পরিবার ও আমি (বিয়ে ,দাম্পত্য,শিশু লালন পালন )

পরিবার-পর্ব ২

পরিবার-পর্ব ২
"কালকেও না এই রুমের সব ফার্নিচার মুছলাম, আজকেই এত ধুলা?"..... অথবা "আমার খালাটা পায়ে ধরলেও জানালার গ্রিলগুলো মুছবেনা".. এমন কোন ঘরনি আছেন যিনি সংসারজীবনে একবারও এমন আফসোস করেননি? বাসায় সাহায্যকারী নেই অথবা উনারা থাকলে “মন মত” কাজ করেননা, কথা শোনেননা- এই দুই ক্ষেদেই আটকে আছে আমাদের জীবন। আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি এবং মোটামুটি ভাবে ঘরের সাহায্যকারীদের উপর বেশ অনেকখানি নির্ভরশীল তাদের জন্যই বলা এই কথাগুলো। পেপার-পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে প্রায়ই দেখি অমুক মেশিন কিনলে মেইডের ছুটি, তমুক যন্ত্র ঘরে আনলে আপনি ফ্যানের বাতাসে চুল উড়িয়ে খালি বইই পড়বেন! এমন কোনো ম্যাজিক যে আসলে কতটা অবাস্তব সেটা আমাদের চেয়ে আর কে বেশি জানবে? কিছু কিছু কারণে আমি এই বিষয়টা কিভাবে সামলাই সেটা নিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হই প্রায়ই। অনেকদিন ধরেই তাই এই লিখাটা লিখার ওয়াদা নিজের সাথে। আমি আমার একেবারে নিজস্ব কিছু প্র্যাকটিসের কথা বলবো যেগুলো আমি অনেকদিন করে আসছি হয়তো আমার আম্মুকে করতে দেখেছি বলে বা বহুকাল থেকে করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে। যারা পড়ছেন তাদের কোন জ্ঞান দেয়ার মত অত বড় বিশারদ আমি না। সাজানো ঘর আর গুছানো ঘরের মধ্যে অনেক বড় একটা ফারাক আছে। সাজানো ঘর হয় সাজানোর জিনিস দিয়ে- শোপিস, চকচকে আসবাব বা দামী আপহোলেস্টারি (চাদর, পর্দা, ম্যাট ,রানার, ইত্যাদি) দিয়ে। আর গুছানো ঘরে একেবারে আটপৌরে আসবাবেও পরিপাটি হয় সবকিছু। সব সাজানো ঘর গুছানো হয়না, কিন্তু সব গুছানো ঘর সাজানো হয়! ঘর পরিচালনায় প্রথম যা দরকার তা হল রুটিন বা প্ল্যান। সারাটা ঘর- সারা পরিবারের সব কাজ আমি সাহায্যকারীর উপর প্ল্যান ছাড়া ছেড়ে দিলে ওরা কেন আমরাইতো কনফিউসড হয়ে যাবো। আমার বাসায় রান্নাঘরের ম্যানেজার “আখি”- ওকে আমি একটা রুটিন করে দিয়েছি। সপ্তাহের ৭ দিনের মোট ৩৫ বেলার খাবার আর ৭ দিনের কিচেনের পরিষ্কারের ছকটা ওর খুব পছন্দের। আর আমার ঘরদোরের কাজের জাদুকর “নুপুর”- ওকেও আমি রুটিনে অভ্যস্ত করেছি আল্লাহর রহমতে। আমার এই রুটিনটা মূলত একটা স্কেলেটন। মূল কনসেন্ট্রেশনটা এই রুটিনে দেই কিন্তু সাইড আরো কিছু কাজ কিন্তু করাই লাগে। যেদিন যেই রুম সাফাই করি সেই রুমের সব ফার্নিচার, ম্যাট/ রানার, তোষক, সোফা, ইত্যাদি ঝাড়া মোছা করি আর বাকি রুমগুলো শুধু সারফিশাল সার্ভিস (উপরে উপরে গুছানো) পায়!   