পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )
“আয়না”

-আপনার কি বাবু হবে?
একটু অবাক হয়েই প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। বাচ্চা একটা মেয়ে, কলেজে টলেজে পড়ে হয়ত।
-এভাবে নুয়ে কাজ করবেন না তো! কি খুঁজছেন? আমি দেখি?
-মেয়ের ফিডারের ক্যপটা পাচ্ছি না!
-সরেন...
খুব চিন্তা করে সেজেছে মেয়েটা, সাজটা চোখে লাগে না, বুঝে নিতে হয়। সে সাজ ওকে উবু হয়ে খাটের নিচ থেকে আমাকে মেয়ের ফিডারের ক্যপ খুঁজে দিতে আটকে ধরলো না! পারতপক্ষে কারও সাহায্য নিই না। এজন্য কেউ সাহায্য করলে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে কথা পেঁচিয়ে ফেলি, শুধু বললাম, ‘তুমি ভালো মেয়ে!’ আমার কথার জবাব না দিয়েই শুরু করলোঃ
-কি করেন?
-ইঞ্জিনীয়ার
-তাই? আমি মেয়ে ইঞ্জিনীয়ার দেখতে পারি না...
-কেন?
-কেমন কাঠ কাঠ লাগে... মেয়েরা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়বে কেন?
এইবার আমার হাসার পালা, যে হাসিতে কোনদিন কার্পণ্য করতে পারি না! শুধু একটা ব্যপার ভালো লাগছিলো, অন্যদের মত, ‘’হিঁইইই, ইঞ্জিনীয়ার? তুমি এত্তো ব্রিলিয়ান্ট!!’’ বলে আদিখ্যেতা করছে না।
-তুমি বয়ষ্ক মানুষের মত কথা বলছ!
-তাই? আর আপনাকে দেখে অদ্ভুত লাগছে, কিভাবে যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করলেন?
-সমস্যা যে হয় নাই তা না, কিন্তু খুব জটিল কোন কিছু হয় নাই কখনও।
কথা বলতে ভালো লাগছিলো মেয়েটার সাথে। একটা দাওয়াতে এসেছি যেখানে মাত্র একজন মানুষকে চিনি, বাকিদের সাথে সাজানো হাসি দিতে হচ্ছে। বসে কথা বলার সময় কারও নাই। আর যারা পরিচিত মানুষ খুঁজে পেয়েছে তাদের আলোচনার বিষয়ে আমার জ্ঞান শূণ্যের কোঠায়। সুতরাং সবসময় যা করি, চুপচাপ তাকিয়ে অন্য মহিলাদের দেখছিলাম। মানুষ দেখা আমার খুব পছন্দের কাজ। যদিও মানুষ চেনার বেলায় আমি নিতান্ত মূর্খ। কোন একজনকে খুব পছন্দ হয়ে যায়, বাসার সবাইকে তার স্ট্যটিসটিকস মুখস্থ করিয়ে ফেলি, আর পরে দেখা যায় সেই মানুষটা আস্ত একটা দুই নম্বর। এজন্য আজকাল শুধু দেখি। এর মধ্যে মেয়ে ঘুম ভেঙে উঠেছে দেখে ওর মুখে ফিডার দিয়ে সরে বসতেই ফিডারের ক্যপ খুলে পড়ে গেছে। এই অজুহাতে এই মিষ্টি মেয়েটার সাথে পরিচয় হয়ে গেলো। ওকে অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম। এই বয়সটায় আমি একটু এইরকমের ছিলাম, এজন্য ওকে আলাদা লাগছিলো। মায়ের সাথে এসে একটু আলাদা বসে সবাইকে দেখছিলো।
-চাকরী করেন?
-হুম
-শশুরবাড়ির লোকজন ঝামেলা করে না?
-না তো! ওদের আর কাজ নাই? আমার চাকরী নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামাবে কেন?
-আপনি তো লাকি?
-তাই?
-আমি তো বিয়েই করবো না, কত শর্ত মানতে হয়...
-তাই? কেমন?
-এই যে, চাকরী করা যাবে না... সন্ধ্যার পর ফেরা যাবে না...যত্তোসব!
-জানো, আমার একটা কাজিন এইসব বলতো, এসবের জন্য বিয়েই করবে না। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে এমনই প্রেমে পড়লো যে এক্কেবারে কুপোকাত! এখন দিব্বী দুই বাচ্চার মা হয়ে সংসারী হয়ে গেছে।
-আপনাদের এ্যফেয়ার ছিলো?
