বিবিধ

চিত্রল বার্লিন (শেষ পর্ব)

চিত্রল বার্লিন (শেষ পর্ব)
যে কথা বলতেই হবে
 
আমি যখন স্বদেশ ছেড়ে অন্যের দেশে আসছি তখন আমার এককালের জাতীয়তাবাদী হোমসিক পরবর্তীতে বিশ্ব নাগরিক তত্ত্বে আস্থা আনা পিতা বেশ কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটা ছিল আমি নতুন ভাষাটিকে এমনভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনি যেন গুন্টার গ্রাসের ভাষাতেই গুন্টার গ্রাসকে জানতে পারি। সিম্বোলিক আর কি। ভাষা প্রসঙ্গে আলাপ আরেকদিন করব তবে গুন্টার গ্রাস বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে এটা সত্য। সৈয়দ আবুল মকসুদ পড়তে গিয়ে দেখলাম উনি বলেছেন যে জার্মানির সাহিত্য জগতের অবস্থা ঢাকা কোলকাতার সাহিত্য বা সাহিত্য ধারণার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন; এরকম কেন্দ্রীভূত না। বরং সাহিত্য সমাজ গড়ে ওঠে বড় নগরীর বড় লেখককে কেন্দ্র করে। তার মতামত অনুযায়ী কোলোন যদি বোয়েলের হয় তাহলে হামবুর্গ হল সিগফ্রীড লেনযের, ফ্রাঙ্কফুর্ট এঞ্জেঞ্জবার্গারের আর বার্লিন অবশ্যই গুন্টার গ্রাসের।
 
গুন্টার গ্রাসের ৬৯ লাইনের "যে কথা বলতেই হবে" কবিতাটি আমার কাছে কালের অন্যতম শুদ্ধ বিপ্লবী উচ্চারণ। তরুণ বয়সে মহাযুদ্ধের সময় কিছুকাল জার্মান সেনাবাহিনীর সদস্য থাকার বিষয়টা তার ভেতর অনুতাপ এনেছে। মার্কিন সৈন্যদের হাতে বন্দীও হন। মহাযুদ্ধের বীভৎস স্মৃতির ছাপ তার অসংখ্য রচনায় আসে। কিন্তু হলোকাস্ট বিধ্বস্ত ইহুদীগোষ্ঠী আর আজকের জায়োনিস্ট ইজরায়েল যে দুইটা ভিন্ন জিনিস এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বা লিখতে গিয়ে তাকে নিজভূমেই ভাল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষত জার্মানদের অতিমাত্রায় ইজরায়েল তোষণের বিরোধিতা তিনি প্রকাশ্যেই করেছেন।
 
পঞ্চাশের দশকে স্বাক্ষরিত ক্ষতিপূরণ চুক্তি আজও দুই দেশের ভেতর বহাল আছে। প্রায় দুই লক্ষ ইজরায়েলির দ্বিতীয় পাসপোর্ট জার্মান। ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির ওপর ইজরায়েল সবচেয়ে বেশী আস্থা রাখে। নেতানিয়াহুর নির্বাচনী প্রচারণার সময় ফিলিস্তিনের বিষোদগার করা নিয়ে দুই দেশের ভেতর বেশ মতানৈক্য হয়। তা সত্ত্বেও জার্মান চ্যান্সেলর গত দশকে ইজরায়েলি সংসদে দেয়া বক্তব্যে ইজরায়েলের নিরাপত্তা ও জার্মান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পজেটিভ কোরিলেশন স্পষ্ট করেছেন। তবে গত কয়েক দশক ধরে চলমান মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইজরায়েলের চরম আক্রমণাত্মক অবস্থানের কারণে সাধারণ জার্মানদের ভেতর ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে। তারা ইজরায়েলি নীতির কঠিন সমালোচনা করছে।
 
 
                             দৈনিক প্রথম আলোর আর্কাইভ থেকে
 
২০১২ সালে প্রকাশিত "Was gesagt werden muss"অর্থাৎ যে কথা বলতেই হবে´র কয়েকটি লাইন (কবে যে একদম তুখোড় এবং ঝরঝরেভাবে গুন্টার গ্রাসের ভাষাতেই গুন্টার গ্রাসকে পাব!),
 
ঠিক এভাবেই বছরের পর বছর ধরে অতি সংগোপনে
যে ভূমিতে হচ্ছে পরমাণু শক্তির বুনোন,
বাড়ছে শক্তি
অথচ দেখছে না কেউ, শক্ত হাতে ধরছে না কেউ,
তাহলে সে ভূমির নাম মুখে আনতে আমার এত ইতস্তত কেন?
 
এত নিরব কেন সকলেই?
 
এই যে গণ নিরবতা - তার কাছে মস্তক লুটিয়েছি আমিও
একটা ব্যথা ভরা মিথ্যার কাছে সেজদা করেছি যেন;
আর সেই মিথ্যা আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে
অনিবার্য এক শাস্তির দিকে
..................................................................................................................
 
