বাভাবিকভাবেই অতি ওজনদার বাড়ির ভার বইতে পারার কথা না। তাই এক পর্যায়ে কাঠের বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বড় বড় দুটো অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় নগরী।আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল কাঠের বাড়িগুলোকে একের পর যথার্থ জ্বালানী হিসেবে  নাগালের ভেতর পেয়ে গিয়ে। 

এবার বাড়িগুলোর প্রস্থ, সেই সঙ্গে মূল ফটকের বহির্ভাগের ওপর শুল্ক বসানো হল। এখন এই শুল্ক এড়াতে এমন সংকীর্ণ সংকীর্ণ বাড়ি বানানোর চল শুরু হল। বাড়িই যখন সংকীর্ণ, তখন এর ভেতর প্রশস্ত সিঁড়ি কেমন করে পাওয়া যাবে?

সিঁড়িগুলোও সরল নিয়মে তাই জবরজং ঘিঞ্জি, ও দিয়ে ওজনদার মালসামান ওপরতলায় ওঠানো সম্ভব না।

                           আমস্টারডামের ট্র্যাডিশনাল বাসা

বাসাগুলো কেমন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে এমন মনে হল। পরে লেখাপত্র পড়ে জানতে পারলাম ছাদের গেবলের সাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ক্যান্টিলেভারড বা দেয়াল থেকে সম্প্রসারিত বীম দেয়া আছে আর আছে এক ধরণের আংটা। এদের সাহায্যে মালামাল পরিবহন করা হয়। আর জিনিসপত্র আংটা দিয়ে ওঠানোর সময় দেয়ালের গায়ে যাতে ধাক্কা না লাগে সে জন্য একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বাড়ি বানানো হয়েছে।

এইসমস্ত পুরনো বাড়ির ভেতর আবার কিছু ক্যাথলিক চার্চ আছে। স্প্যানিশ ক্যাথলিক রাজার সাথে কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধজয়ের পর নেদারল্যান্ডে  প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সব গির্জা প্রোটেস্ট্যান্ট উপাসনালয়ে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে বসতবাড়ির গোপন কোন কক্ষেই ক্যাথলিকদের লুকিয়ে ধর্ম পালন করতে হত। 

এখন আর আগের সেই দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু এখনো ওভাবেই চুপিসারে যেন অনেক ক্যাথলিক প্রার্থনায় মগ্ন হতে পছন্দ করে।

স্পেন ও পর্তুগাল থেকে প্রচুর পরিমাণে সেফার্ডিক ইহুদী এখানে এসে অভিবাসন গড়ে তুলেছিল। অসংখ্য খ্রিষ্টীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনাগগও আছে নগরীতে। ইহুদীরা অনেকেই নগরীকে পশ্চিমের জেরুজালেম ডেকে থাকে। তবে সুন্নি মুসলিমরা এখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। তুরস্ক, মরক্কো থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অতীতের ওলন্দাজ কলোনীভুক্ত ইন্দোনেশিয়া ও সুরিনামের অনেক মুসলমান এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এছাড়াও তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া থেকে আগত অভিবাসীরাও সংখ্যায় নেহায়েত কম না। সুতরাং মসজিদ আছে এ শহরে। শুনেছিলাম পশ্চিম আমস্টারডামে ওয়েস্টারমশি নামের তুর্কি উদ্যোগে নির্মাণাধীন মসজিদটিতে একসাথে আড়াই হাজার মুসলিম নামাজ পড়তে পারবে। পরবর্তীতে ২০১৬  মসজিদটির উদ্বোধন করা হয়।

 টিউলিপ ফুল পপি ফুল  

বাস থেকে নেমেই খেয়াল করলাম খিদে লেগে আছে। সাইকেল, খাল, হীরে জহরতের চক্করে পড়ে পাত্তা পাচ্ছিল না। আমার সঙ্গীটি কফি খেতে চায়। বললাম, দূরে গিয়া খাও। সে কফিশপে না গিয়ে ক্যাফেতে ঢুকলো। এই দেশে কফিশপের সাথে জয়েন্টলি স্মোক শপের কারবার থাকে। গাঁজা- মারিজুয়ানা খোলামেলাভাবে স্থানীয় বা পর্যটকেরা ফুসফুসে নেয়।

আমি নিরাপদ দূরত্বে খালিপায়ে দাঁড়ালাম। ক্যাফেইন তো ক্যাফেইন, বিড়ি-সিগ্রেট, মারিজুয়ানা গাঁজার কুগন্ধ যেন ওপেন ড্রাগ ট্যুরিজমের এই দেশে অষ্ট হস্ত-পদ লইয়া আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে কোনভাবেই বাঁধতে না পারে।

