বিবিধ

বইয়ের পাতার কলকাতায় আরও একবার....

বইয়ের পাতার কলকাতায় আরও একবার....

‘২১শে মার্চ ফ্লাইট? কোথায় যাচ্ছেন?’

আমি: ‘ কলকাতায়’

‘কলকাতায় কি শপিংয়ে?’

আমি: ‘না, ঘুরতে।’

৩২ দাঁতের মুক্তোঝরা হাসিটা নিমেষেই মিলিয়ে গিয়ে, চোখ চরক গাছে তুলে, প্রশ্ন করলেন, ‘ঘুরতে???

কলকাতায়??? কলকাতায় ঘুরার জায়গা আছে নাকি?’

আমি: ‘আছেতো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রবীন্দ্রসদন, কলেজ স্ট্রিট, প্রিন্সেপ ঘাঁট……; আমারতো আরও ইচ্ছা ছিল শান্তিনিকেতন আর কাশী ঘুরার’

চেহারায় তখনও প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে, ‘ও ও ও’

এমন অবস্থা শুধু একজনের নয়, অনেকেরই হয়েছিলো। 

আমার এই লেখাটা কোন শহরের খুব ইনফরমেটিভ ইতিহাস না, একটা শহর ঘুরে আসার, যত্নে রাখা তুলতুলে নরম কিছু অনুভূতির কথা।

এটা আমার প্রথম কলকাতা সফর নয়। মুহতারাম যাবেন মুম্বাইয়ে, একটা ট্রেনিং সেশনে। টিকিট কাটতে গিয়ে ফোনে বললেন, ‘কলকাতায় যাবা? আমি মুম্বাই থেকে কলকাতা আসব, আর তুমি বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসবা’

আমি বললাম, ‘মানে কি???’

‘তোমারতো প্রথম বারে কলকাতা ঘুরা হয় নাই, আবার ঘুরবা বলছিলা, টিকেট কাটলাম।’

হোক না সেটা কলকাতা, বাংলাদেশ থেকে দুই পা, কিন্তু আমারতো প্রথম একা সফর, তাই বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি মা আর মহা উচ্ছ্বাসে টিকেট কাটা ভদ্রলোকের উৎকণ্ঠার শেষ ছিলোনা। বোর্ডিংয়ে অপেক্ষারত অবস্থায় পরিচিত হলাম এক নতুন মানুষের সাথে, কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের জীবনের বেশ কিছু ব্যাপার খুব কাকতালীয়ভাবে মিলে গেলো, দুজনেই বেশ মজা পেলাম। 

অবশেষে প্লেনে থেকে পা ফেললাম ‘নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু’ এয়ারপোর্টে।

ঘুরা শুরু হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দিয়ে, আগের বার গিয়েছিলাম কিন্তু ভিতরটা ঘুরতে পারিনি। তাই এবার শুরু করলাম বেশ সকাল সকাল। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল প্রকাণ্ড এক বলরুম, যার মাঝে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার বিশাল এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে দাড়িয়েই পুরো প্রাসাদটাকে পরখ করে নেওয়া যায়। মনে হচ্ছিলো কোন ব্রিটিশ পিরিওডের, সিনেমার শুটিং-এ দাঁড়িয়ে আছি, এখনই কোন ‘ballroom dance’-এর শুট করা হবে।

বল রুম ঘিরে রাখা আছে, বেশ কিছু সংরক্ষিত জিনিস, তার মাঝে প্রাচীন যুগের পবিত্র কুরআন এবং তৎকালীন মুসলিম কবিদের কিছু লেখনী অন্যতম। হল থেকে বের হয়ে হাতের বা দিকের মিউজিয়ামে আছে অসম্ভব সুন্দর কিছু পেইন্টিং, চোখ পড়লেই মনে হবে আমি ওই সময়েরই একজন। ডান দিকের মিউজিয়ামে আছে সমগ্র কলকাতার ইতিহাস। এই মিউজিয়ামটা ঘুরতে ঘুরতে একটা পর্যায়ে সত্যিই  মনে হচ্ছিলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘সেই সময়’-এ হারিয়ে গিয়েছি।

এবার ঘুরার পালা ‘রবীন্দ্র সদন’ যার আর এক নাম ‘রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’। পুরো বাড়িটাকে এক কথায় বলা যেতে পারে, আধুনিক একটি জমিদারবাড়ি। বাড়ির মাঝের খোলা জায়গাটিতে দাঁড়ালে মনে হবে, সংসারের সকল কাজ সেরে, পান চাবাতে চাবাতে, এই বুঝি রমণীরা এলো, একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে!!!