অথচ আমার প্রিয় স্বদেশ, যুগের পর যুগ ধরে
একটা জঘন্য পাপের প্রশ্ন বয়ে বেড়াচ্ছিল নিজের কাঁধে;
সত্যিই তার যেন তুলনা নেই;
তবুও সেই পাপ স্খলনের সমাপ্তি বিন্দুতে যেন
এসে পড়েছিলাম আমরা;
(যদিও ক্ষতিপূরণের জন্য এটা একটা বাণিজ্য বৈ ত নয়)
কিন্তু (সেই পাপের দিকেই আবার এগিয়ে চলেছে স্বদেশ)
আণবিক যন্ত্রপাতি বহনে একটা সাবমেরিন দিতে চলেছে ইসরাইলকে।
শুধু এই ধারনায় - পারমানবিক অস্ত্রের কোন প্রমাণ নেই সেখানে:
 
এই এখানেই বড় ভয় আমার!
 
                      (অনুবাদ- এ কে আজাদ)
 
নোবেল বিজয়ী এই সাহিত্যিক ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবি নিজের দেশের সমালোচনা করে বলেছিলেন, যে দেশের কাঁধে দুইটা বিশ্বযুদ্ধের বোঝা, তার কিভাবে উচিৎ হয় ইজরায়েলের কাছে ডুবোজাহাজ বিক্রি করা?
 
অবশ্য ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কট্টর ইহুদী পার্টির নেতা মিলে গুন্টার গ্রাসকে তীব্র নিন্দা জানিয়ে তাদের পবিত্রভুমিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, সফরে নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে তাৎক্ষনিক আলোকপাত করেছেন। কবিতাটির কারণেই মূলত তিনি ইজরায়েলে নিষিদ্ধ হন।
 
গুন্টার গ্রাস বার্লিনকে বলতেন যুগের বাস্তবতার নিকটবর্তী নগরী। বাস্তবতার কাছেই তার হয়ত তাই বসবাস ছিল জীবনের অনেকটা সময় ধরে। জীবনাবসানের বাস্তবতা অবশ্য তার বার্লিনের বাইরে ভিন্ন নগরীতে শেষ পর্যন্ত হয়েছে।
 
 প্রসঙ্গ: আরেকটু বার্লিন
 
১। নয়েকোলোন এলাকার মসজিদটা বার্লিনের সবচেয়ে বড় মসজিদ। প্রায় দেড় হাজার মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে। এই নামাজ পড়া নিয়েও বেঞ্জামিন- যারা বিস্মিত হয়েছে। নামাজ একটা কাজ এইটা মানুষ করবে। পড়বে (পড়ুন পরবে) কিভাবে? নামাজ কি পোশাক?
 
পাশেই একটা তুর্কি কবরস্থান। কবরস্থান মানুষের মন নরম করে ব্যপারটা খুব সত্যি। এত সুন্দর আবার এত সংঘাতময় একটা পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, আমার মস্তিষ্ক সময় নিয়ে নিয়ে অভিজ্ঞ হচ্ছে । কত রহস্য অপেক্ষা করছে কে জানে! তুলনামূলক ছোট ছোট কয়েকটা কবর আমার দুঃখবোধকে প্রবল করল।
 
                              নয়েকোলোনের মসজিদ সংলগ্ন কবরখানা
 
২। বার্লিনের বিখ্যাত চিড়িয়াখানার সামনে দিয়ে গেলেও বাঘ, ভাল্লুক, বাঁদরের নাচ অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে দেখব আল্লাহ চাইলে, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করে ভেতরে ঢুকি নাই।
 
৩। বার্লিনের চল্লিশটার মত বিশ্ববদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটা চোখের সামনে পড়েছে। একটু তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থেকে তাদের অতিক্রম করেছি।
 
৪। হামবুর্গ যদি হয় জলজ সবুজ, বার্লিনেও জল আছে তবে পুরনো সময়ের ইট পাথরের ঘ্রাণ আমার নাকে বেশী লেগেছে। বার্লিনকে কেমন সবুজ বলব? অশ্মজ সবুজ? উঁহু! ভাব আসছেনা।
 
৫। বার্লিনে কুকুরপোষা বেশ ব্যয়বহুল; মালিককে বাৎসরিক ১৫০ ইউরো কর দেয়া লাগে। তারপরেও কুকুর হাতে কত মানুষ দেখলাম!
 
৬। রাজধানী হওয়াতেই হবে হয়ত, জার্মানির অন্য রাজ্য বা শহর থেকে পথ ঘাট অত বেশী ঝকঝকে মনে হয়নি।
 
৭। তুরস্কের বাইরে এই শহরেই সবচেয়ে বেশী তুর্কি বাস করে। মোট ৩৪ লক্ষের ভেতর ১ লক্ষের বেশী তুর্কি। শহরের ১৫ শতাংশ বাসিন্দা বিদেশী। ডোনার এবং জার্মান সসেজ স্ট্রিট ফুড হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। (খাবার বিষয়ে আর বেশী কথা বাড়ালাম না। কিছু দুর্জন বলেছে আমার আরেকটা ভ্রমণ বিষয়ক লেখায় নাকি খালি খাওন আর খাওন ছিল)
 
বার্লিনের অস্তিত্ব আমার কাছে গ্রীষ্মের ঝিরঝিরে বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকে। এক পশলা বৃষ্টিও (অবশ্যই আমার বৈকালিক রোদ দের মত ডিসেন্ট, কোন উন্মাদনা নেই) কখনো কখনো এসে তাল মেলায়। শীতের বার্লিনকে আমি জানিনা। সব কিছু জানতে হবে এমন কোন কথা নেই। বার্লিন সবসময় এমন রৌদ্রময়ী হয়েই থাকুক।
 
 
প্রথম পর্বঃ https://bit.ly/2MipYvk
দ্বিতীয় পর্বঃ https://bit.ly/2lvqLO4

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