একটা তুর্কি রেস্টুরেন্টের এক কোণে নামাজ পড়লাম তারপর টোম্যাটো ছাড়া তুর্কী সালাদ খেলাম। আমার সামনে আরেকজন গ্রীল টেলার নিয়ে বসেছে। এক টুকরো গ্রীল চেখে দেখার প্রবৃত্ত হল না। হল্যান্ডে এসে হল্যান্ডের কুইজিন না চেনা অন্যায়। ডাচ হচপচের কথা শুনেছি অনেকবার। আলু সেদ্ধ, সব্জি আর মাংসের মিশ্রণে তৈরি। হালাল হচপচ খুঁজে দেখার মত সময় আসলে নেই, এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। সে জন্য ক্যাফে থেকে আনা স্পেশাল ওলন্দাজ নিয়মে তৈরি আপেল কেক খেয়েছি এক পিস, নেদারল্যান্ড স্পেশাল চিজকেকও প্যাকেটে নিয়েছি।

কেক ভাল লেগেছে। ক্যারামেলাইজড আপেলের টুকরো চিবুতে চিবুতে পসরা বসানো দোকান, টিউলিপ- সূর্যমুখী সহ নাম না জানা অসংখ্য ফুলের চারা উদ্দেশ্যহীনভাবে দেখছিলাম। শুনেছিলাম এখানকার নার্সারিতে নাকি দেদারসে ফুলের চারা, টিউলিপের কন্দের মত পপি ফুলের চারা/গাঁজার চারার বেচা- বিক্রি ভাল হয়। এই কথা গাঁজাখুরি নয়, সত্য। অনেক পর্যটক এত দূর থেকে গাঁজার চারা কিনে নিয়ে যায়। তাদের তালিকা উৎকট এই স্যুভেনির সংগ্রহের পর সমৃদ্ধ হয়ে ডালপালা ছড়ায়।

নেদারল্যান্ডের মানুষের ফুলের প্রতি তীব্র অনুরাগ আছে। বাড়িতে বাড়িতে লাগোয়া চিলতে বাগানে বা বারান্দায় তার প্রমাণ তো পেয়েছিই। আর গ্রাখটের স্বচ্ছ পানিতে জলরঙে আঁকা ছবি হয়ে ছিল গুচ্ছ ফুলের প্রাচুর্য। আমাদের বেলফাস্টগামী প্লেন যখন হেলেদুলে ওপরে উঠছিল তখন চমকে উঠেছি মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ টিউলিপের বাগান দেখে। সার বাঁধা হলুদ, বেগুনি, লাল, গোলাপি টিউলিপেরা যেন খুব বাধ্য সেনাবাহিনী। বাতাসের আদেশে আরামে দাঁড়িয়ে আছে এখন। একটু পর মার্চ শুরু করতে হবে।

টিউলিপের জাদুর চাইতে তবু গাঁজা ফুলের জাদুতে মানুষের মোহাবিষ্টতার প্রয়োজন আমি বুঝতে পারিনা। চলতি পথে এক ঝলক দেখতে পাওয়া লাল কাঁচের দেয়াল, বিনোদ বিনোদিনীদের কপট আনন্দমুখর হয়ে ম্যানিকুইন জীবনযাপন যেভাবে নিস্পন্দ- নিঃসাড় লেগেছে।

.......................................

প্লেন আমস্টারডাম ছাড়িয়েছে ততক্ষণে। ব্যালেরিনা জুতোর আড়ালে আমার নিরুদ্বেগ পায়ের পাতারা। গল্প করছে যেন নিজেরা নিজেরা। আমস্টারডামের কাদামাটি গায়ে মেখে ঘুরে বেড়াতে তাদের খারাপ লাগেনি বোঝা যাচ্ছে। কদাকার ফোস্কাও আলো হাওয়া পেয়েছিল বলে ঘুমে আচ্ছন্ন এখন। কিন্তু কোনদিক থেকে যেন আবার কফিবিনের তীব্র গন্ধ তিরতির করে আমার  মগজের দিকে ধেয়ে আসছে। প্রধান ফটক বন্ধ করতে হবে খুব দ্রুত, মানে এক্ষুনি। ঝপ করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

প্রথম পর্বঃ https://bit.ly/2m8A5aY

দ্বিতীয় পর্বঃ https://bit.ly/2L0DiUN


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