উইমেন (সামাজিক,মানসিক,সুবিধা বঞ্চিত নারী)

জেন্ডার স্টাডিজ – ৪

জেন্ডার স্টাডিজ – ৪

'পুরুষ' বা 'নারী' মানুষ নয়, এক একটি কনসেপ্ট, ধারণা। চারদিকে তাকিয়ে দেখেন, এক এক সভ্যতায় এই কনসেপ্ট এক এক রকম। এমনকি একই সভ্যতায়, এক এক পরিবারে এই কনসেপ্ট আলাদা হতে পারে। এবং, একই পরিবারে এই কনসেপ্ট এক এক সন্তানের জন্য এক এক রকম হতে পারে।

আমি এই তিন দশকের জীবনে শুধু একটা সাধনা করে যাচ্ছি। সেটা হল, নিজেকে শ্রদ্ধা করা। এটা সম্ভবত আত্নপূজা নয়, বরং খুঁড়ে খুঁড়ে নিজের মধ্যে শ্রদ্ধাযোগ্য বৈশিষ্ট্য বের করা। নিজের ভুলে নিজের কাছেই প্রচন্ডভাবে লজ্জিত হওয়া। এই শ্রদ্ধা আদায়ের যাত্রায় আমাকে আরও একটা কাজ প্রতিনিয়ত করতে হয়। চারপাশের প্রতিটা মানুষকে শ্রদ্ধা করা। কারুর প্রতি রাগ-ক্ষোভ-হতাশা-দুঃখ-ঘৃণা থাকলে সেটাকে আস্তে করে তুলে ফেলে দেয়া, ঠিক যেভাবে আমি তেলাপোকা দেখলে ঘর থেকে তুলে ফেলে দিই (নিজে পারি না অবশ্য, নিয়ন্ত্রণহীন হাত পা নাড়া আর চিৎকার করতে হয়। এক ভদ্রলোকের দয়া হয়, উনি এসে কাজটা করেন)।

