বিবিধ

আমস্ট্যল ডাম থেকে আমস্টারডাম (দ্বিতীয় পর্ব)

আমস্ট্যল ডাম থেকে আমস্টারডাম (দ্বিতীয় পর্ব)

জাদুঘর, হতাশা এবং শিথানের বালিশ

অডিও গাইড ডামস্কয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এই নগর কেন্দ্রে পাওয়া যাবে ডাচ রাজার রাজপ্রাসাদ। রাজ প্রাসাদের সামনেই খোলা চত্বরে কোথাও হারমোনিকার সুর, বেহালাবাদকের উপার্জনের থলে, চেয়ার পেতে অবকাশ যাপন আর কতরকমের বিকিকিনি! সেন্ট্রাল ষ্টেশনে যেমন দেখেছি, এখানেও তাই। বিভিন্ন জাতীয়তার সম্মেলনকেন্দ্র যেন। প্রায় ১৭৭ দেশের মানুষের বাস এই বহুজাতিক শহরটিতে।

ডামস্কয়ারকে কেন্দ্রে রেখে পুরো শহরে রয়েছে পুরনো আমলের উইন্ডমিল, চিজ মার্কেট সহ অন্যান্য মার্কেট, সেই সাথে মিউজিয়াম আর মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ভেতর ফান গখ বা ভ্যান গগ, রেমব্রান্ট বুঝতে চাইলে ভ্যান গগ মিউজিয়াম এবং রাইখস মিউজিয়ামে যাওয়া প্রশস্ত। রেমব্রান্টের নৈশ প্রহরী বা দ্য নাইট ওয়াচ হল মোনালিসার মত জনপ্রিয়। আবার শুধু ভ্যানগগের শিল্পকর্ম দেখতেই আমস্টারডামে অসংখ্য পর্যটক আসে। জীবদ্দশায় ভ্যানগগের মাত্র একটা শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছিল। হতাশা আর অর্থকষ্ট মিলে বিষিয়ে তুলেছিল জীবন। সে জন্য সাতত্রিশে এসে তার আত্মহননের পরাজিত সিদ্ধান্ত। মৃত্যুর পর তার সৃষ্টি বিশ্বব্যপী সমাদৃত হচ্ছে আজ অবধি। মানুষের পরাজয়ের অনুভূতি বড় তীব্র।

নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ল। একবার বিমূর্ত চিত্রকলার প্রতি মহাঝোঁক তৈরি হল। ঈদী, টিফিনের পয়সা জমিয়ে নানা কিসিমের রঙ কিনলাম। বড় আর্টপেপারে মগজের অস্থিরতা ফুটিয়ে তোলার নিবিষ্টতায় বেনানাস পায়জামাসের এপিসোডও মিস করেছি! মমিসিং অঞ্চলের এক ভদ্রমহিলা  কাজ করতেন আমাদের বাসায়। পাশের ফ্ল্যাটের বান্ধবী বুয়াকে `মায়া মায়া গো` করতে করতে বড় আফসোস করছিলেন। এই বাসার বড় আফা এহাবেহা বাতর (আঁকাবাঁকা ক্ষেতের আইল), হাগ (শাক)- কাউয়ার ঠ্যাংগ আর কি সব উমাইল্লা জিনিস আঁকে সারাদিন। এরচেয়ে আম কাডল আঁকলেও তো ভাল ছিল। কায়ালাইতে পারতাম । এই মন্তব্য শুনে জায়গায় হুতিয়ে পড়তে ইচ্ছে করেছিল। আমি অল্প প্রতিভার শখের শিল্পী। আমার হতাশার দৌড় হিতানে বালিশ পেতে ঘুমানো পর্যন্ত। বড় প্রতিভারা একটু এদিক সেদিক হলেই দেখি নিজেকে মাইরালবাম কুইটটালবাম এগুলি করতে চায়। উস্তাদি করে নেয়া যে কোন সিদ্ধান্তই গুরুতর ভুল।

                                ডামস্কয়ার

তবে আমি এক মহা উস্তাদের সর্বনাশা সিদ্ধান্তের ভুক্তভোগী কোটি মানুষের একজনকে খুঁজছিলাম এই শহরে।  মাদাম ত্যুসো, হিস্ট্রি মিউজিয়াম, স্টেডলিক মিউজিয়াম, রিজস্কিমিউজিয়াম, পানির ওপর দাঁড়ানো মেরিটাইম মিউজিয়াম ইত্যাদির ভিড়ে খুঁজেছিলাম আমি আনা ফ্রাঙ্ককে।