আমার দ্বিতীয় ট্রিক হল আমাদের চা টাইম। আমার মেয়েরা সবাই সকালে অন্যান্য জায়গায় চাকরি করে (স্কুলে, হসপিটালে) আর বিকালে আমার এখানে আসে। তাই ওরা অলরেডি টায়ার্ড হয়ে আসে এখানে। ওরা আসার সাথেই সাথেই আমরা ৩ জনে মিলে বসে (একসাথে মাটিতে পা ছড়ায়ে) চা- বিস্কুট খাই। আধঘণ্টা রেস্ট নেই আর গল্প করি। তারপর কোমর বেঁধে নামি ৩ জনে মিলে। বিশ্বাস করেন, এই চা টাইমটা আমাদের জন্য এত আনন্দের আর ফায়দার যে আমরা কিছুর বিনিময়ে এটা মিস করিনা। সারাক্ষণ অর্ডার, শাসন আর ধমকের বিনিময়ে ওরা ‘কাজের লোকই হয়, বন্ধু হয়না। চা খাওয়া হলে সবাই মিলে ছকে বাঁধা কাজ শুরু করি। ওরা যদি ঘন্টায় ৩ মেইল বেগে ছুটে তাহলে আমি ছুটি ৫ মাইল বেগে। এই সম্পর্কটার ব্যাপারে অনেক আগে একটা কথা শুনেছিলাম, ‘পাতের ভাতটা তুলে খাওয়ালেই হাতের কাজটা তুলে নিয়ে করবে’। আমি এটাতে বিশ্বাস করতে চাই। ইসলামিক ভাবে ভাবলেও আমরা নিজে যা করিনা তা অন্যকে করতে বলতে পারিনা। আমি নিজে টিভি দেখছি, ফোনে কথা বলছি বা বাচ্চাকে পড়াচ্ছি আর চিৎকার করে করে ফরমায়েশ দিচ্ছি তাহলে কাজ যা চাই তার ৫০% হবে আর বাকিটা ওরা চলে গেলে ওদেরকে গালি দিব আর নিজে করবো। সকালে বা বিকালে যখনি আপনি আপনার ঘরের বড় কাজের ড্রাইভ দিবেন (আই মিন, যখন আপনার সাহায্যকারীরা আসবে) তখন আপনাকে থাকতে হবে ড্রাইভারের ভুমিকায়। আমি যেদিনগুলোতে বাসায় থাকিনা সেদিনও ওদের কাজগুলো খাতায় লিখে দিয়ে যাই যেটা দেখে ওরা সব করে আর টিক দিয়ে যায়। রাতে এসে আমি আমার মতন একটা ফিনিশিং টাচ দেই। কাজে ফাঁকি ওরা তখনি দেয় যখন আমরা পাশে থাকিনা বা ওই কাজটা নিজেও হাত লাগিয়ে করিনা। মেয়েরা কাপড় ধোওয়ার সময় ৫৫ বছর বয়সে এখনও আমার আম্মু একটা পিঁড়ি নিয়ে বসে কলার, নিচের বর্ডার, বেশি ময়লার জায়গাগুলো ঘষে দেন। আমার মেয়েরা ঘর মোছার সময় আমার লাস্ট মোমেন্ট দৌড়ে, ওদের সাথে গুছানো বা কিচেনের রান্না চড়ানোর পরের কিচেনের তালু থেকে পা পর্যন্ত মোছামুছি দেখে আফসোস করে প্রতিদিন- ওদের ভাষায় আমি নাকি ১০ জন লোক থাকলেও শান্তিতে থাকবোনা! আমার পরের ট্রিক হল, জব ডিস্ট্রিবিউশন। ঘরের মা (গৃহিণী) এক হাতে সব করতে পারেন, ম্যানেজাররা এভাবে পারেনা বা করবেনা। আর করলেও তার মান আপ-টু-দা-মার্ক হবেনা। একের অধিক লোক থাকলে তাদেরকে কাজের এরিয়া ভাগ করে দেয়া উচিত বা একজনই করলে তাকেও দিন হিসেবে এমনভাবে রুটিন করে দেয়া উচিত যাতে তার নিজের কাছেও তার কাজের যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকে। ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনেরা সত্যি সত্যি সন্দেহ করতাম আমাদের আম্মু মনে হয় আমাদের মা না, সুখি/ জরিনা আপুর মা! কারণ ওরা যখন কোন কাজের ভিতর থাকতো তখন ওদেরকে আমরা ছোটরা কোনদিন কোন কাজের ফরমায়েশ দিতে পারতামনা। আম্মু বলতেন ওরা নাকি বার বার ডাকলে কোয়ালিটি কাজ দিতে পারেনা। আজ এত বছর পরে নিজের সংসারে এসে বুঝি আম্মু দুইটা টার্গেটে আমাদেরকে এই শাসন করতেন- আত্বনির্ভরশীল হওয়ার সাথে সাথে আমরা যেন বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ডদের কাজের ব্যাপারেও সম্মানজনক আচরণ দেখাই। প্রায়োরিটি বুঝেন প্রায়োরিটি? আমি এমন অনেক বাসা দেখি প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশিবার রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাচ্ছে, বাচ্চাদের খেলনা কিনছে অথচ তার অর্ধেক খরচে একটা এক্সট্রা মানুষ রাখাকে বলছে ‘সামর্থের বাইরের’ কাজ। আমার মাসে ৫ দিন বাইরে খেলে যেই আনন্দ হবে তার চেয়ে অনেক বেশি তৃপ্তি পাবো যদি দিনের শেষে একটা পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন ঘরে বসে চায়ে চুমুক দিতে পারি। আমি অন্তত শেষেরটাকেই প্রায়োরিটি ভাবি। আমার আম্মু বলতেন, ‘আমাদের ঘরই তো আমাদের রেস্টুরেন্ট – একেকদিন একেক বারান্দায়, একেক রুমে সবাই মিলে খাব আর গল্প করবো’। নিজের ছেড়া ম্যাক্সিটা ফেলতে যাকে বার বার বলতে হত সেই আম্মুকে আমরা সারাজীবন দেখেছি নানাদিক থেকে খরচ বাঁচিয়ে হেল্পিং হ্যান্ড একের অধিক রাখতে যেন ঘরবাড়ি তকতকে থাকে আর ওদের একজনের উপরেও প্রেশার বেশি না পড়ে। ঘরের সাহায্যকারীদের (আসলে আমার নিজেরই) কাজের আরাম করে দেয়ার আরেকটা অনেক ইম্পরট্যান্ট ফ্যাক্টর হল মেন্টেইনেন্স। আমরা ঈদ/ শবে বরাত বা মেহমান আসলে যেভাবে নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে ঘষে মেজে ঘরের নাম- ঠিকানা বদলে ফেলি সেই কাজটা রেগুলার বেসিসে করলে কিন্তু কখনই কাজ জমেনা। নখ বড় হলে যেমন প্রতি সপ্তাহেই যেমন কাটি, তেমনভাবে বাসার ফার্নিচার, কাপড়-চোপড়, খাটের তলা, আলমারির চিপা, বারান্দার কোনা নিয়ম করে রেগুলার বেসিসে পরিষ্কার করা ইদ আসলে নতুন সোফা- নতুন কুশন কেনার চেয়ে অনেক বেশি ফায়দার। নতুন কেনা অনেক দামী আর মডার্ন একটা সোফার পাশের আলমারির ভেতরটা বই, কাগজপত্র আর ক্রোকারিজে গোলমাল বেঁধে থাকলে কি হয়? আমার চোখটা আসলে আগে ওই আলমারির ভেতরেই পড়বে। “Do it today as if there is no tomorrow..” এই কথাটার কঠিন সাপোর্টার আমি। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার বাসায় কখনই এমন হয়না যে কোন চিপায়/ কোনায়, খাটের নিচে বা কোন আলমারির ভিতরে ময়লার বাসা জমে আছে। আমার বাসার সব জায়গা রুটিনমত সমান মনোযোগ পায়। প্রতিদিন সকালে কিচেনে ঢুকার আগেই যদি ফ্রিজটা খুলে একটু গুছিয়ে নিয়ে আগের দিনের সব কিছু বের করে খেয়ে/ খাওয়ায় ফেলেন তাহলে কোন ঘরে খাবার নষ্ট হতে পারে? সবার শেষে বলবো, ওদের ভরপুর প্রশংসা করেন। আমি যখন আঁখিকে আর নুপুরকে প্রশংসা করি ওরা যে খুশিতে কি গদ্গদ হয়ে যায় সেটা বলে বোঝানো যাবেনা। এই কারনে ওরা সবসময় আরও ভালো করার চেষ্টা করে আর ওরাও আমার ভালো কাজ/ ভালো আচরণের উদার প্রশংসা করে। এমন বহুদিন হয়েছে যে আমি আমার নিজের করা একটা ভালো রান্না বা কাজের ক্রেডিট সবার সামনে ওদেরকে দিয়েছি আর গোপনে ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা দেখেছি। পরিশেষে, ঘর সাজানো গুছানো নিয়ে আলোচনা কিন্তু আমার আজকের টপিক ছিলনা, কোন ফার্নিচার কথা থেকে কিনেছি, আমার ফ্রিজ কোন ব্র্যান্ডের এই আলোচনা আমার বড়ই অপছন্দের। আমি লিখেছি আমরা কিভাবে আমাদের ও আমাদের বাসার সাহায্যকারীদের কাজকে আমাদের জন্য এবং তাদের জন্য সহজ করতে পারি আর কিভাবে তাদের সময় এবং প্রচেষ্টার সর্বোচ্চ ব্যাবহার করতে পারি। একটা ছনের ঘরকেও আমি গুছিয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখলে বহু পশ শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ীর তেল চিটচিটে রান্নাঘরের চেয়ে হাজার গুনে সুন্দর লাগবে। ভালো থাকবেন, পরিচ্ছন্ন থাকবেন- পরিপাটি রাখবেন। (I would highly appreciate any question/ query/ constructive criticism regarding the piece of writing)  
ডেইলি   পরিষ্কারের    কাজ স্পেশাল পরিষ্কারের কাজ
শনিবার দুই বেডরুম সব দরজা, জানালা
রবিবার অফিস রুম গাছ পাল্টানো   (ঘরের গাছ বারান্দায় আর ভাইস ভারসা)
সোমবার ডাইনিং রুম কাজ
মঙ্গলবার ড্রয়িং রুম বাগান, বারান্দা, পর্চ পরিষ্কার
বুধবার বাথরুম ২,৩ মেয়ের টিফিনের সাপ্তাহিক কাজ (কিমা/মোমো/ কাপ কেইক/ পিজার টপিং/আর যা যা পারি)
বৃহস্পতিবার আলমারি+শেলফ (ভেতরগুলো মোছা) সব পাপোষ, ডাস্টিং এর তোয়ালে, চাদর ধোয়া, পাল্টানো
আগের পর্বঃ https://womenexpressbd.com/microcosm/the-family-and-i-marriage-conjugalchild-rearing/%E0%A6%95%E0%A6%A8%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A7%A7/

আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ
আমার ডিভাইস ভাবনা

আমার ডিভাইস ভাবনা

২২ জানুয়ারী ২০২৪

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ

২৮ ডিসেম্বার ২০২৩

আমার বাচ্চা খায় না!!????

আমার বাচ্চা খায় না!!????

২৪ ডিসেম্বার ২০২৩

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

আক্রমনাত্মক দাওয়াহ!!!

১৩ ডিসেম্বার ২০২৩