এই শ্রদ্ধা আমাকে অনেক কিছু দেয় নাই। দিয়েছে কিছু চমৎকার মানুষ দেখার সুযোগ। এমনকি যে মানুষটার কথা হয়ত আর দশজন বলেছে, দেখিস, কেমন বদ! আমি তার মধ্যে বদ হবার যোগ্য কিচ্ছু দেখিনি। যে মেয়েটা শুনেছি সারাক্ষণ ভুল বের করে, নিজের জীবনটাকেই বিষিয়ে ফেলেছে, সেও কোনদিন আমার ভুল খুঁড়ে বের করে দেয় নাই। যে ছেলেটা সুযোগ পেলেই অন্যদের সাথে নাকি বাজে কথা বলেছে, আমার পাশে অসংখ্য দিন কাজ করেছে, নিজের খুব গোপন একটা কথা বলে দিয়ে পরামর্শ চেয়েছে, আমি কোনদিন অশ্রদ্ধা করতে পারি নাই। খুব চমৎকার বয়সেও আমাকে কেউ কোনদিন একটা চিঠি লুকিয়ে দেয় নাই, তার ব্যপারে ধারণাটা বদলে ফেলতে দেয় নাই (আফসোস শোনাচ্ছে? আছে মনে হয় কিছুটা :p)। শশুরবাড়ি নামক কল্পিত দানবগৃহেও আমার জন্য ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে অপেক্ষা করা মানুষ আছে, এই অদ্ভুত অনুভূতিতে মন ছেয়ে থাকে আমার। লোকে যখন এদিক ওদিক বেড়াতে যায়, দুইদিনের টানা ছুটি পেলেই আমি গাট্টি বেঁধে শশুরবাড়ি যাই এই টানে। গুলিস্তানে বাস থেকে পড়ে পেটের কাছটায় শক্ত হয়ে চাকা হয়ে গিয়েছিলো এইতো মাস দুই আগে, তাও রাত সাড়ে দশটায়। বয়সে তিনভাগের এক ভাগ কম, কিন্তু উচ্চতায় আমার দেড়্গুণ কলিগ, দৌড়ে এসে সান্ত্বনা দিয়েছে, 'আরে আপু আমি ত আরেকদিন বাস থেকে পইড়া শুইয়াই গেছিলাম, আপনেতো তাও বইসা ছিলেন'। আমি ব্যথা ভুলে হো হো হেসে দিয়েছি। আমার ওকে পুরুষ না, কেবল মানুষ মনে হয়েছিলো। এই এখনও, অসংখ্য মানুষের মেসেজে বোঝাই বাক্স আমার, কেউ একটা বাজে কথায় আঘাত করে না। বরং, ভাইবোনদের কাছে বলা যায় না, এমন একটা বিষয়ে একটু মন খুলে শেয়ার করতে চেয়েছে, আমি কথার শেষে তার কথামত সেই মেসেজ মুছে দিয়ে নিজেকে শ্রদ্ধার ঝুলিতে আরও একটা হীরক দানা যোগ করেছি, কাউকে সেসব বলে না দিয়ে আরও একশ হীরকদানা যোগ করেছি। আম্মু প্রায়ই হুমকি দেন, এই যে মানুষের কথা চেপে রাখিস, মাথা ফেটে যাবে।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, কোয়ান্টামে কিছুদিন যাওয়া, নিয়মিত রক্তদান, জেন্ডার নিয়ে কাজ করা, সাড়ে সাত বছরের চাকুরীজীবন, ইত্যাদীতে আমার অসংখ্য মানুষের সাথে মিশতে হয়েছে, হচ্ছে, যারা আমার জেন্ডারের না। বাসে দিনপ্রতি একটাও যদি কনুইয়ের গুঁতা ধরি, এইটা ছাড়া আমি কারো কোন কদর্য মুখ দেখি নাই খুব। দুইএকজন ছিলেন, কিন্তু সে মুখ ভুলতে বা সেখান থেকে উঠে আসতে সাহায্য করেছেন হয়ত আবার আরেকজন পুরুষই। আমি চরম আলসে পুরুষ মহিলা দুইই দেখেছি, যার আলস্যে ব্যাংকে একটা লাইন অকারণেই লম্বা হয়, আর আলস্যে বাচ্চাদের দাঁতে পোকা হয়। আবার এমন সম্মানিত বসও দেখেছি, আলহামদুলিল্লাহ, আমার করা একটা কাজকে নিখুঁত করতে হাঁটু গেঁড়ে এক ঘন্টা পার করে দেন একটা ছোট্ট সফটওয়্যার শিখাতে। এওয়ার্ড পেতে রেডি হওয়া মহিলাটির বাচ্চা কোলে ধরে অপেক্ষা করতে দেখি আর একজন অবিবাহিতাকেও।

সভ্যতা এটাই। শত রকম কনসেপ্টের মধ্য থেকে সর্বোত্তমটা খুঁজে বের করে শিখে নেয়া। আল্লাহ পুরুষ এবং নারীকে প্রতিপক্ষ নয়, বরং সহযোগী করে পাঠিয়েছেন। আমার প্রতিটি দিন চেনা-অচেনা-নারী-পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাবোধে ঠাসা। অন্যায়কে মোকাবিলা করতেও শিখান তাঁরাই, যাদের জেন্ডারের মানুষের অন্যায় আমাদেরকে আহত করে। সুতরাং, সভ্যতার সকল কনসেপ্টে আমি শুধু 'মানুষ' আর 'অমানুষ' খুঁজে নিতে শিখেছি। নারী পুরুষের অকারণ বৈষম্য বা পার্থক্য আমাকে বিরক্ত করে না।

আলহামদুলিল্লাহ।

আগের পর্বঃ

 জেন্ডার স্টাডিজ ১

জেন্ডার স্টাডিজ ২

জেন্ডার স্টাডিজ ৩


আপনার মতামত দিন:

(মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।)
সম্পর্কিত ব্লগ