সমগ্র বাড়িটায় এত এত দেখার জিনিস, যা লিখে শেষ করার মত নয়। ‘আমি রবি ঠাকুরের বউ’ বইটি পড়ে, আমার খুব ইচ্ছা হয়েছিল এই বাড়ির আতুর ঘরটি দেখার, ঘুরতে ঘুরতে পেয়েও গেলাম। এই আতুর ঘরটাকে ঘিরে মৃণালিনী দেবীর অবর্ণনীয় কষ্টের কথাগুলো মনে পড়ছিল। মৃণালিনী দেবীর কক্ষটিও দেখেছিলাম একটু সময় নিয়ে। খুব অল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে আসা একটা মানুষের চরম মানসিক যন্ত্রণাগুলো যেন আজও গুমরে গুমরে কাঁদছে এই কক্ষে। ‘কবি’ রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন সেটা আলাদা ভাবে বলার কোন অপেক্ষা রাখেনা, কিন্তু ‘স্বামী’ রবীন্দ্রনাথ কে নতুন করে চিনেছি, এই উপরে উল্লেখিত বইটি পড়ে, যা অন্তত আমার মাঝে একেবারেই কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেই কক্ষে বসে লিখতেন এবং বহিরাগতদের সাথে সাক্ষাত করতেন, কেন যেন মনে হলো এই কক্ষটিতে প্রকৃতি উপভোগ করার সুযোগ কিছুটা কম।

রবীন্দ্র সদনে ঢুকতেই পরিচিত হই, চমৎকার একজন মানুষের সাথে। শুধুমাত্র শেকড়ের টানে, একজন মানুষ আর একজন মানুষকে এত কাছে টানতে পারে, আমার জানা ছিলোনা। আমি তার দাদার বাড়ির ভিটের দেশের মানুষ, তাই এত ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, যেন আমার মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই অদেখা ভিটে। আমার আশেপাশে কত মানুষ দেখেছি, যারা দুই কদম বিদেশী ধুলো পাড়িয়ে, হয়ে যান বিদেশী, আর মাতৃভূমি কে করে ফেলেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ডাস্টবিন।

এবার দৌড় কলেজ স্ট্রিটে। এ যেন ঠিক  আমাদের নীলক্ষেত। একটা পাবলিকেশনে ঢুকতেই এক ঝাঁক বই আমাকে ঘিরে ধরল। কোনটা ছেড়ে কোনটা নিবো!!!! আর আমার পাশেতো একজন আছেনই,  ‘এটা নাও, ওটা নাও’ বলার জন্য।

কলেজ স্ট্রিট থেকে কিছুটা পথ, তার পর কফি হাউস। কলকাতা ঘুরার একটি প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘কফি হাউস’। যদিও সেখানের খাবার খুব একটা প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেনি, তবুও এক কাপ কফিতো খেতেই হয়!!! যতক্ষণ ছিলাম মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুধু কফি হাউসটাকেই দেখেছি আর ভেবেছি, মান্না দে যথার্থই গেয়েছিলেন।

সারাদিন ঘোরা ঘুরির খোরাক ছিল কোলকাতার স্ট্রিট ফুড, কোনটা আবার খাইনি!!! পাপড়ি চাট, পানি পুরি, মোমো, পাউ-ভাজি, রাজ কচুরি, ধোকলা, ছোলা ভাটোরা, স্পেশাল চউমিন...... নিম্বু পানি আর কেসর কুলফি কতবার খেয়েছি তার হিসাব নেই। কলকাতায় যাবো? আর কোলকাতার রসগোল্লা খাব না??? তা কি হয়??? সেটাও চললো। তবে এত সব ধরে ধরে চিনিয়েছেন আর প্রথমবার অনেক ভালোবাসা নিয়ে খাইয়েছেন একজন বড় ভাই আর আপু। মূলত তাদের হাত ধরে কলকাতাকে প্রথম চিনেছিলাম।

সব শেষে কিনতে হল একটা ল্যাগেজ। কেনা শেষে দোকানদার মশাই, মহানন্দে বললেন, ‘ম্যাডাম! কুয়েস্ট মলটা কিন্তু ঘুরে যেতে ভুলবেন না, সেইরকম মল, আর সেই রকম জিনিস, শপিং করে কুল পাবেন না...... স্যার, ম্যাডামকে কিন্তু অবশ্যই নিয়ে যাবেন’।

স্যার মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘ম্যা ডাম শপিং করতে আসেন নাই ঘুরতে এসেছেন’।

কুয়েস্ট মল-এ আর যাওয়া হয়নি, সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। তবে আক্ষেপ ছিল, আরও কিছুক্ষণ রবীন্দ্র সদনের প্রধান বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ডান দিকের মিউজিয়ামে দাঁড়িয়ে লাইন বাই লাইন ইতিহাস পড়ার, কলেজ স্ট্রিটের আরও কিছু বইয়ের দোকান ঘুরার, আগের বার ঘুরে আসা প্রিন্সেপ ঘাটে নৌকায় চড়ার আর ব্রিটিশ শাসনামলের সমগ্র ভারতবর্ষের রাজধানীটার আরও অনেক অদেখাকে দেখার।  


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