বিবিধ

বদলায়নি শুধু ঈদের চাঁদের বাঁকা হাসিটা

বদলায়নি শুধু ঈদের চাঁদের বাঁকা হাসিটা
২৮ রোজাতেই শুরু হতো জল্পনা কল্পনা, ২৯ রোজা নাকি ৩০ রোজা? পাশের বাড়ির  দাদুর হাঁকডাক, "ও সিপুর মা,  খবর নিছাও না?? সিপুগো ঐখেনে (মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশ) কি কালকে ঈদ?’ শহরের বুকে একটা পাড়া- মহল্লা, সেটাকে কিছুটা আধুনিক মফস্বলও বলা যেতে পারে, ‘তাই কালকে সৌদিতে ঈদ’ জাতীয় খবরগুলি ছড়িয়ে পরত দাবানলের আগুনের মতো। ২৯ রোজার ইফতার- কোন রকম খেজুর আর কিছুটা সরবত মুখে দিয়ে দে দৌড়, কেউ না আবার আমার আগে চাঁদ দেখে ফেলে!!!!! নিপা, পান্না অলরেডি দাঁড়িয়ে, সবাই চাঁদের অপেক্ষায়। চাঁদের দেখা নেই তো কালকে নিশ্চিত, একই সময় একই জায়গায়। ৩০ রোজায় দৌড়র গতি আরও বেশী, আজ নিশ্চিত!!! অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমাদের ফুল গ্যাং। সেই ক্ষেত্রে নিপাদের বাসা ছিল আমাদের হট স্পট। ছাদ ভাবলে ভুল করবেন, এই পাড়ায় কোন বিল্ডিংই নাই, সেখানে আবার ছাদ কীসের?? আমাদের চোখ থাকতো একটা প্রশস্ত প্রান্তরে, যেখানে আকাশ আর পানির মাঝে বাঁধা হয়ে থাকতো সবুজ ঘাসে জড়ানো এক চিলতে মাটির রাস্তা। অবশেষে দেখা গেলো চাঁদের হাসি। দেখার সাথে সাথে শুরু হল পান্নার হেরে গলায় গান... তো নিপার মুখ থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার মতো কৌতুক, হামিমের মিনমিনে স্বরের বন্ধুসুলভ টিপ্পুনি। তো সোনিয়ার মুখে হাত দিয়ে হাসা, সেই সাথে বউটির বত্রিশ দাঁতের ঝলক, আর এদের সবার মাঝে, একটিভিটি কম আর সবচে বেশী হাসি এক্সপার্ট ছিলাম আমি। পাড়ার ডানপিটে ছেলে গুলোরও আনন্দের শেষ নেই, ‘চাঁদ উঠছেরে…’  বলে অদ্ভুত অঙ্গ ভঙ্গিমার নাচ। পাশের বাড়ির কাকা ফুল ভলিউমে টিভি ছেড়ে শোনাতেন, "ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ"। মাগরিবের নামাজ সেরে, আবারো দে দৌড় নিপাদের বাড়ি। ঘরে একটা ডেক সেট থাকা তখন নতুন ট্রেন্ড- ঘরোয়া বিনোদনের এক মাত্র বস্তু। ডেক সেটের চড়া ভলিউমে গান চলছে এক খালাম্মার বাসায়, আমাদের মধ্যে কোন একজন খালাম্মার বাসায় উঁকি দিয়ে, ইশারায় আমাদের ডাকলো, দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে প্রচণ্ড কষ্টে হাসি চাপালাম। খালাম্মার সে কি নাচ, এদিকে হাসি আটকে রাখতে রাখতে আমাদের পেটের অবস্থা টাইট!!!! যেই না খালাম্মার চোখ পড়ল, আড়াল থেকে তাকানো পাঁচ ছয় জোড়া চোখের দিকে, মধ্যবয়সী খালাম্মা লজ্জায় মুখ ঢাকলেন ঠিক নতুন বউটির মতো, আর আমাদের মাঝে পড়ে গেল দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হাসির রোল। তারপর শুরু হতো মেহেদী রাত, সেই সাথে ঈদের দিন পাড়া চষে বেড়ানোর প্ল্যান, আর হা-হা হি-হি তো আছেই। শৈশবে হাতে মেহেদী পড়াতেন মা, আর কৈশোরে আমার সামনে লাইন ধরত আট নয়-টি হাত। তার উপর আবার ছোটখাটো একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, ঈদের দিন রাতে অথবা ঈদের পরের দিন। দর্শক?? পাড়ার বাকি মেয়ে-মহিলারা। সেটার রিহার্সেলটাও কি কম হ্যাপা !!!! সেই চাঁদ রাতগুলো এখন স্মৃতি, প্রশস্ত প্রান্তর থেকে আটকে গেলাম একটা জানালায়, যেখানে দাঁড়িয়ে একা একা চাঁদ দেখা। আর এখন... ইফতার করতে করতে, কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এবং অদ্বিতীয় ঈদের গানটি কানে আসলে বুঝি, ‘যাক বাবা কালকে ঈদ’। প্রথম প্রথম ভাবতাম, বয়স আর জীবনের গল্পে পরিবর্তন, এই দুয়ে মিলে খেয়ে ফেলে শৈশব কৈশোরের দিনগুলোকে। কিন্তু এর সবটাই কি ঠিক??? এই সময়ের কৈশোরে থাকা মানুষ গুলোর মাঝে, দল বেঁধে হই হই রই রই দেখি না, সোশ্যাল মিডিয়াতে গ্রিটিংস আর ফিল্টার দিয়ে তোলা কিছু সেলফি আপলোড করেই যেন দায় সার। পাড়া প্রতিবেশীরা তো দূরের কথা খালাতো, মামাতো, ফুপাতো, চাচাতো ভাই বোনেরা একসাথে হয়েও, মোবাইল হাতে সকলেই যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ওরা জানেই না ছোট্ট একটা খাটে গাদা গাদি করে বসে, কীভাবে অট্টহাসিতে প্রতিবেশীর কান ফাটাতে হয়। আর আমাদের সেই ফিমেইল গ্যাং? সবাই যেন কোথায় কোথায় ছড়িয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।  দুই একজনের দেখা মিলে, মোবাইল অথবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে, সেও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। আমাদের মফস্বল টাইপের পাড়াটাতেও এসেছে অনেক রদবদল, সেখানে এখন দেখা যায় বেশ কিছু দালান, হই হই করার মতো ডানপিটে ছেলে গুলো আর নেই, নিপাদের বাড়িটাতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি, আসেনি আমার দাদার বাড়িতেও, দল বেঁধে নৌকায় চড়ার উৎস ওই টলমলে পুকুরটা এখন পিচ ঢালা তিনশো ফিটের রাস্তা। বদলেছি আমিও, যেখানে কাটিয়েছি আমার জীবনের প্রথম পনেরটি বছর, সেখানে এক সপ্তাহ না যেতে পারা ছটফট করা সেই আমি, এখন অনায়াসে সয়ে নিতে পারি এক বছর সেই পাড়ায় না যাওয়ার যন্ত্রণা। বদলায়নি শুধু ঈদের চাঁদের বাঁকা হাসিটা!

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