- নাহ!
-কেন? ভার্সিটিতে পড়ে আবার এ্যফেয়ার থাকেনা নাকি কারও?
-ক্ষ্যত, না?
-অবশ্যই!
-কাউকে পছন্দ হয়নাই যে তা না, কিন্তু সাহস হয় নাই যে?
-কিসের সাহস?
-নিজে পছন্দ করলে পরিবারের সব্বাইকে রাজী করতে হত, গ্যঞ্জাম না? আমি এতো দায়িত্ব নিতে যাবো কেন? অবশ্য আমাদের বিয়েটাও একটু অন্যরকম ছিলো, আমার বড় বোন বলে এরেঞ্জড এ্যফেয়ার...
-তাই? বলেন তো!
-আব্বু আম্মু সব দেখে পছন্দ হবার পর আমাদের দেখা হয়। জানো, আমার পরের দিন পরীক্ষা! ক্ষেপে টেপে পচা জামা পরে বোনের বাসায় গেলাম। সে কিছুতেই ছাড়বে না। জোর করে ভালো কাপড় পরিয়ে ভদ্রলোকের সামনে পাঠিয়েছে।
-আপনি গেলেন কেন? আর গিয়ে কথা বললেন কেন? ভেংচি দিতেন?
-আরে রাখো না! দিয়েইছি তো! কাটাকাটা কথা বলেছি খুব। বোকা বেচারা, তার নাকি আমার ওই কথাই ভালো লেগেছে...
-কি বলেছিলেন?
-বললাম আর কি! সেমিস্টারের মাঝামাঝি সময়ে, যখন ক্লাস টেস্ট আর রিপোর্ট জমা দেয়ার ধুম, সেই সময়ে উনার আমাকে দেখতে আসা একদম ঠিক হয় নাই, আমার পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে।
-ভাইয়া কি ইঞ্জিনীয়ার?
-হ্যাঁ। এজন্যই তো এগুলো বলেছি, কারণ উনি বুঝবেন। কথাবার্তা শেষ করে এমন এক কান্ড করেছি এখনও ভ্যঙ্গায়!
-কি?
-বলেছি, মাথায় অনেক টেনশন, এর মধ্যে আপনার জবাবের অপেক্ষা করতে পারবো না। আমাকে পছন্দ হয়েছে? বেচারা ভদ্র মানুষ, চটপট মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এরপর নিজেই আইসক্রিম আর নুডলস বেড়ে দিলেন। আমি শুধু বসে বসে খেয়েছি।
এরপর আর পারলাম না, দুইজন হো হো করে হেসে ফেললাম।
-এরপর?
-আমি তো সমান তেজে ফেরত এসে আম্মুকে বললাম, চলেন যাই। দেখা তো করলাম। আম্মু আর আমার বোন চোখাচোখি করছে বারেবার। কিন্তু পরের দিন দুপুরে হঠাত খুব দেখতে ইচ্ছা করলো লোকটাকে। আজব চিন্তা! নিজের কাছেই খারাপ লাগছিলো, এভাবে হেরে যেতে। কিন্তু কিছুতেই সরল হাসিটা ভুলতে পারছি না। আমার দুলাভাই এর মধ্যে উনাকে ফোন করে বললেন আমাকে ফোন করতে। ভদ্রলোক মহাখুশী হয়ে ফোন করলেন। ভাব দেখালাম বিরক্ত হয়েছি, কিন্তু খুব ভালো লাগছিলো। এর প্রায় দুই মাস পর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে আমার বোন আমাদের নিয়েই শপিং করেছে। খুব ভালো লাগতো কাছাকাছি থাকার সময়গুলো! অন্য কারোর অনুপস্থিতিতে দেখা করার কথা মাথায় আসতো, কিন্তু সাহস করতে পারি নাই।
-তারপর?
-তার আর পর নাই রে আপু। যথারীতি কবুল।
-আপনার কষ্ট হয় নাই এডজাস্ট করতে? মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়েই বিয়ে? আর সে পরিচয়ও ‘লিমিটেড’?