প্রজাপতি, হীরক রাজার দেশ 

`দ্য ডায়রি অফ আ ইয়ং গার্ল` এর আনা ফ্রাঙ্ক। আমস্টারডামের প্রিন্সেনগ্রাখট সংলগ্ন বাসাটিতে দুই বছরের বেশী সময় ধরে অন্তরীণ থাকা সেমিটিক মেয়েটি তাদের পতঙ্গের মত বেঁচে থাকা দিনগুলোর দিনলিপি লিখেছিল এখানে। জার্মানির ভাইমার আমলে ফ্রাঙ্কফুট আম মাইনে আনা ফ্রাঙ্কের জন্ম ও কিছুকাল বেড়ে ওঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর তীব্র  ইহুদীবিদ্বেষের কারণে ফ্রাঙ্ক পরিবার জার্মান নাগরিকত্ব হারায়। এর আগেই অবশ্য তারা আমস্টারডামে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪০ সালে আমস্টারডাম জার্মানির দখলে চলে গেলে কিশোরী আনা এবং তার পরিবার এই বাড়িটিতে ভীষণভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কালো কাপড়ের পর্দায় জানালাগুলো ঢেকে দেয়া থাকতো সন্ত্রস্ত মানুষগুলোর অস্তিত্ব লুকাতে। চিলেকোঠার একটা ঘর থেকে কেবল বিশাল আকাশের ছোট্ট একটা অংশ সবটুকু আনন্দ হয়ে ধরা দিত আনার চোখে। লিখেছিল আনা তাদের এই দুর্বিষহ জীবনের অনেকটাই। পালিয়ে বাঁচার বেদনাবিদ্ধ অনুভূতি।

                                                        ডায়রি টা

তারা ধরা পরে যায়। বার্গেন-বেলজান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন মার্গো ফ্রাঙ্ক মারা যায়। যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কিছুদিন আগে একটু একটু করে উড়তে শেখা প্রজাপতিটির খোলা আকাশের আনন্দের গল্প আর লেখা হল না।

পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য বাবা অটো ফ্রাঙ্ক পরবর্তীতে আনার ডায়রির খোঁজ পান। যুদ্ধবন্দী মানুষের বিষণ্ণ পৃথিবীর খোঁজ জানান স্বয়ং পৃথিবীকেই । ওলন্দাজ ভাষায় লেখা এই ডায়রিটি ইংরেজি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে দেখা কিংবা চিলেকোঠার জানালা দিয়ে আকাশ দেখা হয়নি আমার। বাসট্যুর কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা রাখেনি। বরং রেখেছে ডায়মন্ড মিউজিয়ামের হীরা কাটাকাটি দেখার ব্যবস্থা।

একটু বিরক্তি নিয়েই নামলাম। পাদুকাবিহীন পা নিয়ে হাঁটবো দেখে এমনিতেই বলছিলাম হীরক রাজার দেশ। এখন দেখি রূপক অর্থ মাঝেমধ্যে ব্যপক অর্থ বহন করে।

আমস্টারডামকে একসময় বিশাল হীরা বাণিজ্যের কারণে হীরার শহরও বলা হত। এই জাদুঘরে দেখানো হবে কিভাবে ধাতু ঘষে ঘষে হীরা বানানো হয়। সেক্টরে সেক্টরে ভাগ করা বিভিন্ন জায়গায় নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে গবেষকেরা এবং কারিগরেরা হীরা নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিল। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া কোন যন্ত্র তেমন পরিচিত লাগলোনা। চোখের সামনে দেখিয়ে দিল কেমন করে হীরা বানাতে হয়। ভবিষ্যতে কোনদিন যদি হীরার কারিগর হতে হয় এই আশঙ্কায় মন দিয়েই কাটাকাটি ছানাছানি দেখলাম। কারণ কোনখানে ছাই দেখিলে উড়াইয়া দেখিবার উপদেশ দিয়েছিলেন কবি। কবিরা চিন্তা ভাবনা ছাড়া কথা কম বলে।

                                    হীরা কাটা- ঘষার মেশিন

তারপর হীরার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্রের প্রদর্শনী ছিল। গলার হার, মাথার মুকুট, আঙটি, ঘড়ির মিলন মেলা। দেখলাম মানুষের মাথার একটা খুলি বানিয়ে রেখেছে হীরা দিয়ে। গর্জিয়াস কঙ্কালের পাটিতে আবার দাঁতও বাঁধিয়ে দিয়েছে। বোদ্ধাগণ নিশ্চয়ই এইসমস্ত অলঙ্কার, দাঁতাল খুলির কদর করবেন। আমি বোদ্ধা নই। দেখলাম অনেকেই যাইবার কালে কেনাকাটা করছে।

                                              এই যন্ত্রে হাত দেয়া নিষেধ

আনা ফ্রাঙ্কের বাসার বদলে সময় বাঁচিয়ে এখানে আনলে এই সুবিধাটুকু পাওয়ার অধিকার কর্তৃপক্ষের থাকতেই পারে। আমার মন আনা ফ্রাঙ্কের চিলেকোঠায় পড়ে থাকলেই বা কি আসে যায়!

জুতা কতক্ষণ হাতে নিয়ে, কতক্ষণ পায়ে দিয়ে আমস্টারডামের হীরা ঝিলমিল জাদুঘর পর্ব শেষ করলাম।

(চলবে)

প্রথম পর্বঃ https://bit.ly/2m8A5aY

শেষ পর্বঃ https://bit.ly/2N4d0S2


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