-ভালো বললা তো? ‘লিমিটেড’... আর এডজাস্টের বিষয়টা তো যে কোন বিয়েতেই হয়, না? কারণ, তুমি নিজেকেই মনে কর। তুমি মেয়ে হিসেবে কেমন, বোন হিসেবে কেমন, ফ্রেন্ড হিসেবে কেমন এইটা জানো। কিন্তু তুমিই স্ত্রী হিসেবে কেমন এইটা তুমি জানো না। তোমার পারসোনালিটির একটা একদম অজানা দিক সেটা, চাঁদের উল্টাপিঠের মত। সুতরাং, বিয়ের পর কিছুদিন তোমার নিজেকে জানতেই চলে যাবে। সে সময়টা তো দুজনকেই এডজাস্ট করতে হয়, এমনকি অনেক দিনের চেনা হলেও।
-কিন্তু সবাই তো এক্সপেক্ট করে এক রাতের পরই নতুন দম্পতি এক্কেবারে সাইজ হয়ে যাবে, এই সময়টা কি কেউ দেয়? সেক্ষেত্রে আগে থেকে পরিচয় থাকলে তো একটু হলেও সহজ হওয়া যায়।
-তা ঠিক। তুমি আবার মনে কোর না আমি পছন্দ করে বিয়ের ঘোর বিরোধী। কিন্তু আমার কাছে ইমোশনাল ইনভলভমেন্টের বিষয়টা ভয় লাগে।
-মানে?
-মনে কর, তুমি কাউকে কিছুদিন হয় দেখছো, তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে এবং যাচাইয়ের বুদ্ধি আছে, তোমার তাকে ভালো লেগেছে। এখন তুমি বিয়ে করতে চাও। তুমি তোমার কাছের কাউকে জানালে এবং তোমার গার্ডিয়ান তার ব্যপারে খোঁজ নিলো, ভালো হলে বিয়েও দিলো। এইটাতে তো কোন সমস্যা নাই। কিন্তু এইটুকুতে কি কেউ থামে?
-আমি তার কি জানি? আমার কাছে বিয়ে মানেই বিরক্তিকর ব্যপার। আর আমি তো বিয়েই করবো না!
-অহ, ভুলে গিয়েছিলাম। জানো, এইটুকুতে তো সম্পর্ক থেমে থাকে না। আজকাল আমরা বাবা মাকে বা গার্ডিয়ানকে জানানোর আগে নিজেরাই একটু বাজিয়ে দেখতে চাই। তখনই ঝামেলা হয়। আবেগের শিকার হই এবং তার এমন কিছু বিষয়কে উপেক্ষা করি যেটা আসলে আমার জন্য উপেক্ষা করা ঠিক না। এবং বিয়ের কিছুদিন পর যখন সে আবেগ কমে আসে, সেই অসঙ্গতিগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। এজন্য এমন সময়েই গার্ডিয়ানকে জানানো উচিত যেন তাকে আমার গার্ডিয়ানরা অপছন্দ করলে আমি ফিরে আসতে পারি।
-বাহহ! যুক্তিটা আমার পছন্দ হচ্ছে।
-তাই? করবা বিয়ে?
-দেখি...
হি হি হাসার শব্দে পাপড়ির আম্মু এগিয়ে আসলেন। প্রাথমিক পরিচয়ের পর পাপড়ি বললো, এইবার আমি একটু সরে বসি আর তুমি উনাকে বল? ভদ্রমহিলা ভ্যবাচ্যকা খেয়ে গেলেন, কি বলবো?
-না মানে, ওই যে আমাকে যেন একটু বুঝায়, আমি যেন এই ইয়ার ফাইনালের পর বিয়েতে রাজী হয়ে যাই!
আমি আর থাকতে না পেরে হি হি হেসেই দিলাম। মেয়েটাকে খুব পছন্দ হয়ে গেলো হঠাত। খেতে ডাকছিলো, বাসায় ফেরারও তাড়া আছে। ঝকঝকে চোখের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি অন্য একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। পাশে আর একটা প্রাণচঞ্চল তরুণ আর মেয়েটার কোলে একটা মহাচঞ্চল বাচ্চা, ঠিক ওরই মত। ভাবনাটা বলতেই একটা মায়ের উজ্জ্বল মুখ আর প্রতিবাদী মেয়েটার চোখে একটু লাজুক হাসি দেখলাম। এভাবেই প্রতিবাদী মেয়েগুলো হয়ে উঠে আরও বড়, মহীরুহের মত, কোন একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভালোবাসা আর বিশ্বাসে।
আপনার মতামত দিন:
(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)